০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৬ মাঘ ১৪৩১, ৯ শাবান ১৪৪৬
`

তলব-পাল্টা তলবে ঢাকা-দিল্লি

সম্পর্কে টানাপড়েন বাড়ছে
-


নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের উদ্দেশ্যে ভারতে আশ্রয় নেয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া, বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে সম্পর্কে টানাপড়েন ফের বাড়ছে। শেখ হাসিনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে অব্যাহতভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট মন্তব্য এবং বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা উসকে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করে ভারতের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশটির ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কঠোর ভাষায় লেখা প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, ভারতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনার এ ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করছে। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ, অসন্তোষ ও আপত্তি জানাচ্ছে। শেখ হাসিনার এ ধরনের আচরণ বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক স্থাপনের জন্য অনুকূল নয়।
আর এর পাল্টা হিসেবে দিল্লিতেও বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের নিয়মিত বিবৃতিগুলোতে ভারতকে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শাসনসংক্রান্ত বিষয়গুলোর জন্য ভারতকে দায়ী করা হচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে বাংলাদেশের এসব বিবৃতি বিরাজমান নেতিবাচক পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

বাংলাদেশ ও ভারত দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সীমান্ত হত্যাসহ নানা ইস্যুতে বিরোধ থাকলেও কূটনীতিকদের তলব, পাল্টা-তলবের ঘটনা বিরল। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। ভারতের আশ্রয়ে থেকে নানা সময়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার করে গেছেন। এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবসহ হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার বলা সত্ত্বেও সমস্যার সমাধান হয়নি। শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের উদ্দেশে শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যে বিষোদগারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ছাত্র-জনতার ক্ষোভ গিয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও আওয়ামী নেতাদের পরিত্যক্ত বাড়িঘরে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কথাবার্তা নেতিবাচক হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমাদের দেখা দরকার, এর পরিপ্রেক্ষিতে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দুই দেশের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না, বিনিয়োগ আসছে কি না, আদানিসহ ভারতের সাথে বাংলাদেশের চুক্তিগুলো কোনোটি একতরফা হয়ে গেলে সেটা খুঁজে বের করা এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা, চুক্তির কোনো শর্ত বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী হলে তা তুলে ধরা- এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, রাজনীতিতে আমরা অনেক সময় অনেক কিছুই বলি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি করছি সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। অর্থাৎ কথা ও কাজ এই দুটিকে আলাদা করা দরকার। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম একটি বড় ভূমিকা রাখছে। দুই দেশের মধ্যে ডায়ালগ এখন মিডিয়ালগে পরিণত হয়েছে। এখন মিডিয়াতে যতই নেতিবাচক প্রচার হোক না কেন, আমাদের দেখা দরকার দুই দেশের মানুষ ভিসা পাচ্ছে কি না। প্রতিবেশী দেশ দুটির মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরের বিরুদ্ধে যা বলছে, তার কতটুকু কার্যকর করছে-সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বশেষ গত শুক্রবার দিল্লিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, শেখ হাসিনার নামে যে মন্তব্যগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো তার ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে দেয়া। এতে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই। হাসিনার বক্তব্যের সাথে ভারত সরকারের অবস্থানকে এক করে ফেললে তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক মাত্রা যোগ করতে সহায়ক হবে না।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল একই দিন স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে এ বার্তা দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের সাথে ভারত একটি ইতিবাচক, গঠনমূলক ও উভয়ের জন্য লাভজনক সম্পর্ক চায়, যা সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোতে বেশ কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ভারত সরকার যখন পারস্পরিক স্বার্থের সহায়ক সম্পর্কের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে, তখন আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, বাংলাদেশও পরিবেশের অবনতি না হয়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থেকে সম্পর্কের স্বার্থে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এর আগে জয়সোয়াল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর গুঁড়িয়ে দেয়াকে ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
অন্য দিকে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে শেখ হাসিনা যাতে সামাজিক মিডিয়া বা অন্য কোনো যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মিথ্যা, বানোয়াট ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে না পারেন, সে জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতার চেতনায় দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর ভারতের সাথে সম্পর্কে যে ছন্দপতন ঘটেছে, তা কাটিয়ে উঠে একসাথে কাজ করার জন্য দিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি লিখেছেন, ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত সহযোগিতা থেকে আমাদের জনগণের জন্য অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। এই সুযোগ হাতছাড়া করা আমাদের উচিত হবে না।
‘আসুন একসাথে কাজ করি’ শিরোনামের এই নিবন্ধের শুরুতেই ভারতের সাথে সম্পর্কের ছন্দপতনের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা লিখেছেন, ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মনে হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতন যে আসন্ন ছিল, ভারতীয় প্রশাসন তা ধারণাও করতে পারেনি। তবে আমাদের স্মরণ রাখা দরকার, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং আমি, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিবাচক দিকগুলোর ওপর ভিত্তি করে কাজ করতে এবং উত্তেজনা ও ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্রগুলো বাস্তবসম্মতভাবে সমাধান করতে আগ্রহী।
তৌহিদ হোসেন লিখেছেন, আমাদের অবস্থান প্রথম থেকেই স্পষ্ট। আমরা ভারতের সাথে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে একটি কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমরা আশা করি, ভারতের পক্ষ থেকেও আমাদের এই ইচ্ছার যথাযথ প্রতিফলন ঘটবে। গত ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফর ছিল ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় থেকেই যে দুই দেশের অংশীদারত্বের ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উপদেষ্টা লিখেছেন, এই সহযোগিতা অব্যাহত রাখা দুই দেশের জনগণের জন্যই কল্যাণকর হবে। দুই দেশের সম্পর্কে নানা চ্যালেঞ্জ থাকার পরও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কিছু ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ দেখা গেছে। দুই দেশে বন্দী থাকা জেলেদের যার যার দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে নিতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়েছে। এই ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমাদের পারস্পরিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলা উচিত, যা আমাদের উভয় দেশের জনগণ, অঞ্চল এবং বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আর ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা বন্ধ করার মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক রচনার একটি ভালো সূচনা হতে পারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement