বৈধতার সঙ্কটে আওয়ামী লীগ
- মনিরুল ইসলাম রোহান
- ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:২৫
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে পরিচিতি লাভকারী আওয়ামী লীগ বিগত টানা ১৬ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম খুন, হত্যাসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে বর্তমানে রাজনীতিতে বৈধতার সঙ্কটে পড়েছে। ২৪’র জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন গণহত্যার মতো মারাত্মক অপরাধের দায় দলটির মাথার ওপরে। রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বেশির ভাগের দাবি- গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। এদিকে এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে পথ বাতলানোর পরিবর্তে বিদেশে বসে এবং আত্মগোপনে থেকে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলার নানা ছক কষছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট নজিরবিহীন পতনের পর আওয়ামী লীগের টপ টু বটম দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ও আত্মগোপনে থাকায় চরম সঙ্কটের মুখে পড়ে এক সময়কার ক্ষমতার দাপট দেখানো দলটি। অভ্যুত্থানের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও রাজনীতিতে পুনর্বাসন হওয়া তো দূরের কথা দিন যতই যাচ্ছে অতীতের লুটপাট ও গুম, খুন, হত্যার রোমহর্ষক চিত্রসহ নানান কুকীর্তি সামনে চলে আসায় আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের ঘৃণা তীব্রতর হচ্ছে। এর রেশ আছড়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের তীর্থস্থান ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির ওপরে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও অসন্তোষের জায়গা থেকে ছাত্র-জনতা গুঁড়িয়ে ও পুড়িয়ে দিয়েছে ধানমন্ডির ওই বাড়িটি। এ দিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন দেশজুড়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্মম দৃশ্যপট এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সাধারণ মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ায় গণহত্যার নির্দেশদাতা ও সরাসরি জড়িত থাকার মারাত্মক অভিযোগ ওঠায় দেশের সুশীল সমাজসহ বৃহত্তর রাজনৈতিক মহল থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবি উঠছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাত্তরে গণহত্যার কোনো ভিডিও চিত্র বা শক্ত কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া না গেলেও শুধু লোকেমুখে কানেশুনে জামায়াতের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগ আমলে দলটির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয় এবং সর্বশেষ আইনি কাঠামোর ব্যত্যয় ঘটিয়ে জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন জামায়াতকে নিষিদ্ধ দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অতীতের স্কাইপি কেলেঙ্কারীসহ নানা মাধ্যমেও সেটা উঠে এসেছে। এ দিকে ২৪’র জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ, ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগ যৌথভাবে নির্মম নির্যাতন ও গুলি চালিয়ে হত্যা করে। যার ভিডিওচিত্র এখন প্রায় দেশের সব নাগরিকের হাতে হাতে। এই ঘৃণ্য অপরাধের নির্দেশদাতা হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবি এবং ওই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার দায়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাসহ জড়িত নেতাকর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ২৪’র জুলাই গণহত্যাকারী দল হলো আওয়ামী লীগ। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে। ফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার আর কোনো বৈধতা নেই, নৈতিক ভিত্তিও নেই। তিনি বলেন, আইনগতভাবে এখনো বৈধতা থাকলেও দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে আর এ দেশে রাজনীতি করতে দেবে না। এক প্রশ্নের জবাবে ড. মাসুম বলেন, একাত্তরে জামায়াত গণহত্যা চালিয়েছে-এটা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এটা আওয়ামী লীগও জানত। কিন্তু ভারতের চাপে পড়ে আওয়ামী লীগ, জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।
অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতি করার নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে। বাকশাল গঠনের আগে আওয়ামী লীগ যেমন নিজেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিল, তেমনি এখন তারা আবার দ্বিতীয়বার আত্মবিলুপ্তির পথে হাঁটছে। যেভাবে মুসলিম লীগ বিলুপ্ত হয়েছে, একইভাবে আওয়ামী লীগও একদিন বিলুপ্ত হবে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বাইরে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবি উঠেছে। গেল শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে। তিনি আরো বলেন, প্রথমত এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একধরনের ‘ঐকমত্য’ তৈরি হচ্ছে। দেশের মানুষ তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক এবং একগুঁয়েমি মনোভাব ও কার্যকলাপ মেনে নিতে পারেনি বলেই ৫ আগস্টের আগে ও পরে তাদের মধ্যে দলটি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন ঐকমত্য তৈরি হলে সরকারের জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গত বুধবার এক সভায় বলেছেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, বাংলাদেশের মানুষ গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের বিতাড়ন করেছে। বাংলাদেশে সেই আওয়ামী লীগের নামে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না। দলটির গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তাদের বিচার দাবি জানাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো: ইসমাইল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, যারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কথা বলছে, দেখতে হবে তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কতটুকু। প্রথমত: আইনি কাঠামোর মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা। দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করা। রাজনৈতিকভাবে যদি নিষিদ্ধ করা হয় সেখানে একটা জনমত জরিপও লাগবে। কারণ এখানে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এমন সংখ্যাও কম নয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি দল হিসেবে অপরাধ করে তাহলে অবশ্যই তার বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানে যে গণহত্যা হয়েছে সেটা আওয়ামী লীগ কি দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে করেছে কি না সেটাও দেখতে হবে। তথ্য প্রমাণ থাকতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা