০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩১, ৮ শাবান ১৪৪৬
`

চট্টগ্রামে কি আদৌ পাহাড় থাকবে

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় চলছে পাহাড়-টিলা কেটে সমান করার কাজ : নয়া দিগন্ত -

- পাহাড় রক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশ বিশেষজ্ঞদের
- পাহাড়কে ভিন্ন শ্রেণীর ভূমি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করিয়ে আইনি সুবিধা নেয়া হচ্ছে

পাহাড়, নদী, সমুদ্র ও হ্রদের অপরূপ সমারোহের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই চট্টগ্রামে আদৌ পাহাড় থাকবে কি না সে প্রশ্ন এখন সামনে আসছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধশতাব্দীতে এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে সিকিশত পাহাড়। এর বাইরে যেসব পাহাড় টিকে ছিল সেগুলোও পাহাড় খেকোদের লোলুপ দৃষ্টিতে পড়ে একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়খেকোরা এরই মধ্যে চট্টগ্রামের ৩৪ স্থানের পাহাড়ি ভূমিকে নথিতে অন্য শ্রেণীভুক্ত করে রেখেছে যাতে সহজেই কেটে ফেলা যায়। একের পর এক পাহাড় ধ্বংসে হারিয়ে যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক গাছপালা ও জীববৈচিত্র্য, ফলে প্রকৃতিতে বাড়ছে উত্তাপ। আর বর্ষাকালে ন্যাড়া পাহাড়গুলো প্রচুর পানি শোষণ করে একপর্যায়ে ধসে পড়ে জীবনহানি যেমনি ঘটাচ্ছে, তেমনি নগরীতে জলাবদ্ধতারও অন্যতম কারণ এই পাহাড়কাটা। আর পাহাড়কাটার সাথে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যেমনি আছেন, তেমনি সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। পাহাড় কেটে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বসতিতে আবার সরকারি বিভিন্ন সংস্থার (বিদ্যুৎ, পানি) সেবাও পৌঁছে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের পাহাড় রক্ষায় নদী রক্ষা কমিশনের আদলে পাহাড় রক্ষা কমিশন গঠনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

এ দিকে চট্টগ্রামে কি পরিমাণ পাহাড় এখন পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় আছে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি কিংবা পরিবেশ অধিদফতরের কাছে। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল সার্ভের মাধ্যমে পাহাড় চিহ্নিতে কাজ করছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি যেসব পাহাড় রেকর্ডে ভিন্ন শ্রেণীভুক্ত আছে এর একটা তালিকা অ্যাসিল্যান্ড অফিসগুলোকে সরবরাহ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে বলেও সূত্র জানায়।
পাহাড়ের মালিকানা : সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম শহরের পাহাড় বিভিন্ন সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সংস্থা এবং অভিজাত ব্যক্তিদের মালিকানাধীন। বাংলাদেশ রেলওয়ে শহরের পাহাড়ের সবচেয়ে বড় মালিক। গণপূর্ত বিভাগ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (সিওয়াসা) এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহরের অন্যান্য বৃহৎ পাহাড়ের মালিক। এ ছাড়াও এ কে খান গ্রুপ, ইস্পাহানি গ্রুপ, জেমস ফিনলে নামে কিছু বৃহৎ বেসরকারি কোম্পানি এবং কিছু অভিজাত ব্যক্তিও পাহাড়ি জমির একটি অংশের মালিক। শহরের বাইরে জেলা পরিষদও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাহাড়ের মালিক।

পাহাড় কাটার পরিস্থিতি : চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার সঠিক ইতিহাস বের করা অত্যন্ত কঠিন। তবে রেকর্ড বলছে যে ১৭৬০ সালে পাহাড় কেটে এবং গাছপালা সাফ করে ইংরেজরাই প্রথম এই অঞ্চলের উন্নয়ন শুরু করেছিল (ইসলাম, ২০০৮)। তাই বলা যেতে পারে যে, তার আগে চট্টগ্রামের পাহাড় প্রায় অক্ষত ছিল। গবেষকদের মতে, ১৯১০ সালের গোড়ার দিকে চট্টগ্রাম শহরে ২০০টিরও বেশি পাহাড় ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কেন্দ্রীয় ব্রিটিশ সরকার তাদের স্থানীয় প্রশাসকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পাহাড়ের চূড়ায় তাদের প্রধান প্রশাসনিক ভবন স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল। যেমন- ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক চট্টগ্রাম শহরের জজকোর্ট ভবনটি পরীর পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপন করেছিল। পরে, সেই সময়ে আরো অনেক প্রশাসনিক, কলেজ এবং পাবলিক ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এক গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, ১৮৭২ সালে চট্টগ্রাম শহরে মাত্র ১৮,৭৮০ জন লোক বাস করত। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পর থেকে নগরবাসীর সংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যখন চট্টগ্রাম বন্দর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য, চট্টগ্রাম শহরের পাহাড় কেটে বা আকার পরিবর্তন করা প্রয়োজন ছিল। ১৯৫০ সালে, চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ, পাহাড়তলী, ফৌজদারহাট এবং ভাটিয়ারি এলাকার পাহাড়ি এলাকায় শিল্পায়ন দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। তবে সেই সময়ে পাহাড় ভাঙনের মাত্রা সীমিত ছিল এবং এটি পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে বিবেচিত হয়নি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, চট্টগ্রাম শহর দেশের বাণিজ্যিক নগরীতে পরিণত হয় এবং বাণিজ্যিক কার্যকলাপের সাথে তালমিলিয়ে পাহাড় কেটে দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ন ঘটে। গত অর্ধশতাব্দীতে অবৈধ এবং অপরিকল্পিতভাবে কাটার কারণে চট্টগ্রাম শহর বিভিন্ন আকারের শতাধিক পাহাড় হারিয়েছে।

কে পাহাড় কেটেছে এবং কেন : পাহাড় কেটে সমতল করা হয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিভিন্ন সুবিধা এবং আর্থিক লাভের জন্য। মাঠ জরিপ থেকে চিহ্নিত পাহাড় কাটার সাথে সম্পর্কিত প্রধান অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হলো বস্তি এবং বসতি স্থাপনের জন্য জায়গা সমতল করা, আবাসন প্লট তৈরি করা, নিচু জমি বা খাল ভরাটের জন্য মাটি ব্যবহার করা, ইটভাটায় মাটি সরবরাহ করা, পাহাড়ি এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সরকারি বা বেসরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।
চট্টগ্রাম শহরের বেশির ভাগ বস্তি এবং বসতি স্থাপন সরকারি জমিতে অবস্থিত। মতিঝর্ণা, আমবাগান, টাইগার পাস, বাটালি পাহাড়, লালখান বাজার, ফয়’স লেক এলাকা ইত্যাদি রেলওয়ে এবং অন্যান্য সরকারি জমি যেখানে হাজার হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ যেমন-পোশাক শ্রমিক, রিকশাচালক এবং দিনমজুররা অবিবেচক পাহাড় কাটার পরে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের ঢালে বসবাস করছেন এবং এই এলাকায় এখনো এই কার্যকলাপ অব্যাহত রয়েছে। প্রায় সমস্ত বর্ষাকালে এই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে ছোট বা মাঝারি আকারের ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। গবেষণা রিপোর্টে একটি মাঠ জরিপের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, কিছু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি, কিছু সরকারি কর্মকর্তার সহযোগিতায়, পাহাড় কাটা এবং বস্তি সম্প্রসারণের সুবিধাভোগী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, প্রভাবশালী এবং অভিজাত গোষ্ঠী, সংস্থা বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো পাহাড়িজমি সমতল করে এবং তারপর আবাসিক প্লট হিসেবে বিক্রি করে। দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকা, জালালাবাদ হাউজিং, বেভারলি হিল, কানান্ধরা আবাসিক এলাকা, সমবায় আবাসিক এলাকা, নন্দন হাউজিং, শাপলা হাউজিং, চৌধুরী এস্টেট ইত্যাদি সবই পাহাড় কেটে সমতল করে গড়ে তোলা।

শুধু দরিদ্র ও ধনী ব্যক্তি বা প্রভাবশালী সংস্থাই নয়, সরকারি কর্তৃপক্ষও পাহাড় কাটার জন্য অভিযুক্ত। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) তার আবাসন প্রকল্পের জন্য পাহাড় কেটেছে। ভিআইপি হাউজিং, লেকসিটি হাউজিং এবং কোবে হাউজিং হল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাহাড় কাটা আবাসিক প্রকল্পের উদাহরণ। চট্টগ্রামে তাদের অফিস ভবন নির্মাণের সময় পরিবেশ অধিদফতরকেও পাহাড় কাটার জন্য দায়ী করা হয়। অতি সম্প্রতি চীনা অর্থায়নে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ বার্ন ইউনিট নির্মাণেও পাহাড় কাটার অভিযোগ উঠে এবং এক পর্যায়ে তা স্থগিত করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণে ব্যাপক পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বোস্তামী সংযোগ সড়ক নির্মাণ করেছে। ওই সড়কের আশপাশে এখন ভূমি দস্যুরা পাহাড় কাটার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। এ ছাড়া নগরীর চন্দ্রনগর, আকবরশাহ, খুলশী, শেরশাহ বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড়কেটে সাবাড় করা হচ্ছে।

বাস্তবে পাহাড় রেকর্ডে ভিন্ন শ্রেণী : বাস্তবে পাহাড় কিন্তু ভূমি রেকর্ডে নাল বা ছনখোলা বা আবাসিক বা ভিটি শ্রেণীভুক্ত করে রাখা হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাহাড়কে। এসব পাহাড়কেটে প্রতিনিয়তই সাবাড় করা হচ্ছে কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোরও যেন কিছুই করার নেই। এরই দৃশ্যমান উদাহরণ হলো অতি সম্প্রতি জামালখানের গ্রিনল্যাজ পাহাড়কে ভিটি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত থাকার অজুহাতে প্রশাসনের নাকের ডগায় পাহাড় কেটেই নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য মতে, নগরীর ৩৪টি স্থানে এ ধরনের পাহাড়কে ভিটি বা ছনখোলা বা নাল বা আবাসিক শ্রেণীভুক্ত করে রাখা হয়েছে।
পাহাড় রক্ষায় সরকারি তৎপরতা : পাহাড় রক্ষায় বাস্তবে তেমন কার্যক্রম পরিলক্ষিত না হলেও সরকারের ওপর মহলের চাপে বেশ কাগুজে তৎপরতা শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়গুলো ৫টি জোনে বিভক্ত পৃথকভাবে তদারকির জন্য ৫টি কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এসব কমিটি ক্যালেন্ডার ভিত্তিতে পাহাড়গুলোতে টহলের ব্যবস্থা, পাহাড়কাটা বন্ধে ভূমি মালিকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের, ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়ের বাস্তব শ্রেণী পরিবর্তনরোধে ব্যবস্থাগ্রহণ, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের তালিকা প্রস্তুত করে সরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ, পাহাড়-টিলায় কর্তন নিষেধাজ্ঞার সাইনবোর্ড স্থাপন, ১৫ দিন অন্তর প্রতিবেদন প্রদানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এসব কমিটিকে।

এ ছাড়া নিয়মিত অভিযান পরিচালনা এবং মামলা দায়ের কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। পরিবেশ অধিদফতরের ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পাহাড়ের ঢালে লাখো অবৈধ বসতি : চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়ের ঢালে লাখো মানুষের অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে রাজনৈতক প্রভাবশালীদের মাধ্যমে। অতি সম্প্রতি চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় উঠে এসেছে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম শহরের মতিঝর্ণা ও বাটালী হিলের ঢালেই প্রায় এক লাখ লোকের বসতির তথ্য। এর মধ্যে আবার প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। এ ছাড়া ফয়’স লেক এলাকার ১, ২, ৩নং ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ের অবৈধ বসবাসকারি পরিবারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন ১৬টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করে ৬ হাজারের অধিক পরিবার। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে ৩৮৩টি পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে।
অবৈধ বসতিতে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ : পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে উঠা অবৈধ বসতিগুলোতে রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ, ওয়াসার পানির লাইন। বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্নে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার কথা থাকলেও তা দৃশ্যমান নয় এমন অভিযোগ নিত্যদিনের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবৈধ এসব বিদ্যুৎসংযোগ রক্ষায় পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারীরা উচ্চ আদালতেরও দ্বারস্থ হচ্ছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, গত অর্ধশতাব্দীতে চট্টগ্রাম শহর ১২০টিরও বেশি পাহাড় হারিয়েছে। পাহাড় কেটে আবাসিক প্লট তৈরি, অবৈধভাবে বালু ও মাটি বিক্রি, বস্তি স্থাপন, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কার্যালয় স্থাপন, ইটভাটার মাটি সরবরাহ, নিচুভূমি ভরাট করা এবং রাস্তাঘাটসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণে এসব পাহাড় হারিয়ে গেছে। অপরিকল্পিত পাহাড় কাটার ফলে ভূমিধসের ঝুঁকি সৃষ্টি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, খাঁড়াভাবে কাটা পাহাড় বর্ষাকালে প্রচুর পানি শোষণ করে একপর্যায়ে ব্যাপক ওজন (মাস ওয়েট) ধরে রাখতে না পেরে ভূমিধসের ঘটনা ঘটায়, যা জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করে। যেহেতু স্বল্প আয়ের মানুষজন পাহাড়ের ঢালে বসবাস করে তাই নিম্নবিত্তরাই ভূমিধসে হতাহতের শিকার হয়ে থাকে। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে ভূমিধসের ফলে ১২৭ জনের প্রাণহানি, ২০১২ সালের ২৬ জুন পাহাড়ধসে মহানগরীতে ২৬ জন এবং গোটা চট্টগ্রামে ৯০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানির ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেন এই গবেষক। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়গুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং বর্ষাকালে নিয়মিত ক্ষয়ের শিকার হয়। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বালুকাময় (সেন্ডি) হওয়ায় বালু সহজেই ক্ষয়ের শিকার হয়ে পাহাড় থেকে নেমে এসে ড্রেন, ছড়া বা খালগুলোতে এসে জমা হয়ে ভরাট করে ফেলে। ফলে নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ।
ড. মাহবুব মোর্শেদ জানান, পাহাড় অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল। পাহাড় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অর্থ জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়া। তা ছাড়া পাহাড়গুলো সাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ুকে বাধা দিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাহাড় হারিয়ে গেলে জলবায়ু পরিবর্তন যে অবশ্যম্ভাবী তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি অনাবৃষ্টি ও উত্তাপ বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, নগরের সব পাহাড়ের কর্তৃত্ব সিটি করপোরেশনের হাতে থাকার কথা। কিন্তু পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। প্রশাসন সামলিয়ে তাদের পাহাড়ে নজরদারির সময় কই? কোথাও পাহাড় কাটলে বা পাহাড় ধসে মানুষ মারা গেলে প্রশাসনের লোকজন যায়। কিন্তু পাহাড়কাটা প্রতিরোধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে পাহাড় ব্যবস্থাপনায় অন্যদের সহায়ক শক্তি হিসেবে সংযুক্ত রাখার প্রস্তাব করেন এই গবেষক। এখন যে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে তাদের নিজস্ব কোনো সার্ভে বা পাহাড়ের অবস্থা নিয়মিত সরেজমিন পর্যবেক্ষণে তৎপরতা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, পাহাড় আল্লাহ প্রদত্ত। পাহাড়ের গুরুত্ব আমরা অনুধাবন করতে পারছি না। পাহাড়কাটার ফলে বৃষ্টিতে পাহাড়ি মাটিতে ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, গাছপালা, পশু-পাখি বিলীন হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে উত্তাপ। নদী রক্ষা কমিশনের আদলে পাহাড় রক্ষায় স্থায়ী একটি পাহাড় রক্ষা কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করেন তিনি।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব সাদি উর রহিম জাদিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, পাহাড় রক্ষায় জেলা প্রশাসন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে থাকে। এ ছাড়া যেসব বাস্তবে পাহাড় কিন্তু রেকর্ডে ভিন্ন সেসব পাহাড়ের তথ্য সরবরাহের জন্য ভূমি অফিসগুলোকে সরবরাহ করতে বলা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) সোনিয়া সুলতানা নয়া দিগন্তকে বলেন, চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়গুলোকে পাহাড় খেকোদের হাত থেকে রক্ষায় পাঁচটি জোনে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এই জোনগুলোর সাথে সংযুক্ত রাখা হয়েছে সরকারের বিভিন্ন সেবা সংস্থাগুলোকে। এর বাইরে আমরা দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাবনায় সবগুলো পাহাড়কে সরকার যাতে অধিগ্রহণ করে সে প্রস্তাবনা দিয়েছি। অপরাধ বাড়ছে কারণ ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়গুলোতে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। বার্ন ইউনিটের পাদদেশে স্তরে স্তরে ঢালু করে চীনা প্রযুক্তিতে গাছ লাগানো হবে পাহাড়ের স্ট্রাকচার অক্ষুণœ রেখে। তাদের সে প্রস্তাবনা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। পাইলিংয়ের সময় যাতে পাহাড় ভেঙে না পড়ে সেজন্যই এমন প্রযুক্তির প্রস্তাবনা বলে তারা জানিয়েছেন। এ প্রস্তুাবনায় সন্তুষ্ট কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাইনিজ প্রযুক্তি সম্পর্কে যেহেতু আমাদের ধারণা নেই, সেজন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে ফরোয়ার্ড করেছি। তবে এতটুকু মনে হয়েছে, আমরা সচরাচর পাহাড়ে খাঁড়াভাবে রিটেইনিং ওয়াল দিই এবং সেটি ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থাকে। সেই বিবেচনায় এটা বেটার হতে পারে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থাকা সত্ত্বেও চাইলেই অভিযান চালানো যায় না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল