আ’লীগ আমলে শেয়ারবাজার থেকে উধাও ১৫ লাখ বিনিয়োগকারী
পুঁজি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকে- শাহ আলম নূর
- ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:২৪
দেশের শেয়ারবাজারে অব্যাহতভাবে কমছে বিনিয়োগকারী। বর্তমানে যারা আছেন তাদের অনেকেই বাজার থেকে বেড় হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দেড় দশকে শেয়ারবাজার থেকে উধাও হয়েছেন ১৫ লাখের বেশি বিনিয়োগকারী। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অব্যাহত লোকসানের কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১০ সাল থেকে শুরু হয় শেয়ারবাজারে অস্থিরতা। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নানা অপকর্মের মাধ্যমে অস্থির করা হয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও পতনের ধারা থেকে বের হতে পারছে না শেয়ারবার।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সাল থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট কমতে শুরু করে। নতুন বিনিয়োগের জন্য বাড়ছে না বিও সংখ্যা। দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের সব তথ্য সংরক্ষণ করে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) বাংলাদেশের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তথ্যের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত কতজন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার থেকে বের হয়ে গিয়েছে তার কোনো তথ্য প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। সিডিবিএলের তথ্যে দেখা যায় ২০১৬ সালে ঢাকার শেয়ারবাজারে মোট বিও অ্যাকাউন্ট ছিল ২৯ লাখ ২৯ হাজার ১৮৯টি। ২০২৪ সাল শেষে এ সংখ্যা নেমে হয়েছে ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৯৫২। তথ্যে দেখা যায়, শুধু আট বছরে দেশের শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারী হারিয়েছে ১২ লাখ ৬৪ হাজার ২৩৭ জন। বিশ্লেষকরা মনে করেন এ সংখ্যা আরো বেশি। কারণ এই ১২ বছরে নতুন যারা বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছেন তাদের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে ২০১০ সাল থেকে ১৫ সাল পর্যন্ত শেয়ারবাজার থেকে তিন লাখের বেশি বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার ছেড়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের যেকোনো খাতের দিকে তাকালে দেখা যাবে অব্যাহতভাবে বাড়ছে বিনিয়োগকারী। তবে দেশের শেয়ারবাজারে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। দেশের শেয়ারবাজারে অব্যাহতভাবে কমছে বিনিয়োগকারী। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং ডিএসইর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের শেয়ারবাজারে ৩৪ লাখের বেশি বিনিয়োগকারী রয়েছেন। তবে বাস্তবে চিত্র উল্টো। আসলে বর্তমানে শেয়ারবাজারে ১৬ লাখের কিছু বেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে। অর্থাৎ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে প্রায় ১৫ লাখ বিনিয়োগকারী বাজার থেকে উধাও হয়েছে। শেয়ারবাজারে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে অনেক বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা করে করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শেয়ারবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারী আব্দুন নূর নয়া দিগন্তকে বলেন, বিনিয়োগের অর্থ প্রতিনিয়ত কাগজে পরিণত হচ্ছে। তিনি শেয়ারবাজারে এসেছেন আর্থিক লাভের জন্য। কিন্তু অব্যাহত পতনের কারণে প্রতিদিন তার লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে বলে তিনি জানান।
মার্জিন ঋণ প্রসঙ্গে অপর বিনিয়োগকারী আব্দুল কুদ্দুস নয়া দিগন্তকে বলেন, শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগের জন্য ডেকে আনা হয়েছে। এজন্য তিনি মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। অব্যাহত দর পতনে মার্জিন ঋণের চাপে পড়েছেন তিনি। শেয়ারের দাম নি¤œমুখী হওয়ায় ঋণের টাকা সমন্বয় করতে ফোর্স সেলের নামে ভালো কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে তিনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন বলে তিনি জানান।
এদিকে ব্রোকারেজ হাউজগুলো ঘুরে দেখা যায় এখানে নেই পরিচিত সেই চিরচেনা কর্মচাঞ্চল্য। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তারা বলেন, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের পদচারণায় এক সময় মুখরিত থাকতো হাউজগুলো। মন্দার কারণে অনেকেই শেয়ারবাজার থেকে যেমন বের হয়ে যাচ্ছে। তেমনি অনেকে আবার লোকসানে থাকায় তার বিনিয়োগের কোনো খোঁজখবর রাখেন না এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমআইএ) প্রধান মুখপাত্র মো: নূরুল ইসলাম মানিক নয়া দিগন্তকে বলেন, শেয়ারবাজারের ২০১০ সালে যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শুরু হওয়া অস্থিরতা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। শেয়ারবাজারে নিজের কষ্টার্জিত পুঁজি হারিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আবার অনেকেই হার্টের অ্যাটাক করে বিছানায় ছটফট করছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি অনেক আশা নিয়ে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ করেছিলাম। আমার আশা এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি আশা করেছিলাম শেয়ারবাজারে কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করে সৎভাবে জীবন যাপন করব।’ তবে সে আশায় গুড়েবালি বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে তিনি প্রায় দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তার বিনিয়োগের অর্থ কাগজে পরিণত হয়েছে বলে তিনি জানান। গত পাঁচ মাসে ৬৬ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে উধাও হয়েছে। কারণ শেয়ারবাজার ধ্বংস করার জন্য একটি গ্রুপ উঠে পড়ে লেগেছে। সালমান এফ রহমানের উত্তসূরিরা শেয়ারবাজারকে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে পুঁজি হারিয়ে বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। লোকসানে থাকার কারণে বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম চালার মতো অর্থ তাদের হাতে নেই। এতে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের বাচ্চার দুধ পর্যন্ত কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাজারে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা দেশে অস্থিরতা তৈরির জন্য কাজ করে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে কোনো দলীয় প্রভাব নেই। শেয়ারবাজারে যারা বিনিয়োগকারী তাদের কোনো দলীয় পরিচয় নেই। তারা সবাই দল মত নির্বিশেষে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন আমি পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় মাঠে নেমেছি আমার শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত আমি লড়াই চালিয়ে যাবো বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে ঘরে ফিরব কারণ আমি চাই যেভাবে আমার সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছি আর কে যেন এভাবে নিঃস্ব না হয় এবং আমি আন্দোলনের মাধ্যমে এখানে যারা স্বার্থান্বেষী মহল রয়েছে তাদের মুখোশ উন্মুক্ত করে দিতে চাই।
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমআইএ) সিনিয়র মুখপাত্র এস এম ইকবাল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে যাদের বিনিয়োগ রয়েছে তাদের ৯৯ শতাংশই পুঁজিহারা বিনিয়োগকারী। এসব বিনিয়োগকারী তাদের বিনিয়োগের অর্থ হারিয়ে মানবতার জীবনযাপন করছেন। এসব বিনিয়োগকারী তাদের বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না, সংসারের চাহিদা পূরণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারছেন না। দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অধিকাংশই তাদের বিনিয়োগের ৬০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ হারিয়েছেন।
বিনিয়োগকারীদের বাজারবিমুখতা প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত বিএসইসির টাস্কফোর্সের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীরা বাজারে লেনদেনে আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন না। অনেক বিও অ্যাকাউন্ট বহুদিন ধরে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। অনেকে আবার অ্যাকাউন্টের টাকা তুলে বাজার থেকে চলে গেছেন। সব মিলিয়ে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের ভরসা কমে গেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা