বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায়। বিশেষত বুদ্ধিজীবী মহলের এক পক্ষ উর্দু এবং আরেক পক্ষ বাংলার পক্ষে অবস্থান নেয়। এ নিয়ে শুরু হয়ে যায় দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রভাষাসংক্রান্ত সমস্যার সমাধানমূলক প্রস্তাব নিয়ে সামনে আসে তমদ্দুন মজলিস।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৭ দিনের মাথায় ১ সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রতিষ্ঠা করেন এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটি। ওই মাসেরই ১৫ তারিখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা- না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। তমদ্দুন মজলিসের প্রস্তাবে বলা হয়- পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দু’টি- উর্দু ও বাংলা। বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, অফিসিয়ালি ভাষা, আদালতের ভাষা। উর্দু হবে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু শিক্ষা দেয়া যাবে। ইংরেজি হবে পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। ঠিক একই নীতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে প্রথম ভাষা হবে স্থানীয় ভাষা বা উর্দু। দ্বিতীয় ভাষা বাংলা এবং তৃতীয় ভাষা হবে ইংরেজি।
তমদ্দুন মজলিসের প্রস্তাবে বলা হয়, ‘দেশের শক্তির যাতে অপচয় না হয় এবং যে ভাষায় দেশের জনগণ সহজে ও অল্প সময়ে লিখতে, শিখতে ও বলতে পারে সে ভাষাই হবে রাষ্ট্রভাষা। এ অকাট্য যুক্তিই উপরি ওই প্রস্তাবের প্রধান ভিত্তি। আর না হয় ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ যেমন জনগণের মত না নিয়ে জনগণের সুবিধা-অসুবিধা না ভেবে ইংরেজিকে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল, তেমনি শুধু উর্দু বা বাংলাকে সব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করলে ঠিক সেই সাম্রাজ্যবাদী অযৌক্তিক নীতিরই অনুসরণ করা হবে। অথচ এই অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাই কোনো কোনো মহলে আজ দেখা যাচ্ছে। একে সর্ব প্রকারে বাধা দিতে হবে। এর বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এরই সূচনা হিসেবে আমরা কয়েকজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিকের প্রবন্ধ প্রকাশ করছি এবং সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেককে এ আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
ইতিহাসবিদদের মতে- উর্দু ও বাংলা উভয়কে রাষ্ট্রভাষা করার যে প্রস্তাব সে দিন তমদ্দুন মজলিস দিয়েছিল, তা যদি সবাই মেনে নিত তাহলে ইতিহাস হয়তো ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতো।