গাজা দখলের ঘোষণা ট্রাম্পের
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৪০
- তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রত্যাখ্যান সৌদির
- যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া
- আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হবে
ফিলিস্তিনিদের অন্য কোথাও পুনর্বাসিত করার পর যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা ভূখণ্ডের দখল নিয়ে সেটিকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র সফররত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সাথে নিয়ে করা এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প তার এই আশ্চর্য পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা প্রস্তাব করেননি তিনি। আলজাজিরা, বিবিসি ও রয়টার্স।
ইতোমধ্যেই ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দিয়েছেন সৌদি আরবসহ পাঁচটি আরব দেশ। রিয়াদ বলেছে, ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ড থেকে সরানোর যেকোনো চেষ্টার বিরোধিতা করবে সৌদি আরব। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ট্রাম্পের প্রস্তাবকে ‘শত্রুতাপূর্ণ’ অভিহিত করে বলেছে, ট্রাম্পের এ মনোভাব মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি একটি হুমকি। ট্রাম্পের এই মন্তব্যে শুধু আরব বিশ্বেই নয়, রাশিয়া ও চীনসহ যুক্তরাষ্ট্রেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
ট্রাম্পের এই ঘোষণায় ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চলা সঙ্ঘাত নিয়ে কয়েক দশক ধরে চলে আসা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে একইদিন সকালে ট্রাম্প গাজার ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিয়ে সবাইকে স্তম্ভিত করে দেন। ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে ভঙ্গুর একটি যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্ব পালিত হচ্ছে। এই ছিটমহলকে ‘ধ্বংস হয়ে যাওয়া এলাকা’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
রয়টার্স বলেছে, ট্রাম্প আশা করতে পারেন মিত্র ও শত্রুরা একই রকমভাবে গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো দখলদারিত্বের প্রবল বিরোধিতা করবে। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশ নিলে তা ওয়াশিংটন ও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ দীর্ঘ দিন ধরে যে নীতি অনুসরণ করে আসছে তার বিপরীত হবে। ওই নীতিতে গাজাকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ বলে ধরা হয়, ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিমতীরও যার অন্তর্ভুক্ত।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজা ভূখণ্ডের দখল নেবে আর আমরা এটিকে নিয়ে একটি কাজও করব। আমরা এটির মালিক হয়ে সেখানে থাকা বিপজ্জনক অবিস্ফোরিত সব বোমা ও অন্যান্য অস্ত্র ধ্বংস করার দায়িত্বপালন করবো। যদি এটা প্রয়োজনীয় হয়, আমরা তা করব, আমরা খণ্ডটি দখল করতে যাচ্ছি, আমরা সেটির উন্নয়ন ঘটাতে যাচ্ছি, হাজার হাজার চাকরি তৈরি হবে আর এটি এমন কিছু হবে যার জন্য পুরো মধ্যপ্রাচ্য অত্যন্ত গর্বিত হতে পারে।
আমি একটি দীর্ঘমেয়াদি মালিকানার অবস্থান দেখতে পাচ্ছি আর এটি মধ্যপ্রাচ্যের ওই অংশে ব্যাপক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে। তিনি জানান, তিনি এ ধারণা নিয়ে ওই অঞ্চলের নেতাদের সাথে কথা বলেছেন আর তারা এতে সমর্থন জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ‘দখলকৃত’ গাজায় কারা বসবাস করবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি ‘বিশ্বের মানুষের’ বাড়িতে পরিণত হতে পারে।
ফিলিস্তিনের ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী এই সংকির্ণ ভূখণ্ডটির ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’ হয়ে উঠার সম্ভাবনা আছে বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প। কীভাবে এবং কোনো কর্তৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির আবাস গাজা দখল করে এটি অধিকার করতে পারে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব দেননি তিনি। সাগর তীরবর্তী এই ভূখণ্ডটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘ সহিংসতার ইতিহাস আছে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনগুলো ধারাবাহিকভাবে এই বিপজ্জনক ভূখণ্ডে মার্কিন সেনা মোতায়েন এড়িয়ে গেছে। সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প কয়েকবার নেতানিয়াহুকে তার ডাক নাম ‘বিবি’ উল্লেখ করে কথা বলেন। নেতানিয়াহু ট্রাম্পের এই প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় নিজেকে জড়াননি। শুধু একটি ‘নতুন পন্থায়’ চেষ্টা করার জন্য ট্রাম্পের প্রশংসা করেন। ইসরাইলি নেতা বলেন, “ট্রাম্প নতুন ধারণা নিয়ে পুরোপুরি অন্যভাবে চিন্তা করছেন। তিনি প্রচলিত চিন্তাভাবনাকে থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা প্রদর্শন করছেন।” কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, ট্রাম্প ভবিষ্যৎ আলোচনার মাত্রা ঠিক করতে কখনো কখনো বৈশ্বিক বিষয়ে একটি চরম অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। প্রথম মেয়াদেও তিনি এমন কিছু চরম বৈদেশিক নীতির কথা উচ্চারণ করেছিলেন যার অনেকগুলোই কখনোই বাস্তবায়ন করেননি। এ দিকে ট্রাম্পের প্রস্তাবে বিশ্বজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে তা তুলে ধরা হলো :
প্রশ্নের মুখে আন্তর্জাতিক আইন : ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে যে, ট্রাম্পের প্রস্তাব মার্কিন নীতির সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। তার প্রশাসন গাজার সব ফিলিস্তিনিকে স্থায়ীভাবে অন্যত্র ‘পুনর্বাসন’ করার প্রস্তাব দিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
সৌদি আরব : দেশটি বলেছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া তারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না। তারা ফিলিস্তিনিদের ভূমি থেকে জনগণকে বাস্তুচ্যুত করার যেকোনো প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ট্রাম্পের অবস্থানকে স্পষ্ট এবং আপসযোগ্য নয় বলে বর্ণনা করেছে। এতে বলা হয়, ইসরাইলি বসতি স্থাপন নীতি, ফিলিস্তিনি ভূমি সংযুক্তি বা ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ অধিকারের যেকোনো লঙ্ঘনের বিষয়ে সৌদি আরব তার পূর্বেঘোষিত অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছে।
রাশিয়া : রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অধিকৃত পশ্চিমতীরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার বিষয়ে ইসরাইলি পরিকল্পনা রয়েছে।
চীন : চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা গাজার জনগণের জোরপূর্বক স্থানান্তরের বিরোধিতা করে। চীন আশা করে, সব পক্ষ যুদ্ধবিরতি ও সংঘাত-পরবর্তী শাসনকে ফিলিস্তিনি ইস্যুকে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানে ফিরিয়ে আনার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করবে।
অস্ট্রেলিয়া : অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ বলেছেন, তার সরকার দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে, যেখানে ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনিরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারবে। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন করেছি, আমরা বন্দীদের মুক্তিতে সমর্থন করেছি এবং আমরা গাজায় ত্রাণ প্রবেশে সমর্থন করেছি। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্য নিয়ে আমি চলমান মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক পল ও’ব্রায়েন বলেছেন, গাজা থেকে সব ফিলিস্তিনিকে সরিয়ে নেয়া মানে মানুষ হিসেবে তাদের ধ্বংস করার শামিল। গাজা তাদের বাড়ি। গাজার মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ হচ্ছে ইসরাইল সরকার হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছে, যাদের বেশির ভাগই মার্কিন বোমা দিয়ে।
হামাস : ট্রাম্পের বক্তব্যের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ট্রাম্পের মন্তব্য নিয়ে হামাসের সিনিয়র নেতা ইজ্জাত আল-রেশিক বলেন, ‘গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্বাসন এবং গাজা উপত্যকার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের (ডোনাল্ড ট্রাম্প) বিবৃতিকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।’ তিনি আরো বলেন, এ ধরনের বিবৃতি ফিলিস্তিন এবং এই অঞ্চল সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও গভীর অজ্ঞতার প্রতিফলন। গাজা অবশ্যই সাধারণ কোনো ভূখণ্ড নয় এবং এটি এমন কোনো সম্পত্তি নয় যা কেনাবেচা করা যায়। এমন বিবৃতি (ট্রাম্পের মন্তব্য) প্রমাণ করে যে, ইসরাইলের প্রতি এবং আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ও তাদের ন্যায্য অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব অব্যাহত রয়েছে।
হামাসের এই সিনিয়র নেতা বলেন, আমরা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এই বিবৃতি প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাই। কারণ, এ ধরনের মন্তব্য আগুনে ঘি ঢালবে। এ ছাড়া ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য’ আরব দেশগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে ‘আরব-ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন’ আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে হামাস।
মুসলিম অ্যাডভোকেসি গ্রুপ : কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস বলেছে, গাজা ফিলিস্তিনি জনগণের, যুক্তরাষ্ট্রের নয়। যদি ফিলিস্তিনি জনগণকে কোনোভাবে গাজা থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত করা হয়, তাহলে মানবতার বিরুদ্ধে এই অপরাধ ব্যাপক সঙ্ঘাতের জন্ম দেবে, আন্তর্জাতিক আইনের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেবে এবং আমাদের জাতির আন্তর্জাতিক ইমেজ ও অবস্থানের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করে দেবে।
পিএলওর বিবৃতি : প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের মহাসচিব হুসেইন আল-শেখ বলেন, পিএলও ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত করার সব আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে। ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব তার দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করে যে, আন্তর্জাতিক বৈধতা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান হল সুরক্ষা, স্থিতিশীলতা এবং শান্তির গ্যারান্টি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা