এলএনজিতেই ভর্তুকি ১৬ হাজার কোটি টাকা
জ্বালানি নিশ্চিত না করেই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন- আশরাফুল ইসলাম
- ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদনের মাধ্যমে লাখ লাখ কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। কিন্তু চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বিলাসী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য যে জ্বালানির প্রয়োজন হবে তা নিশ্চিত করা হয়নি। এ কারণে উচ্চ দরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হচ্ছে। এ দিকে গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে চাহিদার ২৫ শতাংশ এলএনজি আমদানি করতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বছরে ভর্তুকি দিতে হবে ১৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। চাহিদার অর্ধেক এলএনজি আমদানি করতে দেশে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার জ্বালানি নিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।
স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় এলএনজি মজুদের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। দাম কম থাকার সময় বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করে মজুদ করা হবে। প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করতে ১০০ গ্যাস কুপ খনন করা হবে। পাশাপাশি সাগর বক্ষে গ্যাস ব্লকগুলোতে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা হবে। সরকারের এমন পরিকল্পনার কথা জানালেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
সরকারের পরিকল্পনার বিষয়ে জ্বালানি সচিব বলেন, গ্যাসের সঙ্কট মেটাতে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হবে। এজন্য বিপিসির মাতারবাড়ীতে একটি জায়গা আছে। সরকার তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করে বেসরকারি খাতে দেবে। তারা বোতলজাত করে বিপণন করবে। বোতলজাত করা তো সরকারের দায়িত্ব নয়। তারা আরো কম প্রাইজে দিতে পারবে। এতে পরিবহন ব্যয় কমে যাবে। কলকাতা এক কার্গো জাহাজ পরিবহনে ব্যয় হয় ৬০ ডলার। আমাদের হয় ১২০ ডলার। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমদানি করা হলো স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি। মধ্যমেয়াদি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আমাদের গ্যাস কুপগুলো খনন করা। প্রাথমিকভাবে ১০০টি কুপ খননের কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। আর দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির মধ্যে সাগর বক্ষে অগভীর ও গভীর গ্যাস ব্লক থেকে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা। এ জন্য ত্রিমাত্রিক জরিপ কার্যক্রম চালানো হবে। এর অন্যতম লক্ষ্য হলো এলএনজি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করা। কারণ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যায় এলএনজি আমদানি বাবদ। আমাদের জ্বালানি আমদানির জন্যই প্রতি সপ্তাহে ১৮ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়। বছরে ৫২ সপ্তাহে ৯৩৬ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে ৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। এটা দিন দিন বেড়েই যাবে। এ জন্য এলএনজি মজুদের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। কারণ ইউরোপে শীতকালে এলএনজির দাম বেড়ে যায়। কিন্তু গ্রীষ্মে কমে যায়। যখন দাম কমে তখন বিপুল পরিমাণ এলএনজি কিনে মজুদ করে রাখা হবে। যখন দাম বেড়ে যায় তখন মজুদকৃত গ্যাস আমরা ব্যবহার করে ব্যয় সাশ্রয় করা যাবে। কারণ আমাদের বর্তমান মজুদ সক্ষমতা এক হাজার এমএমসিএফ। এর কারণে প্রতি তিন দিন পর পর আমাদের কার্গো আনতে হয়। এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কী পরিমাণ মজুদের সক্ষমতা বাড়ানো হবে তা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে আসছে অর্ধেকের মতো। আর ২৫ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে জোগান দেয়া হচ্ছে। এতে করে ২৫ শতাংশ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আমদানির পর মিশ্রিত গ্যাসের দর পড়ছে ৩০ টাকার মতো। আর বিক্রি করা হচ্ছে ২২.৮৭ টাকা হারে। এতে করে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। যে কারণে আমরা নতুন শিল্পে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা ঘাটতি হবে বলে মনে করছে পেট্রোবাংলা। যে কারণে তারা নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভে ১৫২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।
যখন এক-চতুর্থাংশ আমদানি করতে ত্রাহী অবস্থা, সেই সময়ে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর মজুদ ফুরিয়ে আসছে, এতে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে উৎপাদন। এক সময় দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেত। ২ ফেব্রুয়ারি তা ১৯০৩ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। প্রতিদিনই কমে আসছে দেশীয় ফিল্ডের উৎপাদন।
জ্বালানি সচিব বলেন, এখন দেশে গ্যাসের সঙ্কট চলছে। আমাদের নিজস্ব উৎপাদনও কমে এসেছে। এজন্য আশু সমাধান হিসেবে ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে এলএনজি আমদানির পরিমাণ বাড়ানো হবে। তিনি জানান, গেল বছর আমরা ৮৪ কার্গো এলএনজি এনেছি। আর চলতি বছর আমরা ১১৫ কার্গো এলএনজি কেনার পরিকল্পনা করেছি। চলতি বছরে আমাদের অতিরিক্ত ১৫ হাজার চার শত কোটি টাকা লাগবে।
স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম সবসময় একই থাকে না। তাই আমরা চেষ্টা করছি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কিনতে। এর বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি কেনার চেষ্টা করেছি। কয়েকটি দেশ থেকে আমরা প্রস্তাব পেয়েছি। এর মধ্যে ব্রুনাইয়ের সাথে শিগগির আমরা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করব। এ ছাড়া আলজেরিয়া ও কাজাগিস্তানের সাথে আলোচনা চলছে।
এ সময় তিনি জানান, ভোলার গ্যাস এলএনজি আকারে মূল ভূখণ্ডে আনা হবে। তারপর তা রিগ্যাসিফিকেশন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে। এজন্য শিগগির দরপত্র আহ্বান করা হবে। তিনি বলেন, এখন যে ভোলা থেকে সিএনজি আনা হচ্ছে, তা অনেক বিপজ্জনক। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ হতে পারে।
ভোলার গ্যাস এলএনজি করে আনার পাশাপাশি পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে উল্লেখ করে জ্বালানি সচিব বলেন, ভোলা থেকে ঢাকা পর্যন্ত মোট ২০৫ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ভোলা থেকে বরিশাল ৯৬ কিলোমিটার পাইপলাইন হবে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ। আমরা শিগগিরই এই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য একনেকে পাঠাব।
ভোলায় দু’টি গ্যাসফিল্ডে মোট ৯টি কূপ খনন করা হয়েছে, যা দিয়ে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। ৯টি কূপের মধ্যে পাঁচটি এখনই গ্যাস উৎপাদনে সক্ষম যেগুলো থেকে দৈনিক ১৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া সম্ভব। গ্যাসের চাহিদা না থাকায় মাত্র ৮০ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে, আবার পাইপলাইন না থাকায় জাতীয় গ্রিডে দেয়া যাচ্ছে। অপর চারটি কূপের মধ্যে একটির পাইপলাইন এবং তিনটি কূপের প্রসেস প্লান্ট রেডি হচ্ছে। ওই এলাকায় আরো ১০টি কূপ খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, অনেকে ধারণা করেন সেখানে ১২ টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে। পাইপ লাইন করতে গেলে পাঁচ বছর লাগবে। আমরা জরুরি ভিত্তিতে এলএনজি আকারে আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। দু’টি ফিল্ডের মধ্যে একটি থেকে ৬০ মিলিয়ন, অন্যটি থেকে ২০ মিলিয়ন আনা হবে।
গ্যাসসঙ্কটের বিষয়ে জ্বালানি সচিব বলেন, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এর মধ্যে রয়েছে চুরি ও সিস্টেম লস কমিয়ে উন্নতি করা। গড়ে ১০ শতাংশের মতো সিস্টেম লস রয়েছে। কিছু কূপের সংস্কার (ওয়ার্কওভার) করে উৎপাদন বাড়ানো এবং তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোরদার করা। আমরা ১০০টি কূপ খননের প্রক্রিয়া শুরু করেছি, বাপেক্সের জন্য আরো তিনটি রিগ কেনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একটি রিগের টেন্ডার করা হয়েছে। পাশাপাশি সিসমিক সার্ভের কাজও হাতে নেয়া হয়েছে।
এলএনজি মজুদাগারের বিষয়ে জ্বালানি সচিব বলেন, আমাদের যে দু’টি এফএসআরইউ রয়েছে যার মাধ্যমে বছরে ১১৫ কার্গো এলএনজি আমদানি করা সম্ভব। আরো দু’টি এফএসআরইউ স্থাপন এবং ল্যান্ডবেজড টার্মিনাল স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। আমরা চাই দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে। না হলে এলএনজি আমদানি যত বাড়বে, গাসের দাম তত বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, চলতি বছরে ১০১ কার্গো আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ৫৬ কার্গো আসছে জিটুজি (সরকার টু সরকার) ভিত্তিতে কাতার ও ওমান থেকে। ব্রুনাই থেকে জিটুটি ভিত্তিতে বছরে ২০ কার্গো এলএনজি আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে। নাইজেরিয়া ও উজবেকিস্তান থেকে আমদানির জন্য আলোচনা চলমান রয়েছে। আমরা স্পট থেকে সরে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে পুরো এলএনজি আমদানির দিকে যাচ্ছি।
দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১০১ কার্গো আমদানি করে বিদ্যমান দরে বিক্রি করলে বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। এক কার্গো এলএনজি আমদানিতে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। যা বছরে দাঁড়াবে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী দেশে আটটি গ্রাহক শ্রেণীতে অনুমোদিত লোডের পরিমাণ রয়েছে ৫ হাজার ৩৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট (দৈনিক)। এর বিপরীতে চাহিদা ধারণা করা হয় ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হচ্ছে, আর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ১ হাজার ২০০ মিলিয়নের মতো।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড থেকে ১ টাকা দরে, বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি থেকে ১.২৫ টাকা দরে, বাপেক্স থেকে ৪ টাকা দরে প্রতি ঘনফুট গ্যাস কেনা হয়। এরপর বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ও টাল্লোর কাছ থেকে কেনা গ্যাসের সংমিশ্রণে গড় দর দাঁড়ায় ৬.০৭ টাকা ঘনমিটার। আর প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫.৭০ টাকা (আগস্ট ২০২৪)। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৫.৭২ টাকা। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের প্রাইস গ্যাপ কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা ঘাটতি হবে বলে মনে করছে পেট্রোবাংলা। যে কারণে তারা নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভে ১৫২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা