আবশ্যিক হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা
কলেজ মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন- শাহেদ মতিউর রহমান
- ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
যুগের চাহিদা ও বেকারত্বের হার বিবেচনায় দেশের শিক্ষা কাঠামোতে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কারিগরি শিক্ষাকে। কোর্স কারিকুলামও প্রস্তুত হচ্ছে সেভাবেই। সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের ১০২তম সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের বহুমুখী ও যুগোপযোগী কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে স্নাতক (পাস) ও স্নাতক (সম্মান) কোর্সের সাথে কারিগরি শিক্ষাকার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মাদরাসাগুলোতেও আরবি ভাষা শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে সাজানো হচ্ছে কারিকুলাম। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামীতে আর শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি না করে বরং দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষা কাঠামোতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
এ দিকে গত কয়েক বছরে দেশে উচ্চ শিক্ষার হার বাড়লেও সমানতালে বেড়েছে বেকারত্ব। ফলে দেশে এখন শিক্ষিত বেকারের হার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি বেড়েছে। অন্য দিকে দেশ থেকে প্রতি বছর বড় সংখ্যার কর্মী বিদেশে গেলেও সেখানে দক্ষ কর্মীর সঙ্কট থাকায় আশানুরূপ অর্থ আয় করতে পারছে না দেশ। ফলে বিদেশে দক্ষ কর্মী বাহিনী প্রেরণের বিষয়েও উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
অবশ্য কারিগরি শিক্ষাকে আগামী দিনের উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করে একে আধুনিক, যুগোপযোগী এবং বাজারের সাথে সামঞ্জস্য করতে সুপারিশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বহু ধরনের সংস্কারের কথা এসেছে। কিন্তু আমি অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের কাছে কারিগরি শিক্ষার আধুনিকায়নের জন্য একটি কমিটি গঠনের আহ্বান জানাচ্ছি। যেটি দুই-তিন মাসের মধ্যে সুপারিশ ঠিক করবে এবং আগামী জাতীয় বাজেটেই যাতে সুপারিশ বাস্তবায়নের বরাদ্দ রাখা যায়। ড. দেবপ্রিয় আরো বলেন, কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি করতে না পারলে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আবার এই শিক্ষা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নও যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারবে না। কারিগরি শিক্ষাকে মূল ধারার শিক্ষার সাথে যুক্ত করতে হবে। কেননা চলমান গৎবাঁধা শিক্ষা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে না।
সম্প্র্রতি সিপিডি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইদানীং বেশ কিছু সেক্টরেই কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ফলে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা অর্জনকারীদের মধ্যে বেকার সংখ্যাও কমছে। ২০১০ সালে এ ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ছিল ৭ শতাংশ। ২০২২ সালে এসে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশে। তবে এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রাংশ শতভাগ নেই। যেগুলো আছে সব ক্ষেত্রে ব্যবহার দেখানো হয় না এবং অকেজো হলে নবায়ন হয় না। ল্যাবের সংখ্যা অপ্রতুল এবং কারিগরি শিক্ষাদানে যে ল্যাবগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা হয় না। কম্পিউটার ল্যাবে বেশির ভাগ কম্পিউটার নষ্ট পড়ে থাকে। ন্যূনতম উপস্থিতি বিষয়ে বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে আসে না। আবার এদের অনেকে নিম্ন আয়ের ও পাশাপাশি চাকরি করে বলে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও কিছুই বলেন না। কিছু কিছু জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট না থাকায় স্থানীয় যুব নারী-পুরুষ কারিগরি বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। টেকনিক্যাল স্কুল-কলেজগুলোর যে মেয়াদে শিক্ষাকার্যক্রম চলে সেখান থেকে সার্বিক জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ না থাকায় অসাধু পেশাদার শিক্ষার্থী, যারা ভাতার জন্য ততধিক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত হয়, তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষাকার্যক্রম ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় মানুষের, বিশেষ করে অভিভাবকদের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত থাকায় এ ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সচিব রহুল আমিন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, কর্মসংস্থান আমাদের সবচেয়ে বড় ইস্যু। প্রত্যেকের আগ্রহ বাড়াতে হবে। অনেক ট্রেনিংয়ে শিক্ষার্থী নেই। শিক্ষার্থী থাকলেও তাদের সিরিয়াসনেস বাড়াতে হবে। কেননা বর্তমানে টেকনোলজি এত দ্রুত চেঞ্জ হচ্ছে, যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ফলে পরিবর্তনের সাথে সাথে কারিকুলামও পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে যারা প্রশিক্ষণ নেবেন তাদেরও আগ্রহ যেমন দরকার, আবার যারা প্রশিক্ষণ দেবেন তাদেরও আগ্রহ থাকতে হবে। তবে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে বলেও জানান তিনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, কারিগরি শিক্ষা নিয়ে আমরা নতুন করে কিছু উদ্যোগ নেয়ার কথা ভাবছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি কারিগরি শিক্ষাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। কারিগরি শিক্ষা ছাড়া দেশের এত বেশি বেকারত্ব দূর করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গ্রামগঞ্জে অনার্স-মাস্টার্স দেয়া হলেও এটা সার্বিকভাবে কিছু বেকার সৃষ্টি করছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের অনেক প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার মানও সন্তোষজনক নয়। ফলে তারা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে না ফিরে যেতে পারছে তাদের বাবার পেশায়, না পাচ্ছে কোনো চাকরি। ফলে বেকার সৃষ্টি হচ্ছে। এখানে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। যদিও কারিগরি শিক্ষা নিয়ে কিছুটা নেতিবাচক ধারণা আছে। আমাদের সেগুলো দূর করতে হবে। যখন দেখবে কলেজে অনার্স পড়ার চেয়ে কারিগরিতে পড়লে একটা কর্মসংস্থান হবে তখন কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহী হবে। এজন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন। এখানে এক বছর করে কারিগরি প্রযুক্তি শিক্ষা দিতে চাই। এটা নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভিসিসহ অন্যদের সাথে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। কিভাবে এটা প্রয়োগ করা যায় এটা নিয়ে চিন্তা করছি। শিগগিরই আমরা এই বিষয়টি নিয়ে বসব। কারণ এখানে এক বছরের একটি কোর্সের একটা সার্টিফিকেট নিয়ে বিদেশে গিয়ে অনেকে ভালো চাকরি পেতে পারে। দেশে ভালো কিছু করতে পারে, দক্ষতা অর্জন করে। সেই উদ্যোগটাই নেয়া হবে।
সূত্র আরো জানায়, শিল্পোন্নত দেশগুলোয় দক্ষ ও অতি দক্ষ জনসংখ্যা ৬০ শতাংশের কাছাকাছি থাকে। জার্মানিতে প্রায় ৭৩ শতাংশ জনসংখ্যা দক্ষ। জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০, মালয়েশিয়ায় প্রায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি মাধ্যমে অধ্যয়ন করে। বিপরীতে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে স্বল্পদক্ষ ও দক্ষ জনশক্তি ৩৮ শতাংশ বলা হলেও কারিগরিভাবে দক্ষ, মধ্যমানের দক্ষ কিংবা স্বল্পদক্ষ জনশক্তি মাত্র ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭ হাজার ৮১৯টি (ব্যানবেইস ২০২২)। গত দুই বছরে হয়তো আরো কিছু বেড়েছে, তবে জনসংখ্যা ও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যানুযায়ী এই পরিমাণ নিতান্তই কম।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা