আখেরি মুনাজাতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা
- মোহাম্মদ আলী ঝিলন (গাজীপুর) ও মো: আজিজুল হক টঙ্গী ইজতেমা ময়দান থেকে
- ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৪
টঙ্গীর তুরাগতীরে মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপ গতকাল রোববার সকালে আখেরি মুনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। সকাল ৯টা ১১ মিনিটে আখেরি মুনাজাত শুরু হয়ে ৯টা ৩৫ মিনিটে শেষ হয়। আখেরি মুনাজাত পরিচালনা করেন বাংলাদেশ তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি মাওলানা জুবায়ের আহমেদ। মুনাজাতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর হেদায়েত, হেফাজত, ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি ও নাজাত এবং দ্বীনের দাওয়াত সর্বত্র পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়। এ ছাড়াও সব ধরনের গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। আখেরি মুনাজাত চলাকালে আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে টঙ্গীর তুরাগতীর ও ইজতেমা ময়দানের আশপাশ বিস্তীর্ণ এলাকা।
আখেরি মুনাজাতে নিজের আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার জন্য দুই হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে কান্নায় ভেঙে পড়েন লাখো মুসল্লি। ২৪ মিনিট স্থায়ী এই মুনাজাতে দুই হাত ওপরে তুলে লাখ লাখ মুসল্লি বারবার বলছিলেন, ‘আমিন, আমিন’। মুনাজাতের সময় পুরো এলাকা বারবার ‘আমিন, আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। মুনাজাতে বিশাল এ জনসমুদ্রে হঠাৎ নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। কান্নায় বুক ভাসান তারা। প্রথম ২১ মিনিটব্যাপী মুনাজাতে মাওলানা জুবায়ের পবিত্র কুরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন। পরে ১২ মিনিট বাংলা ভাষায় মুনাজাত করেন।
এদিন আখেরি মুনাজাত উপলক্ষে টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, মার্কেট, বিপণিবিতান, অফিসসহ সবকিছু ছিল বন্ধ। সোমবার থেকে শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমা। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাদ অনুসারীদের দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এর আগে আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে রোববার ভোর রাত থেকেই টঙ্গীর ইজতেমা অভিমুখে শুরু হয় বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো মানুষের ঢল। টঙ্গীর পথে শনিবার মধ্যরাত থেকেই ইজতেমা ময়দানগামী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোটরগাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুনাজাতে অংশ নিতে চার দিক থেকে লাখ লাখ মুসল্লি পায়ে হেঁটেই ইজতেমাস্থলে পৌঁছেন। মুনাজাতের আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হওয়ায় মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলি-গলিতে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছুতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মুনাজাতের জন্য পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বাসাবাড়ি-কলকারখানা-অফিস-দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগনদীতে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেন। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ আর মানুষ। ইজতেমাস্থলের চারপাশের ৪-৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আখেরি মুনাজাতের জন্য রোববার আশপাশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস ও প্রতিষ্ঠান ছিল ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মুনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মুনাজাতে অংশ নিতে রোববার সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছেন।
শেষ দিনে বয়ানকারী : প্রথম পর্বের শূরায়ি নেজামের ইজতেমা আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান, রোববার বাদ ফজর ভারতের মাওলানা আবদুুর রহমানের হেদায়েতি বয়ানে ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। যারা এখান থেকে চিল্লা, তিন চিল্লার জন্য জামাতে বের হবেন, তারা জামাতে গিয়ে কী আমল করবে এবং মহল্লায় যারা এখান থেকে ফিরে যাচ্ছেন তারা নিজ এলাকায় গিয়ে কী আমল করবে তার দিকনির্দেশনামূলক বয়ান করা হয়। মাওলানা আব্দুল মতিন তাৎক্ষণিকভাবে তা বাংলায় অনুবাদ করেন। এর পরেই ভারতের মাওলানা ইবরাহিম দেওলা নসিহতমূলক কথা বলেন এবং তা বাংলায় অনুবাদ করেন মাওলানা জুবায়ের। এ সময় ইজতেমাস্থলে আগতরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সেসব বয়ান শুনেন।
মুনাজাতে বলা হয় : মাওলানা জুবায়ের মুনাজাতে বলেন, ‘হে আল্লাহ আমাদের ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সব গুনাহ মাফ করে দেন। গোপন গুনাহ, প্রকাশ্য গুনাহ সব গুনাহ মাফ করে দেন। এ বিশাল ময়দানে যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের মধ্য থেকে যার হাতকে আপনার পছন্দ হয় তার উছিলায় আমাদের সবার মুনাজাত কবুল করে নেন। আজ আমরা তওবা করছি, সব রকম গুনাহ থেকে বেঁচে থাকব। আমাদের জিন্দেগি গুনাহমুক্ত হওয়ার তাওফিক দিন। দুনিয়ার সব নর-নারীর জীবনের গুনাহ মাফ করে দেন। হে আল্লাহ ঈমানের হাকিকতে তামাম নসিব করে দেন। হে আল্লাহ ঈমানি সিফাত আমাদের মধ্যে পয়দা করে দেন। হে আল্লাহ আমাদের ঈমানি জিন্দেগি নসিব করে দেন। হে আল্লাহ আমাদের আমানি হাওয়া চালিয়ে দেন। হে আল্লাহ ঈমানকে শক্তিশালী করে দেন।’
ড্রোন আতঙ্কে ছোটাছুটি : ৪০ মুসল্লি আহত : গাজীপুরের টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ড্রোন আতঙ্কে মুসল্লিদের ছোটাছুটিতে প্রায় ৪০ জন আহত হয়েছেন। রোববার বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মুনাজাত চলার সময় সকাল ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে ইজতেমা ময়দানের ২ নম্বর গেটের সামনে মুনাজাতের চিত্র ধারণ কাজে ব্যবহৃত একটি ড্রোন মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় বিকট শব্দে মুসল্লিরা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন। এই ছোটাছুটিতে প্রায় ৪০ জন মুসল্লি আহত হলে তাদের টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: ফরিদুল ইসলাম বলেন, একটি ড্রোন আকাশে উড়ছিল সম্ভবত ড্রোনটির চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেটি ২ নম্বর গেটের একটু সামনে এলাকায় আছড়ে পড়ে। মুসল্লিরা অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ ব্যাপারে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন বলেন, গুজবের উৎস্য আমরা অনুসন্ধান করে দেখছি। তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন ইজতেমার শামিয়ানার ওপর ড্রোন পড়ে আওয়াজ হয়েছে, কেউ কেউ বলছেন দুই ড্রোনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে, আবার কেউ বলছেন বেলুন বিক্রেতার বেলুনের সাথে ড্রোন লেগে বেলুন বিস্ফোরিত হয়েছে।’ তবে ইজতেমার নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ইউনিটের ড্রোনে সমস্যা হয়নি বলেও জানান তিনি।
প্রথম পর্বে ৫ মুসল্লির মৃত্যু : বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে আরো এক মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে প্রথম পর্বে পাঁচ মুসল্লি ইন্তেকাল করেছেন। সর্বশেষ গত শনিবার সন্ধ্যায় মারা যান হাজী আব্দুল গফুর (৭৫)। তার বাড়ি ভোলা জেলার চরফ্যাসনে। এর আগে মারা যান হবিগঞ্জ জেলা সদরের ৩ নম্বর তেঘরিয়া ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের রমিজ আলী (৬০), হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানার রাঘবপুর গ্রামের ইয়াকুব আলী (৬০), খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার ডুমুরিয়া বাজার গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস গাজী (৬০) ও শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানার রানী শিমুল গ্রামের সাবেদ আলী (৭০) মারা যান। এ নিয়ে ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে মোট পাঁচ মুসল্লির মৃত্যু হলো। তাবলিগ জামাত বাংলাদেশের শূরায়ি নেজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মুনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ : আখেরি মুনাজাতে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বিপুলসংখ্যক নারী। ইজতেমায় নারীদের অংশ নেয়ার বিধান না থাকলেও এসব নারীদের অধিকাংশই আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে আগের দিন রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশপাশ, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসাবাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে অবস্থান নেন। এ ছাড়াও ভোর থেকে নারীরা ইজতেমা ময়দান সংলগ্ন শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের মাঠ, ইজতেমা মাঠের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ও আশপাশের খোলা ময়দানে অবস্থান নেন। তারা নিজ নিজ অবস্থানে বসে আখেরি মুনাজাতে অংশ নেন।
আখেরিতে মুনাজাতে টঙ্গী জনসমুদ্র : তাবলিগ জামাতের চলমান বিরোধে কোনো প্রভাব পড়েনি টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায়। গতকাল আখেরি মুনাজাতকে কেন্দ্র করে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল টঙ্গী ও উত্তরাসহ ইজতেমা ময়দানের আশপাশ এলাকা। এটি ছিল ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব।
টঙ্গীর সব কারখানায় ছুটি : বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মুনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর ও টঙ্গীর সব কারখানায় ছুটি ছিল। ফলে এবার এসব কারখানার শ্রমিকদের ইজতেমায় আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে সমস্যা হয়নি।
উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালে প্রথম কাকরাইল মসজিদে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে ও ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বর্তমানস্থলে স্থানান্তর করা হয় ইজতেমা। পরে সরকারিভাবে ১৯৭২ সালে তুরাগতীরের ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা