০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১, ২ শাবান ১৪৪৬
`
বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা

একুশের চেতনাই জুলাই বিপ্লবে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে

-


একুশ আমাদের পথ দেখায়। একুশ আমাদের জাগিয়ে তোলে। ২১ আমাদের মানসকে এভাবেই তৈরি করে দিয়েছে। একুশ জাতিকে এক ঐতিহাসিক গভীরতায় ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছে। মাত্র ছয় মাস আগে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানই তার উদাহরণ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবারের বইমেলায় নতুন তাৎপর্য নিয়ে এসেছে। গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা-২০২৫-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘বরকত, সালাম, রফিক, জাব্বারের বুকের রক্তে যে অঙ্গীকার মাখা ছিল তাতে ছিল জুলাই অভ্যুত্থানকে নিশ্চিত করার মহা বিস্ফোরক শক্তি। অর্ধ শতাব্দী পর এই মহবিস্ফোরণ গণ-অভ্যুত্থান হয়ে দেশ পাল্টে দিলো। এই বিস্ফোরণ আমাদের মধ্যে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় গ্রোথিত করে দিয়ে গেল। ১৭ কোটি মানুষের প্রতিজনের সত্তায় এই প্রত্যয় গভীরভাবে গ্রোথিত। অমর একুশের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা এই প্রত্যয়ে শপথ নিতে এসেছি।’

ড. ইউনূস বলেন, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার ইস্পাত কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছে। তাই মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত অভ্যুত্থান এবারের বইমেলায় নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে।
‘জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং তার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী এ বইমেলা চলবে। প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা এবং সরকারি ছুটির দিনে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা উন্মুক্ত থাকবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতির ঘাড়ে ১৬ বছর ধরে চেপে থাকা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। আমাদের সাহসী তরুণদের এই অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। আমি আজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে উপস্থিত সবাইকে সাথে নিয়ে স্মরণ করছি ছাত্রদের নেতৃত্বে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে যে সব দুঃসাহসী ছাত্র-জনতা-শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন এবং নির্মমভাবে আহত হয়েছেন তাদের সবাইকে।

তিনি বলেন, এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং তার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের বিনির্মাণ। বরাবরই একুশে মানে জেগে ওঠা। একুশে মানে আত্মপরিচয়ের সাথে মুখোমুখি হওয়া। একুশে মানে অবিরাম সংগ্রাম। নিজের পরিধিকে আরো অনেক বাড়িয়ে নেয়া। এবারের একুশের পরিপ্রেক্ষিত আমাদেরকে নতুন দিগন্তে প্রতিস্থাপন করেছে।’ তিনি বলেন, ‘একুশ আমাদের মূল সত্তার পরিচয়। একুশ আমাদের ঐক্যের দৃঢ় বন্ধন। এই বন্ধন ছোট-বড়, যৌক্তিক-অযৌক্তিক, ক্ষণস্থায়ী-দীর্ঘস্থায়ী সকল দূরত্বের ঊর্ধ্বে। এজন্য সকল প্রকার জাতীয় উৎসবে, সঙ্কটে, দুর্যোগে আমরা শহীদ মিনারে ছুটে যাই। সেখানে আমরা স্বস্তি পাই, শান্তি পাই, সমাধান পাই। সাময়িকভাবে অদৃশ্য ঐক্যকে আবার খুঁজে পাই। ২১ আমাদের মানসকে এভাবে তৈরি করে দিয়েছে। একুশ আমাদের পথ দেখায়। একুশ আমাদের জাগিয়ে তোলে। মাত্র ছয় মাস আগে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান জাতিকে এক ঐতিহাসিক গভীরতায় ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে আমরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও মানবিক দিক থেকে বিধ্বস্ত এক দেশকে দ্রুততম গতিতে আবার উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহস খুঁজে পেয়েছি।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘একুশের টান বয়সের ঊর্ধ্বে। প্রজন্মের ঊর্ধ্বে। একুশের টান প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিস্তৃত হয়েছে শুধু তা-ই নয়, এই-টান গভীরতর হয়েছে। আমাদের দুঃসাহসী করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশকে ছাত্র-জনতা নতুন বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। আমাদের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে তাদের স্বপ্নগুলো, তাদের আকাক্সক্ষাগুলো, তাদের দাবিগুলো অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় এঁকে দিয়েছে। আমাদের রাস্তার দেয়াল এখন ঐতিহাসিক দলিলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এগুলির স্থান এখন আমাদের বুকের মধ্যে এবং জাদুঘরে হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।’

বইমেলার উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, তারা এই দেয়ালচিত্রগুলো মেলায় আসা ও যাওয়ার পথে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ক্রমে ক্রমে এর গুণগত ও আয়োজনগত বিবর্তন হতেই থাকবে। বইমেলায় হাজির করার জন্য লেখক-লেখিকারা সারা বছর প্রস্তুতি নিতে থাকেন যথাসময়ে নিজ নিজ বই সমাপ্ত করার জন্য। প্রকাশকরা অনেক আয়োজন করেন নিজেদের বইগুলো যথাসময়ে হাজির করার জন্য, গুণগত প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার জন্য এবং আগ্রহ বাড়ানোর জন্য। প্রতি বছর বিষয়ভিত্তিক ‘সেরা লেখক’ স্বীকৃতির আয়োজন করলে লেখকরা এই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এবং সেরা লেখকরা সেরা প্রকাশক পাওয়ার জন্য অনেক সহায়ক হবে। আমি এই প্রস্তাব দিচ্ছি। আমরা যদি একুশের ভাষা আন্দোলনকে আরো গভীরতর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধিকার আন্দোলন হিসেবেও দেখি তাহলে অমর একুশের গণ্ডি বৃহত্তর হয়ে দাঁড়ায়। তখন আমরা ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরী, তরুণ- তরুণীদের তাদের সৃজনশীলতার জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি, নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি। শহর ও গ্রামের নারী পুরুষকে কৃষি, শিল্প, সাংস্কৃতিক জগৎ, বিজ্ঞান, বাণিজ্য শিক্ষায় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যারা নির্দিষ্ট বছরে জাতির জন্য অবদান রেখেছেন তাদের স্বীকৃতি দিতে পারি, তাদের জন্য আনুষ্ঠানিক আয়োজন করে দিতে পারি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীদের, প্রবাসী শ্রমিকদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি। পৃথিবীজুড়ে নানা কাজে বাংলাদেশীরা কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। আমরা একুশের দিনে তাদের সবাইকে স্মরণ করতে চাই। তারা সবাই একুশের দিনে নিজের দেশকে স্মরণ করে অনুষ্ঠান করে। তারা আমাদের পরিবারের অংশ হিসেবে তাদের সন্তান-সন্ততির কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আমার সব কথা আপনাদের গ্রহণ করতে হবে এমন চিন্তা করছি না। তবে নিজের বলার সুযোগ যখন পেয়েছি তখন বলে রাখলাম।
তরুণরা পুরো বিশ্বকে বদলে দিতে পারে : এ দিকে এর আগে গতকাল ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ৯ম সোস্যাল বিজনেস ইয়ুথ সামিটে দেয়া বক্তব্যে তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা (তরুণরা) কেবল কয়েক বছরের মধ্যে পুরো বিশ্বকে বদলে দিতে পারি। এই কক্ষে যারা বসে আছেন, তাদের দিয়েই এটি সম্ভব। এটি খুব সহজ একটি কাজ।’ সামিটে ২৫টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘হাজার মাইলের যাত্রা শুরু হয় প্রথম ধাপ দিয়ে, কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো দ্বিতীয় ধাপে কিভাবে আরো উন্নতি করা যায়।’
জুলাই বিপ্লবের সময় ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘একটি ফ্যাসিবাদী শাসনকে উৎখাত করতে এক হাজারেরও বেশি তরুণ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে, আর আহতদের অনেকে হাত-পা হারিয়েছে, শুধু একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তাদের এই আত্মত্যাগ ।’

জুলাই বিপ্লবকে ঐতিহাসিক আন্দোলন আখ্যা দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘আজ পুরো দেশই এক ধরনের জাদুঘরে পরিণত হয়েছে এবং জাতি তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
তরুণদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে তিনি বিশ্বের ২৫টি দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের স্বাগত জানান।
মাইক্রোক্রেডিট থেকে সামাজিক ব্যবসা : ক্ষুদ্রঋণের যাত্রার কথা স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ডায়রিয়ার প্রকোপের সময় আমরা ওরাল স্যালাইন তৈরির একটি সহজ ফর্মুলা তৈরি করি এবং মানুষকে এটি তৈরি করার উপায় জানাই, যাতে এই মহামারী প্রতিরোধ করা যায়।’ তিনি আরো বলেন, সামাজিক ব্যবসা খুবই সহজ ধারণা। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ব্যবসা মানে শুধু লাভ বৃদ্ধি করা নয়; আরেক ধরনের ব্যবসা হতে পারে-এমন একটি ব্যবসা যা সামাজিক সমস্যার সমাধান করবে,’ যোগ করেন তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, ‘টাকা উপার্জন করা হয়তো আনন্দের, কিন্তু অন্যকে খুশি করা হলো পরম আনন্দের। আর সে কারণেই সামাজিক ব্যবসার ধারণা এসেছে।’

স্বাস্থ্য খাতে সামাজিক ব্যবসার গুরুত্ব : স্বাস্থ্য খাতকে সামাজিক ব্যবসার একটি বৃহৎ ক্ষেত্র উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প একটি সামাজিক ব্যবসা হওয়া উচিত, কারণ এটি মানুষের জীবনের সাথে জড়িত।’ তিনি সবাইকে তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে সামাজিক ব্যবসার ধারণা অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মানুষ এটি করবে, কারণ অন্যের সমস্যা সমাধান করাই পরম আনন্দের উৎস।’
চ্যারিটি বনাম সামাজিক ব্যবসা : তরুণদের সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘দাতব্য কার্যক্রমের একটি মাত্র জীবনচক্র থাকে, কিন্তু সামাজিক ব্যবসার জীবনচক্র অন্তহীন। এক হলো- সমস্যার সমাধান করা যায়, কিন্তু টাকা বারবার আবারো ঘুরে আসতে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যেমন নতুন বাংলাদেশ গড়ছি, তেমনি আমরা একটি নতুন বিশ্ব গড়ারও প্রতিশ্রুতি নিচ্ছি।’

 


আরো সংবাদ



premium cement
৮ মেগা প্রকল্পের ৭৫২ কোটি ডলার লোপাট! সাঈদীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে নির্দেশনা দিয়েছিল ভারতের ‘র’! একুশের চেতনাই জুলাই বিপ্লবে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে রাজউকের নিম্নবিত্ত আবাসনের ১০১১ একর ভূমির বেশির ভাগই বেদখলে স্বৈরাচারের মাথা পালালেও কিছু অবশিষ্ট রয়ে গেছে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে নিষ্ক্রীয় করার চেষ্টা চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি দখলদারিত্বে জামায়াত কোথাও জড়িত নয় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধে বেশি ভুগবে ইউক্রেন ও ইসরাইল বাংলাদেশ কুড়িতম লিবিয়া উপকূলে ভেসে আসছে লাশ, ২০ বাংলাদেশী নিহত লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমাতে সংস্কারের পরামর্শ টাস্কফোর্সের ভাষা আন্দোলনের ঘোষণাপত্র প্রকাশ

সকল