বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে নিষ্ক্রীয় করার চেষ্টা
- অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
- ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৪
- সরিয়ে দেয়া হলো উপ-প্রধান এ কে এম এহসানকে
- আওয়ামী লীগ আমলের উপ-প্রধানকে করা হয়েছে বিএফআইইউ প্রধান
- মাসুদ বিশ্বাসের সহযোগীদের পুনর্বহাল শুরু
দেশ থেকে অর্থ পাচারকারীদের পাকড়াও করতে সক্রিয় বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বা বিএফআইইউকে হঠাৎ করে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে এস আলমসহ প্রধান ১০টি বড় অর্থপাচারকারী গ্রুপকে আইনের আওতায় আনার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হলেও হঠাৎ এ বিভাগের প্রধান করা হয়েছে আওয়ামী আমলের উপপ্রধানকে। শুধু তাই নয়, এ বিভাগকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করতে ৫ আগস্টের পর সক্রিয় উপ প্রধান এ কে এম এহসানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তার স্থলে বসানো হয়েছে এ বিভাগে অতীতে কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই এমন এক কর্মকর্তাকে। পাশাপাশি প্রতি বছর দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচারের সহযোগী হিসেবে গ্রেফতারকৃত বিএফআইইউ সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের অন্য সহযোগীদেরকেও এ বিভাগের পদায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে দেশ থেকে গত দেড় দশকে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বহু ছাত্র জনতার রক্তের বিনিময়ে বিতাড়িত আওয়ামী লীগের দোসরা আবারো পুনর্বাসন হবে।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনেও বলা হয়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশ থেকে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন ডলার করে পাচার হয়েছে। কিন্তু দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ওই সময়ের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বরং কিছু কর্মকর্তা অর্থপাচারকারীদের সাথে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছিলেন। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যান। সেই সাথে সরিয়ে দেয়া হয় এস আলমসহ পাচারকারীদের সহযোগী বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসকে। ডেপুটি হেড ছিলেন মাসুদের বিশ্বাসের আরেক সহযোগী। কিন্তু নানাভাবে পাচারকারীদের সহযোগিতার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এমনি পরিস্থিতিতে মাসুদ বিশ্বাসের আমলে ডেপুটি হেডকে সরিয়ে দিয়ে নতুন ডেপুটি হেড হিসেবে বসানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসানকে। তার নেতৃত্বে বিএফআইইউতে গতিশীলতা ফিরে আসে। পাচারকারীদের মসনদ তছনছ করার মিশনে নামেন তিনি। দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম, পতিত প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সামিট গ্রুপসহ বড় ১০টি গ্রুপের অর্থ পাচারের তথ্য উদঘাটন, পাচারকৃত অর্থের গন্তব্য বের করার উদ্যোগ নেন তিনি। দেশ বিদেশ থেকে অনেক গোয়েন্দা সংস্থাকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা হয়। ফলে একের পর এক বের হতে থাকে অর্থ পাচারের চিত্র। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহেনাসহ শেখ পরিবারের সব সদস্যকে এ তদন্তের আওতায় আনা হয়। এমনি পরিস্থিতিতে অর্থ পাচারের তথ্য উৎঘাটনের কার্যক্রম থামানোর জন্য পতিত আওয়ামী লীগের দোসররা উঠে পড়ে লাগে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে এস আলমসহ ব্যাংক লুটেরাদের সহযোগী ও আওয়ামী লীগের দোসর কিছু কর্মকর্তা। বিএফআইইউ প্রধানের নিয়োগ পরীক্ষায় ভালো না করলেও নানা কৌশলে নিয়োগ পেয়ে যান সাবেক বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের আমলে উপ প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে, শাহীনুল ইসলামের আগেও আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম ও জাহাঙ্গীর কবির নানককে দিয়ে ৫ আগস্টের আগে ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য তদবির করেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অনেকটা একই ধরনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পূর্ববর্তী প্রধান কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে। যার ফলে সকল আইন-কানুন উপেক্ষা করে বিএফআইইউ প্রধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয় এস আলমের একান্ত ঘনিষ্ঠ মাসুদ বিশ্বাসকে। ফলাফল যা হওয়ার তাই, এস আলমসহ সব দোসরকে অর্থ পাচারে সহায়তার পাশাপাশি নিজেকেও জড়ান দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মে। আর পাচার প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা বিএফআইইউকে সম্পূর্ণ অকার্যকর সংস্থায় পরিণত করেন ওই কর্মকর্তা। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠায় বর্তমান তিনি জেলে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের বিএফআইইউর উপপ্রধান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম শাহীনুল ইসলামকে সংস্থাটির প্রধান করার পর থেকেই বিএফআইইউ কার্যক্রমের গতি শ্লথ হয়ে এসেছে। যদিও এই কর্মকর্তার সংস্থাটির অপারেশন লেভেলের কাজ করার কোনো অভিজ্ঞাতা নেই। মাত্র আট মাস বিএফআইইউতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। তবুও তাকে বিভিন্ন গ্রুপের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগদান করা হয়।
বিএফআইইউর কর্মকর্তারা জানান, ‘নতুন হেড যোগদানের পর থেকেই কার্যক্রম থেমে গেছে। এরইমধ্যে একটি মিটিংয়ে তিনি কোনো সংস্থা তথ্য চাইলে সেটা নিয়ে কাজ করতে বলেছেন। নিজেদের উদ্যোগে কাজ না করার নির্দেশনা দেন তিনি। এ ছাড়া নাফিজ শরাফাতের ইন্টেলেজেন্সি রিপোর্ট দিতে তিনি গড়িমসি করছেন।’
এ দিকে গত মঙ্গলবার বিএফআইইউর ডেপুটি হেডের দায়িত্ব থেকে এ কে এম এহসানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তার স্থানে পদায়ন করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাওসার মতিনকে। যার আগে বিএফআইইউতে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। হঠাৎ কার স্বার্থে তাকে সরানো হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। অভিযোগ আছে এসব অনুসন্ধান কার্যক্রম থামানোর জন্য একটি মহল চক্রান্ত করে তাকে সরিয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, এটা অফিসের প্রয়োজনে করা হয়েছে। আর যেসব গ্রুপ নিয়ে কাজ চলমান তা চলবে। অন্য কোনো কারণে এটি করা হয়নি। এটা রুটিন ওয়ার্ক। আর ওনার চাকরির সময়ও বেশি নেই। যাকে দেয়া হয়েছে তার সময় বেশি রয়েছে। যদিও রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক অনেকের দায়িত্বে পরিবর্তন আনা হয়নি। এর মধ্যে রয়েছেন নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম ও মো: মেজবাউল হক। এখানে সাইফুল ইসলামের চাকরি রয়েছে মাত্র দুই মাসের মতো। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন। তার দায়িত্বে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এ ছাড়া মেজবাউল হক রিজার্ভ চুরিতে জড়িত থাকার দায়ে দেশ থেকে নিষেধজ্ঞা পেয়েছেন তাকে দেয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগ।
কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান প্রধান ও উপপ্রধানের বিএফআইইউতে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। যেখানে সদ্য বিদায় নেয়া ডেপুটি হেডের ৮ বছর অভিজ্ঞতা ছিল। ৫ আগস্টের পর বিএফআইইউর কাজের যে গতি ছিল তা এখন স্থবির হয়ে পড়ছে। যা দেশের স্বার্থের জন্য খুবই ক্ষতিকর। সার্বিক পরিস্থিতিতে বিএফআইইউর কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করেছে। এরইমধ্যে ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন গ্রুপের অনিয়মের বিরুদ্ধে যারা কাজ করেছে, তাদের কয়েকজনকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার তাদের স্থলে মাসুদ বিশ্বাসের সহযোগীদের বহাল করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ২৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এইচআরডির দায়িত্ব পান বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নর মো: জাকির হোসেন চৌধুরী। এরপর ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং অ্যাকাডেমি (বিবিটিএ) থেকে বিএফআইইউতে বহাল করা হয় যুগ্ম-পরিচালক মো: রোকন-উজ-জামানকে। যিনি মাসুদ বিশ্বাসের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। এরইমধ্যে বিএফআইইউ মাসুদ বিশ্বাসকে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তার অন্যতম সহযোগী রোকন-উজ-জামানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং বিএফআইইউতে তাকে পদায়ন করা হয়। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটির দুইজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হলেও তাকে পদায়ন করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার কোটাবিরোধী আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান দেশ ছেড়ে পালালেও তার সহযোগীদের তৎপরতা থেমে নেই। আর এই কুচক্রীদের এখন প্রধান লক্ষ্য হয়েছে পাচার প্রতিরোধে নিয়োজিত আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা তথা বিএফআইউ। বিধি মোতাবেক এর প্রধান কর্মকর্তা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় মেধাভিত্তিতে নিয়োগ হওয়ার কথা থাকলেও লোক দেখানো বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে ফ্যাসিস্ট আমলে পাচারে জড়িত আমলা ব্যবসায়ী চক্র। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ও বর্তমানে কারাগারে অবস্থানকারী সাবেক বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের অন্যতম সহযোগী রোকন উজ জামানকে আবারো বহাল করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে বহাল ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী। এ ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে বিএনপি সমর্থিত সবুজ দলের আপত্তিও উপেক্ষা করেন। মাসুদ বিশ্বাসের অন্য সহযোগীদেরও বিএফআইইউতে বহালের তৎপরতা শুরু হয়েছে এই ডেপুটি গভর্নরের কারণে। লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রত্যয় নিয়ে যে ২৪ গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল বিএফআইউকে ক্রমাগত দুর্বল করার মধ্য দিয়ে সে আশা আজ গুড়েবালি হওয়ার পথে। মাসুদ বিশ্বাসের সহযোগীদের বিরুদ্ধে আজো কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বিতর্কিত ও অদক্ষ প্রধান কর্মকর্তা নিয়োগের ফলে উল্টো লুটপাটকারীদের শাস্তি দূরের তথা উল্টো নতুন করে লুটপাটতন্ত্র কায়েম হয় কি না সে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসংস্কারের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো জরুরি বলে মনে করেন সবাই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা