গাজায় যুদ্ধবিরতির পর ধ্বংসস্তূপ থেকে ৩৫৪ লাশ উদ্ধার

গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ৩৫৪টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) এ তথ্য জানিয়েছে। গতকাল শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছে আলজাজিরা।
জাতিসঙ্ঘ তাদের সর্বশেষ গাজা পরিস্থিতি মূল্যায়নে জানিয়েছে, ২২ থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে গাজা উপত্যকার বোমা বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষে ১৭১ ফিলিস্তিনির লাশ পাওয়া গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জাতিসঙ্ঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) জানিয়েছে, গত ১৯ জানুয়ারি থেকে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
ওসিএইচএ আরও জানিয়েছে, গাজায় আনুমানিক ৫ কোটি টন ধ্বংসস্তূপ রয়েছে যা অপসারণ করতে ২০ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। গত ১৯ জানুয়ারি থেকে কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর ফলে আপাতত বন্ধ হয়েছে গাজার মৃত্যুর মিছিল। তবে গাজায় দীর্ঘ ১৫ মাসের ইসরাইলি হামলায় নিখোঁজ রয়েছেন ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ। জাতিসঙ্ঘের তথ্য মতে, ইসরাইলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। এ ছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।

মুক্তি দিতে যাওয়া ৩ বন্দীর নাম প্রকাশ হামাসের
গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় প্রথম ধাপে কয়েক দফায় ৩৩ জন বন্দীকে মুক্তি দেবে হামাস। সেই ধারাবাহিকতায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি গতকাল শুক্রবার তিন বন্দীর নাম প্রকাশ করেছে, যাদের আজ শনিবার মুক্তি দেয়া হবে। রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। হামাসের সামরিক শাখার মুখপাত্র আবু ওবাইদা নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে জানিয়েছেন, শনিবার মুক্তি পেতে যাওয়া তিন বন্দী হচ্ছেন ওফের কালডেরন, কিথ সিইগেল এবং ইয়ারডেন বাইবাস। ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১০ বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। বিনিময়ে ইসরাইলি কারাগারে বন্দী থাকা প্রায় ৪০০ ফিলিস্তিনিকে ছেড়ে দেয়া হয়।

জেনিনে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে ২ ফিলিস্তিনি নিহত
অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিনে ইসরাইলি বাহিনীর হাতে দুই ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকেই অঞ্চলটিতে ইসরাইলি আগ্রাসনের মধ্যে এই মৃত্যুর খবর এলো। আলজাজিরা জানিয়েছে, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে পশ্চিম তীরে একটি বড় হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে নিহতের সংখ্যা ১৯ জনে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জেনিন শরণার্থী শিবিরের ভেতরে হামলা চালায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। এ সময় তাদের গুলিতে দুই ফিলিস্তিনি নিহত হন। ওয়াফা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, নিহত দুই ব্যক্তি হলেন- ইয়াজান হাতেম আল-হাসান এবং আমির আবু হাসান। ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানিয়েছে, পৃথক ঘটনায় জেনিনের একটি ভবনে ইসরাইলি বিমান হামলায় তিন মধ্যবয়সী ফিলিস্তিনি নারী আহত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার একই এলাকায় দুই ফিলিস্তিনি যুবক নিহত হন। বুধবার রামাল্লায় ইসরাইলি ড্রোন হামলায় আরও ১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অপর দিকে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বেথলেহেমের দক্ষিণে আল-খাদের শহরে ইসরাইলি গুলিতে দুই ফিলিস্তিনি শিশু আহত হয়।

মোহাম্মদ দেইফের নিহতের খবর নিশ্চিত
বিবিসি জানায়, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফের নিহত হওয়ার খবর আগেই জানিয়েছিল ইসরাইল। এবার হামাসের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, দেইফ নিহত হয়েছেন। ইসরাইলের সেনাবাহিনীর ভাষ্য, গত ১৩ জুলাই ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার খান ইউনুস এলাকায় ইসরাইলের বিমান হামলায় মোহাম্মদ দেইফ নিহত হন। তখনই এ খবর প্রকাশ করেছিল ইসরাইল। এতদিন হামাসের পক্ষ থেকে দেইফের নিহত হওয়ার বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে হামাস দেইফের নিহতের খবর প্রথমবারের মতো নিশ্চিত করেছে। সেই সঙ্গে বিবৃতিতে হামাস জানায়, সংগঠনের সামরিক শাখার উপপ্রধান মারওয়ান ইশা নিহত হয়েছেন। যদিও এই কমান্ডারের নিহতের খবর যুক্তরাষ্ট্র গত বছরের মার্চে দিয়েছিল।

গাজার চেকপয়েন্ট পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ সেনা নিয়োগ
যুদ্ধবিরতির সময় গাজার চেকপয়েন্ট পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য ১০০ সেনা নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একটি ছোট মার্কিন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র ও রয়টার্সের দেখা একটি নিয়োগ ইমেল অনুসারে, সশস্ত্র আমেরিকান ঠিকাদারদের বিশ্বের সবচেয়ে সহিংস সঙ্ঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোর কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসা হয়েছে। ইমেলটিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং উত্তর ক্যারোলিনার ডেভিডসনে অবস্থিত লো-প্রোফাইল কোম্পানি ইউজি সলিউশনস অভিজ্ঞ সেনাদের জন্য দৈনিক এক হাজার ১০০ ডলার পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দিচ্ছে। একই সঙ্গে ১০ হাজার ডলার অগ্রিম হিসেবে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। ইমেলের সত্যতা নিশ্চিত করে মুখপাত্র বলেন, গাজার অভ্যন্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে তারা চেকপয়েন্টে কর্মী মোতায়েন করবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুখপাত্র বলেন, কিছু লোককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং তারা ইতোমধ্যেই চেকপয়েন্টে রয়েছেন। রয়টার্স জানুয়ারিতে জানিয়েছিল, আমিরাতি কর্মকর্তারা গাজায় যুদ্ধোত্তর শান্তিরক্ষী বাহিনীর অংশ হিসেবে বেসরকারি ঠিকাদারদের ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে এই ধারণা পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। সূত্র: রয়টার্স

৮৯ শতাংশ ইসরাইলিই মনে করে, গাজায় তারা ব্যর্থ : জরিপ
ইসরাইলের ৮৯ শতাংশ মানুষ মনে করে, গাজায় তাদের বাহিনী সফল হতে পারেনি। সম্প্রতি দেশটির জরিপ সংস্থা লেজার রিসার্চের এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ম্যারিভ নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি লেজার রিসার্চ একটি জরিপ চালিয়েছে। এতে গাজা যুদ্ধ সম্পর্কে ইসরাইলি জনসাধারণের মতামত যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ ইসরাইলি মনে করে যে গাজা যুদ্ধে তাদের লক্ষ্য সম্পূর্ণভাবে অর্জিত হয়নি। এ দিকে, ৩২ শতাংশ ইসরাইলি ভাবছে, গাজায় তাদের কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হয়নি। আর মাত্র ৪ শতাংশ ইসরাইলি মনে করে যে গাজায় তাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সূত্র : আলজাজিরা ও অন্যান্য।
জরিপে ৬৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে যে নেতানিয়াহুর পদত্যাগ করা উচিত। আর মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষ তার প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকার পক্ষে মত দিয়েছে। আর ১০ শতাংশ মানুষ কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে জোটের ভোটারদের মধ্যেও দেখা গেছে যে ৩৩ শতাংশ ভোটার নেতানিয়াহুর পদত্যাগ চায়। আর ৫৩ শতাংশ মানুষ তাকে এই পদেই দেখতে চান। আর ১৪ শতাংশ ভোটার এ বিষয়ে কোনো মতামত দেয়নি। এ দিকে, বিরোধীদলীয় ভোটারদের ৯২ শতাংশ মনে করেন যে নেতানিয়াহুর পদত্যাগ করা উচিত।

ট্রাম্পের গাজা খালি করার প্রস্তাবে পাকিস্তানের গভীর উদ্বেগ
গাজার বাসিন্দাদের মিসর ও জর্দানে স্থানান্তরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পাকিস্তান। বৃহস্পতিবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণলায় ট্রাম্পের প্রস্তাবকে গভীর উদ্বেগ এবং অন্যায় বলে অভিহিত করেছে। ট্রাম্প গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেন, গাজা উপত্যকাকে খালি করার সময় এসেছে এবং তিনি জর্দান ও মিসরের নেতাদের গাজার ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করতে বলেছিলেন, হয়তো সাময়িক বা স্থায়ীভাবে।
এ নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শাফকত আলী খান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গাজার জনগণকে স্থানান্তরের প্রস্তাবটি অত্যন্ত চিন্তার এবং অন্যায়। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনের ভূমি ফিলিস্তিন জনগণেরই এবং একমাত্র কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত বিকল্প হলো দুই-রাষ্ট্র সমাধান, যা জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে রয়েছে।

ইসরাইলের জেলে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মৃত্যু, হামাসের কঠোর নিন্দা
ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাস অভিযোগ করেছে যে, তারা (ইসরাইল) ফিলিস্তিনি বন্দীদের ওপর একের পর এক নির্যাতন চালাচ্ছে। সম্প্রতি গাজার দুই বন্দী, মোহাম্মদ শরিফ আল-আসালি ও ইব্রাহিম আশুরের মৃত্যু সেই নৃশংসতার আরও এক দৃষ্টান্ত। হামাসের মুখপাত্র আবদেল লতিফ আল-কানু এই ঘটনার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, তারা আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় না।
আনাদোলু এজেন্সি জানায়, গত ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলার পরবর্তী সময়ে, অন্তত ৫৮ ফিলিস্তিনি বন্দী ইসরাইলের হাতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গাজার ৩৭ জন বন্দী রয়েছেন। আল-কানু বলেছেন, ইসরাইল তার জেলে বন্দীদের প্রতি যে নৃশংসতা দেখিয়েছে, তা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং তাদের বর্বর আচরণ প্রমাণিত করে।