দেড় দশকে অবৈধ নিয়োগে চিনি শিল্প করপোরেশনে বিরাজ করছে অস্থিরতা
- শাহ আলম নূর
- ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৬
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। অভিযোগ উঠেছে, ১৯৮৫ সালের নিয়োগবিধি লঙ্ঘন এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) মতামত লঙ্ঘন করে ১৮ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত কর্মকর্তারা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বিএসএফআইসি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, করপোরেশনের অধীনে কর্মরত বিভিন্ন স্তরের ৫০০রও বেশি কর্মকর্তা বছরের পর বছর যথাযথভাবে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ওই ১৮ জন কর্মকর্তা সরাসরি ম্যানেজার (অর্থ), গ্রেড-৫ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন যা বিধিসম্মত নয়। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) সার্টিফিকেট দেখিয়ে ২০০৫, ২০০৭, ২০০৮ এবং ২০১০ সালে সরাসরি ম্যানেজার পদে কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ২০০৫ সালে দুইজন, ২০০৭ সালে চারজন, ২০০৮ সালে আরও দুইজন এবং ২০১০ সালে একবারে ১০ জন।
কর্মকর্তারা বলছেন, আইসিএমএ’র সার্টিফিকেটগুলো স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হিসাবে দেখানো হলেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এখনও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হিসাবে প্রশংসাপত্রগুলোকে স্বীকৃতি দেয়নি।
বিএসএফআইসি-এর ১৯৮৫ সালের পরিষেবা বিধি অনুসারে, ১৩ বছর কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া সরাসরি ম্যানেজার পদে একজন কর্মকর্তা নিয়োগের সুযোগ নেই, যা একটি গ্রেড-৫ পদ এবং ডেপুটি পদের সমতুল্য। ২০০৫ সালে তাদের সরাসরি ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগের বিষয়টি সামনে এলে বিএসএফআইসি ও শিল্প মন্ত্রণালয় তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মতামত চায়। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় বলেছে, গ্রেড-৫ পদে সরাসরি কোনো কর্মকর্তা নিয়োগের সুযোগ নেই। পরিবর্তে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে ব্যবস্থাপকের পদ পূরণের জন্য তখন কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়। বিধি ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মতামত লঙ্ঘন করে ১৮ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো: দেলোয়ার হোসেন, যিনি ওই সময়কালে আইসিএমএবি-এর একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। নিয়োগ দেয়ার পর ২০২০ সালে তিনি অবসরে যান। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের ১৫টি শূন্য পদে লোক নিয়োগের জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের ১০ আগস্ট ২০০৫ তারিখে অনুমোদন নেয়া হয়। পরবর্তীতে কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দরখাস্ত আহবান করা হয়। বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ৭৪টি আবেদনপত্র পাওয়া যায়। তার মধ্যে মাত্র ১৯টি আবেদনপত্র সঠিকভাবে সব শর্ত পূরণ করে। বাকি আবেদনপত্রগুলো অভিজ্ঞতার শর্ত সঠিকভাবে পূরণ করতে পারেননি। তাদের আবেদন গ্রহণ করার অবকাশ নেই। তার পরও ১৯ এপ্রিল ২০০৬ সালে ব্যবস্থাপক (অর্থ) পদে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চাকরিতে অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় বরাবর পত্র লেখা হয়। পত্র প্রাপ্তির পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মতামতের জন্য পত্র প্রেরণ করা হয়। এরপর সংস্থাপন মন্ত্রণালয় শিল্প মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেয়, ‘বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা ১৯৮৯-এর তফসিলের ক্রমিক ৪-খ এর কলাম ৫-এ ব্যবস্থাপক (অর্থ) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার বিষয় বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এমতাবস্থায় উল্লিখিত প্রবিধানমালার তফসিলের সংশ্লিষ্ট অংশে সংশোধন ব্যতিরেকে ব্যবস্থাপক (অর্থ) পদে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অভিজ্ঞতা বিষয়ক শর্ত শিথিলকরণ বিধিগত কোনো সুযোগ নেই।’
পরবর্তীতে ব্যবস্থাপক (অর্থ) পদে নিযোগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের বয়সসীমা শিথিল করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে পত্র লিখলে শিল্পমন্ত্রণালয় জানিয়ে দেয়, ‘চিনি শিল্পের ন্যায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও বিশেষায়িত শিল্প খাতে ব্যবস্থাপকের মতো পদে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা খুবই দুরূহ। সংস্থা আগে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে সফল হয়নি। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বিএসএফআইসি ব্যবস্থাপক পদের শতকরা ২৫ ভাগ পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণের যে বিধান রয়েছে তা পুনর্বিবেচনা করে উক্ত পদের ১০০ ভাগ পদ বিভাগীয় প্রার্থীদের মধ্য হতে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণকল্পে নিয়োগ বিধির প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনাই যোক্তিক ও বাস্তবসম্মত।
তথ্যে দেখা যায়, জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ এর অনু:-১২ এ ‘কোনো কর্মচারী কোনো উচ্চতর পদে ও বেতন স্কেলে পদোন্নতি পাইলে বা তাহার পাওয়ার ক্ষেত্রে ৩ নং গ্রেডে পূর্ণ বেতন পাওয়ার জন্য প্রথম শ্রেণীর পদে ন্যূনতম ১৪ বছর চাকরির মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান (তদন্ত) চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার ৩ দিনের ছুটির কথা বলে ২৮ মে ২০১৩ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চাকরিকালীন তিনি আনোয়ার ল্যান্ড মার্ক, গুলশান ঢাকায় চাকরি করেন। পরে তিনি সেখানকার চাকরি ছেড়ে অসুস্থতার সার্টিফিকেট করপোরেশনে জমা দিয়ে পুনরায় করপোরেশনের চাকরিতে যোগদান করেন।
জানা যায়, তৎকালীন চিনি করপোরেশনের প্রশাসকরা যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার জন্য উৎসাহিত ছিলেন না। তারা বিভিন্ন কৌশলে অনভিজ্ঞ লোকদের নিয়োগের জন্য নানাভাবে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পত্র চালাচালি করতেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে খুশি না হয়ে নিয়মনীতির তোয়ক্কা না করে নিজেদের লাভালাভের জন্য ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে উপসচিব পদমর্যাদার ৫ নং গ্রেডের ব্যবস্থাপক (অর্থ) পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে অনভিজ্ঞদের নিয়োগ দেয়া হয়। পরে ২০১০ সালেও একই কায়দায় একই পদ্ধতিতে নিজেদের ফায়দার জন্য উপসচিব পদমর্যাদার ব্যবস্থাপক (অর্থ) পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ১০ জন অনভিজ্ঞকে আবারও নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে এদের মধ্যে যাদের করপোরেশনে ১০ বছর চাকরি হয়েছে তাদেরকে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার ৩ নং গ্রেডে যুগ্মসচিব সমমানের পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। আবার যারা ২০১০ সালে নিয়োগ পান তাদেরকেও ২০২২ সালে একই কায়দায় যুগ্মসচিব সমমানের পদে ৩ নং গ্রেডে পদোন্নতি দেয়ার জন্য মনোনীত করা হয়।
তথ্যে দেখা যায়, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭ ও ২০১০ সালে হিসাব বিভাগের সংশ্লিষ্ট উল্লিখিত কর্মকর্তাদেরকে অবৈধভাবে কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের লিখিত সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে অনুমোদিত পদের অতিরিক্ত জনবলকে সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা ছাড়াই অবৈধভাবে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয়। অপর দিকে অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা নামী-দামি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স পাস করে এন্ট্রি পোস্টে অর্থাৎ নবম গ্রেডে যোগদান করে সরকারি সব নিয়মকানুন মেনে ২২ থেকে ২৫ বছর চাকরি করেও ৩ নং গ্রেডে পদোন্নতির জন্য মনোনীত হতে পারেননি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা