০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

তাবলিগ বিশ্ব ইজতেমার ১ম পর্ব শুরু ৩ মুসল্লির মৃত্যু

টঙ্গিতে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে জুমার নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা : নয়া দিগন্ত -

শূরায়ী নেজামের তাবলিগ জামাতের (মাওলানা জুবায়ের অনুসারী) বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে। কহর দরিয়াখ্যাত টঙ্গীর তুরাগ পাড়ের বিশ^ ইজতেমাস্থল এখন দেশ-বিদেশের লাখো মুসল্লির পদচারণায় মুখরিত। গতকাল প্রথম পর্বের প্রথম দিন বাদ ফজর থেকে আম বয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
এ দিন ইজতেমাস্থলে দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের। জুমার নামাজে অংশ নিতে ঢাকা, গাজীপুরসহ আশপাশের জেলার বহু মানুষ ইজতেমাস্থলে হাজির হন। ময়দানের নির্ধারিত খিত্তার পাশাপাশি তুরাগ নদীর পশ্চিমপাড়ে, ময়দান পার্শ্ববর্তী কামারপাড়া সড়কে ও ফুটপাথে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ফুটপাথে এবং খোলা জায়গায় নামাজ আদায় করেন আগত মুসল্লিরা। এ দিকে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে আসা তিনজন মুসল্লি গতকাল বিকেল পর্যন্ত মারা গেছেন।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন বলেন, জুমার জামাত উপলক্ষে জিএমপির পক্ষ থেকে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু জামাত শুরুর আগেই ময়দানে জায়গা না পেয়ে মুসল্লিরা মহাসড়কে নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে যান। এতে মহাসড়কের উভয়পাশে কিছুক্ষণের জন্য যান চলাচল বন্ধ থাকে। তবে জামাত চালাকালে উড়াল সড়ক দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। প্রতি বছরই জুমার জামাত ও আখেরি মুনাজাতকে কেন্দ্র করে যান চলাচলে সাময়িক বিঘœ ঘটে।
এ দিকে শূরায়ী নেজামের দুই পর্বে এবং নিজামুদ্দিনের (সা’দপন্থী) এক পর্বে এবার বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করায় গতকাল প্রথম দিনে মুসল্লি সমাগম হয়েছে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। জুমার জামাত শেষে ময়দানের মাঝে মধ্যে ফাঁকা লক্ষ করা গেছে।
ময়দানের পশ্চিমে তুরাগ নদীর পূর্ব পাশে নির্মিত মিম্বরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইমাম এবং উত্তর-পশ্চিমে বিদেশী মুসল্লিদের কামড়ার পাশে বয়ান মঞ্চে বয়ানকারী অবস্থান করবেন। আখেরি মুনাজাত বয়ান মঞ্চ থেকে পরিচালনা করা হবে। ইজতেমা মাঠের প্রায় ২ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাঁশের খুঁটির ওপর চটের ছাউনির প্যান্ডেলে মুসল্লিদের বয়ান শোনার জন্য লাগানো হয়েছে বিশেষ মাইক। লাগানো হয়েছে পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক বাতি।

আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, শূরায়ী নেজামের (জোবায়ের পন্থী) তাবলিগ অনুসারীদের ইজতেমা দু’টি ভাগে টানা ছয় দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপ ৪১ জেলার মুসল্লি নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। আর ২৩ জেলা নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমা হবে ৩-৫ ফেব্রুয়ারি। দু’টি ধাপের শেষদিন যথাক্রমে রোববার ও বুধবার আখেরি মুনাজাত হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা সা’দপন্থীদের তিন দিনের ইজতেমা হওয়ার কথা রয়েছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি আখেরি মুনাজাতের পর ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনের কাছে ইজতেমা মাঠ বুঝিয়ে দেয়া হবে।
বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরুব্বিরা জানান, গতকাল বাদ ফজর পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক মূল বয়ান শুরু করেন। তার বয়ান বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে শোনান বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান। সকাল পৌনে ১০টায় খিত্তায় খিত্তায় তালিমের আমল অনুষ্ঠিত হয়। মুসল্লিদের উদ্দেশে তালিমের আগে আলোচনা করেন ভারতের মাওলানা জামাল। সকাল ১০টায় শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বয়ানের মিম্বারে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ফারাহিম। ছাত্রদের সাথে নামাজের মিম্বারে বয়ান করেন আলিগড়ের প্রফেসর আব্দুল মান্নান। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মাঝে টিনশেড মসজিদে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আকবর শরিফ। তা চলে দুপুর পর্যন্ত।

দুপুরে জুমা নামাজের পর বয়ান করেন জর্ডানের মাওলানা ওমর খতিব। এরপর বাদ আসর বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের এবং বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা আহমদ লাট সাহেব বয়ান করেন। ইজতেমা স্থলের বয়ান মঞ্চ থেকে মূল বয়ান উর্দুতে হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ প্রায় ২৪টি ভাষায় তা তরজমা করা হচ্ছে। পরে তাবলিগ মারকাজের শূরা সদস্য ও বুর্জুগরা ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত সম্পর্কে ফজিলতপূর্ণ সারগর্ভ বয়ান করেন।
আম বয়ানে বলা হয়, ‘পৃথিবীতে ঈমানের মূল্য অনেক বেশি। ঈমানকে মজবুত করতে হলে আমাদের দাওয়াতি কাজে সময় লাগাতে হবে। আমরা যেন আল্লাহপাকের হুকুম মতো সারাজীবন চলতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ও সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে দীন কায়েম করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে হবে। দ্বীনের জন্য মেহনত করতে হবে। নিজের আমল দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল যে কাজে খুশি হন তা আমাদের বেশি বেশি করতে হবে। আমাদের সবার আখেরাতের চিরস্থায়ী জিন্দিগির জন্য আবাদ করতে হবে।
ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মো: হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান, ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম দিন ৭২ দেশের ২ হাজার ১৫০ জন বিদেশী তাবলিগ অনুসারী মুসল্লি ইজতেমায় উপস্থিত হয়েছেন।
বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা ও মুসল্লিদের খেদমতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বাংলাদেশ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের (ডেসকো) পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

ইজতেমায় আসা ৩ মুসল্লির মৃত্যু
ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মো: হাবিবুল্লা রায়হান জানান, এবারের বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে আসা তিন মুসল্লি গতকাল বিকেল পর্যন্ত মারা গেছেন। তাদের মধ্যে সকালে খুলনার ডুমুরিয়া থানার ডুমুরিয়া বাজার এলাকার লোকমান হোসেন গাজীর ছেলে আব্দুল কুদ্দুস গাজী (৬০) মারা যান। এ ছাড়াও ইজতেমায় আসা ঠাকুরগাঁও জেলার মৃত আব্দুলের ছেলে আমিরুল ইসলাম (৪৬) ও শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানার রানী শিমুল গ্রামের মৃত সবেদুল্লার ছেলে সাবেদ আলী (৭০) মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন টঙ্গী হাসপাতালে স্থাপিত সিভিল সার্জন কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন। তাদের সবার নামাজে জানাজা ইজতেমা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বার্ধক্যজনিত কারণে ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্যসেবা

টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জানান, মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্য বিভাগের বেশ কয়েকটি ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এ হাসপাতালে ইজতেমা উপলক্ষে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিতে ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ওই সব ক্যাম্প থেকে ২৪ ঘণ্টা মুসল্লিদের বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি বছরের মতো বিন্যামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হবে।

নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই : জিএমপি কমিশনার
ইজতেমা নিয়ে আমেরিকান দূতাবাসের সতর্কতা জারি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই। বিদেশীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। আমার মনে হয় না তাদের কোনো নিরাপত্তার ঘাটতি আছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ইজতেমায় ডিএমপির কন্ট্রোল রুমে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব বলেন কমিশনার। তিনি বলেন, ইজতেমার পরিবেশ নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। অনেক গুজব ছড়াবে, এটির বিষয়ে আমাদের সবার সজাগ থাকতে হবে।
এ সময় তিনি বলেন, এখানে প্রচুর ভিক্ষুক লক্ষ করা যাচ্ছে, আমার মনে হয় এটা কোনো চক্রের মাধ্যমে ব্যবসায়িকভাবে বসানো হয়েছে। মানবিক কারণে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। তাদের অন্য কোনো স্থানে নিয়ে বসিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য ইজতেমায় দায়িত্বশীল মুসল্লিদের নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

জিএমপি কমিশনার আরো বলেন, অনেক হকার বসেছে, তাদেরকে উচ্ছেদ করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও এবার অনেক শান্তিপূর্ণভাবে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইজতেমা মাঠের আশপাশে যানচলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন জানান, মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য বিশেষ ট্রেন, পর্যাপ্ত বিআরটিসি বাস ও লঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো ইজতেমা ময়দান নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে। এ জন্য পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক বিজিবি প্রস্তুত রয়েছে। দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ইজতেমা মাঠে মোতায়েন রয়েছে। তিনি জানান, নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ খাবার ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে সমাধানের জন্য একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রতিদিন অন্তত ৩০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল