আপিল নিষ্পত্তিতে অবসরপ্রাপ্ত দক্ষ জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ
- হাবিবুর রহমান
- ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
দেশের উচ্চ ও নি¤œ আদালত মিলে বর্তমানে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ২৮ হাজার ৯০১টি, হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৮০টি এবং নি¤œ আদালতে ৩৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩২৯টি বিচারাধীন রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই তথ্য দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার এই সংখ্যা আরো বড় হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। আর প্রতি বছরই এই মামলাজট দীর্ঘ হচ্ছে। জমে থাকা এসব মামলার নিষ্পত্তি বা মামলাজট হ্রাসে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের প্রস্তাব করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। গত ১৫ জানুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ে কমিশনের যে সামারি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে তাতে মামলাজট নিরসনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য জট নিরসনকল্পে বিচার বিভাগের দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি সংস্কার প্রয়োজন।
স্বল্পমেয়াদি সংস্কার : বিদ্যমান মামলাজট নিরসনকল্পে জরুরি ভিত্তিতে কিছু স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে : (১) অধিক সংখ্যক ফৌজদারি আপিল, ফৌজদারি রিভিশন, দেওয়ানি আপিল ও দেওয়ানি রিভিশন নিষ্পন্নাধীন আছে এরূপ জেলাগুলোয় অবসরপ্রাপ্ত সৎ, দক্ষ এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জেলা জজগণকে ২-৩ বছরের মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০০০টি আপিল/রিভিশন বিচারাধীন আছে এরূপ জেলাতে চুক্তিভিত্তিক জেলা জজগণকে নিয়োগ করা যেতে পারে।
(২) অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজকে বিশেষ আদালত আইন ২০০৩ সংশোধনক্রমে এবং সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৪৯ ধারা অনুসারে নিয়োগ করা যেতে পারে। উক্তরূপ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য আইন সংশোধনের পূর্বে মাসদার হোসেন মামলায় প্রদত্ত কনটিনিউয়াস ম্যানডামাসের আওতায় প্রণীত বিধিমালার সাথে সম্ভাব্য আইনগত জটিলতা এড়ানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অনুমতি গ্রহণ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, উক্তরূপে চাকরি বিধিমালায় শুধুমাত্র পদোন্নতির মাধ্যমে জেলা জজ নিয়োগের বিধান আছে।
(৩) জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন আদালতে নিষ্পন্নাধীন বিপুল সংখ্যক ফৌজদারি মামলার (২১ লাখ +) একটি বিরাট অংশ সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে মিথ্যা মামলা মর্মে নানাবিধ প্রচারমাধ্যমে বলা হয়ে থাকে। তবে প্রচারমাধ্যমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে না। বরং প্রতিটি মামলার নথিপত্র পরীক্ষাক্রমে সহজেই ওইসব মামলার আংশিক সত্যতা বা অসত্যতা সম্পর্কে একটি কার্যকর ধারণা পাওয়া যাবে। তাই প্রশাসনিকভাবে সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তা এবং তদন্তাধীন মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তাকে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। তা ছাড়া, বিচার শুরু হয়ে গেছে অথচ দীর্ঘদিন সাক্ষী আসছে না বিধায় অনিষ্পন্ন আছে এরূপ মামলার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে সাক্ষ্য কার্যক্রম বন্ধ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আইন কর্মকর্তারা আদালতকে অনুরোধ করবেন মর্মে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।
(৪) পাবলিক প্রসিকিউটর এবং অন্যান্য আইন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ত্বরিত ও দক্ষ সেবা পাওয়ার জন্য কয়েকটি বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। যথা: (ক) পিপি/জিপিগণের জন্য অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেলের সমমর্যাদার আর্থিক সুবিধা এবং অন্যান্য আইন কর্মকর্তার (অ্যাডিশনাল পিপি/জিপি ইত্যাদি) জন্য যুক্তিসঙ্গত হারে পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতে হবে। (খ) ভাড়ার ভিত্তিতে তাদের জন্য ভৌত অবকাঠামো, বিশেষত অফিসের ব্যবস্থা করতে হবে। (গ) আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে সহায়ক জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। (ঘ) মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। (ঙ) সংশ্লিষ্ট আদালতের বাইরে অবস্থানরত সাক্ষীদের ই-টেকনোলজির মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে। এ বিষয়ে সাক্ষ্য আইন ও সুপ্রিম কোর্টের ২০ আগস্ট ২০২৩ সালের বিজ্ঞপ্তি নং ৪৯০এ, এর মাধ্যমে প্রকাশিত প্র্যাকটিস ডাইরেকশন প্রতিপালন করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার- (১) বিচারপ্রক্রিয়া এবং বিচারপ্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষত, বিচারক, ফৌজদারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং প্রসিকিউটর এবং বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করতে হবে। (২) সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। (৩) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতকরণের জন্য একটি কমিশন গঠন: (৪) অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদ্যমান পদ্ধতির প্রয়োজনীয় সংস্কার; (৫) বিচার বিভাগের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন; (৬) দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তকাজ পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠন; (৭) আইনজীবীদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্তিকরণ ও মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ; (৮) সুপ্রিম কোর্টসহ সব আদালতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর ব্যবস্থা করা: (৯) বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ এবং যথাসম্ভব নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা; (১০) বিভিন্ন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগের জন্য বিদ্যমান পদ্ধতির প্রয়োজনীয় সংস্কার: (১১) মামলা মোকদ্দমা এবং বিচার বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের আস্থা সৃষ্টির জন্য সামগ্রিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: (১২) বিচার বিভাগের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ: (১৩) গ্রাম পর্যায়ে ছোট ছোট বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য স্থানীয়ভাবে কার্যকর এডিআর ব্যবস্থা প্রবর্তন। প্রয়োজনে লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের সহায়তা গ্রহণ; (১৪) বিচারব্যবস্থায় জনগণের অভিগম্যতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর এবং জনবান্ধব পুলিশি সহায়তা এবং লিগ্যাল এইড কার্যক্রম নিশ্চিত করণ; (১৫) বর্তমানে চালু থাকা গ্রাম আদালতের আমূল সংস্কারের মাধ্যমে বিচারকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো; (১৬) বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা