৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ২৯ রজব ১৪৪৬
`
এইচআরডব্লিউর সুপারিশ

র‌্যাব বিলুপ্তিসহ গণ গ্রেফতার বিচারবহির্ভূত হত্যা ক্রসফায়ার বন্ধের আহ্বান

-


আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অন্তর্বর্তী সরকারকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় এমন কার্যকর বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংস্কারের তাগিদ দিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছে। এইচআরডব্লিউয়ের সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার অর্ধশত পৃষ্ঠার এ গবেষণাপত্রে সুপরিশমালা প্রণয়নের পাশাপাশি হাসিনা শাসনামলে নির্যাতন ও গুমের শিকার অন্তত ৩০ জন ভিকটিমের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে কিভাবে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রাজনৈতিক নির্দেশে মানুষ নির্যাতনের পর কার্যকর কোনো আইনি সহায়তা পায় না। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে বিস্তারিত সুপারিশ দিয়ে এসব আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
নির্বিচারে গ্রেফতার ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বন্ধ করা, র‌্যাবের বিলুপ্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশে স্থায়ী সংস্কার নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দফতর এবং জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভুল্যুশন : অ্যা রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে সরকারকে আটকের ক্ষেত্রে আইন অনুসরণ ও সমালোচকদের দমনের জন্য ব্যবহৃত আইন বাতিলের সুপারিশ করা হয়। সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং জনপ্রশাসন, পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, ভবিষ্যতের সরকারের যেকোনো দমন পীড়নকে প্রতিহত করতে দ্রুত ও কাঠামাগত সংস্কার করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টে অর্জিত অগ্রগতি সফল হবে না। আগামী মার্চ মাসে অনুষ্ঠিতব্য মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে একটি ঐকমত্য প্রস্তাব আনতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ
অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং গণহারে গ্রেফতার নিষিদ্ধে পুলিশের জন্য একটি গাইডলাইন অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করা উচিত। একই সাথে আইন মন্ত্রণালয়কে সমালোচকদের দমনে ব্যবহৃত আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘আটক’ সংক্রান্ত যত মামলা রয়েছে সেগুলোর বিচার রিভিউ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আটক যেকোনো ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত ও দ্রুত বিচারকের সামনে হাজির করার বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ : গত ১৫ বছরে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ সব ক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের মুখোমুখি করার ঘটনা নেই বললেই চলে। তদন্তের সময় সঠিকভাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান ইটস ওয়াচ। একইসাথে তদন্তকালীন সময়ে বেআইনি মৃত্যু ঠেকাতে প্রয়োজনে মিনেসোটা প্রটোকল অনুসরণ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে সুপারিশ করা হয়েছে। ‘ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড’ এর স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞদের প্রযুক্তিগত সহায়তায় একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে সরকারকে সুপারিশ করেছে এই মানবাধিকার সংস্থাটি। যেসব কর্মকর্তা এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে- জনসম্মুখে এ ঘোষণা দিতেও আহ্বান করেছে সংস্থাটি।
র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ : হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সুপারিশ করেছে যে, শুধুমাত্র এই শর্তেই র‌্যাব বিলুপ্ত করা হবে যে র‌্যাবের সাথে যুক্ত কর্মকর্তারা অন্য বাহিনীতে গিয়ে একই ধরনের অপকর্মের চর্চা করতে পারবে না। একইসাথে এই বার্তাও দিতে হবে যে বাহিনীটিকে ভবিষ্যতে অপব্যবহার করা হবে না এবং পরবর্তী সরকারের দমন পীড়ন চালানোর হাতিয়ার হবে না বাহিনীটি।

বলপূর্বক অপহরণ ও গুম বন্ধের সুপারিশ : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গোপন আটকের স্থানগুলো চিহ্নিত করা এবং প্রমাণ নষ্ট না করার নির্দেশ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। আটকের সব পরিচিত স্থানগুলোর তালিকা প্রকাশ করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে যেকোনো ব্যক্তির সাথে গোপনে কথা বলার ক্ষমতা দিতেও সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
সরকারের বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিদের অবিলম্বে মুক্তি নিশ্চিত করা উচিত বলে মনে করছে সংস্থাটি। হেফাজতে নিহত ব্যক্তি এবং কবর স্থানের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিতে আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনটি। বাংলাদেশে আইনের অধীনে একটি স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে ‘বলপূর্বক গুম’ নিষিদ্ধ করতে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে।
কার্যকর ও অধিকারভিত্তিক বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা : অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদ্যমান বিচার বিভাগের নিয়োগের এককালীন পর্যালোচনা করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিচারক বা প্রসিকিউটরদের নিয়োগ বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যাতে না থাকে তা নিশ্চিতে একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে। পাবলিক প্রসিকিউটরদের জন্য ভূমিকা এবং নিয়োগপদ্ধতি পুনর্গঠন করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। সব মামলার তথ্য বিনামূল্যে পেতে অনলাইনে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আরো মহিলা প্রসিকিউটর ও বিচারক নিয়োগ করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রধান বিচারপতির সুপারিশ অনুযায়ী, বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নেই এবং যেকোনো মন্ত্রী বা কর্মকর্তা এই চেষ্টা করলে তাকে জবাবদিহি করা হবে তা নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন সচিবালয় তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে।

সক্রিয় নাগরিক সমাজ গঠন : ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হলেও এতেও আগের মতো কিছু ক্ষতিকর ধারা-উপধারা রয়ে গেছে। নতুন করে ‘সাইবার প্রোটেকশন অর্ডিন্যান্স ২০২৪’ অনুমোদন করা হলেও এই অধ্যাদেশ নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নাগরিক সমাজের বিশেষজ্ঞ এবং কর্মীদের সাথে পরামর্শ করে খসড়া অধ্যাদেশটি সংশোধন করতে আহ্বান জানিয়েছে। একই সাথে এ অধ্যাদেশটিকে একটি আইনের রূপান্তর করতে সুপারিশ করা হয়েছে।
গণমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলার তদন্ত ও বিচার করার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। অভ্যুত্থানের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগ না থাকলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে এই মানবাধিকার সংস্থাটি। শান্তিপূর্ণ সমালোচকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করতেও সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং জনপ্রশাসন, পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত বছর বর্ষা বিপ্লবের সময় ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়ন ছিল রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্যাটার্নের অংশ, যারা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের জন্য দায়মুক্তির সংস্কৃতি উপভোগ করে আসছে। পুলিশকে ‘একটি রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র’ হিসেবে বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে ‘সাধারণভাবে কেউ কেউ ধারণা করেছিল যে পুলিশ, সেই সাথে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো, দায়মুক্তি ও শূন্য জবাবদিহিতার সাথে কাজ করতে সক্ষম।’ এ কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা খাতের সংস্কার বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা একই অপমানজনক অনুশীলনে ফিরে না যায়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের পদোন্নতি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও ঘুষের ওপর নির্ভরশীল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দমন-পীড়নের জন্য প্রণোদনা হিসেবে পুলিশ পুরস্কারের ব্যবহারও নথিভুক্ত করেছে। এ পদ্ধতিগত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলে বোঝা যায় যে একজন নিরাপত্তা বাহিনী কর্মকর্তা হিসেবে একজনের কর্তব্যের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন অন্তর্ভুক্ত ছিল। একজন কর্মকর্তা পুলিশের নির্যাতন সম্পর্কে বলেন, ‘এই কর্মকাণ্ডের পেছনের চালিকাশক্তি হলো ব্যক্তিগত লাভ এবং স্বার্থ’, এবং পদোন্নতি পেতে এবং সংশ্লিষ্ট আর্থিক সুবিধা পেতে, কর্মকর্তারা রাজনীতিবিদদেরও ঘুষ দিতেন। অন্য একজন কর্মকর্তা বলেন, লোভনীয় পদের জন্য প্রায়ই যোগ্যতার চেয়ে দলের প্রতি আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় এবং কর্মকর্তারা তাদের দলে রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত ব্যক্তিদের নির্বাচন করার প্রবণতা রাখেন। এই আনুগত্যের ফলে পুলিশ ক্রমেই পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে উঠেছে, বছরের পর বছর ধরে দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করছে। পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যে ফাটল তৈরি হয়েছে। এ ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সেনাবাহিনীতেও ছড়িয়ে পড়েছে। পদোন্নতির পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও পুরস্কার পেয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে দমন-পীড়নের জন্য। নির্বাচনের আগে পুলিশের ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ চলাকলে ১৩৬ জন বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড এবং ১০ জন জোরপূর্বক গুম হয়েছিল।


আরো সংবাদ



premium cement
মুন্সিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১, আহত ১৫ পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ১০ সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় পরিবর্তনে কী লাভ গ্রাহকের যুক্তরাষ্ট্রে অবতরণের সময় যাত্রীবাহী বিমানের সাথে হেলিকপ্টারের সংঘর্ষ পঞ্চগড়ে বইছে শৈত্যপ্রবাহ, তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রির ঘরে বড় জয়েও অপেক্ষা বাড়ল রিয়াল মাদ্রিদের সমন্বিত অনলাইন সত্যায়ন ব্যবস্থাপনা চালু করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুবসমাজকে বৈশ্বিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত করাই লক্ষ্য : আসিফ নজরুল ভেনেজুয়েলার ৬ লাখ অভিবাসীকে ডিপোর্ট করছে যুক্তরাষ্ট্র রাজনীতিতে 'হাতে খড়ি' নিচ্ছেন জাইমা রহমান লোহাগাড়ায় যুবকের কাছ থেকে ৪ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার

সকল