সাবেক সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহর ইন্তেকাল
- নিজস্ব প্রতিবেদক, নারায়ণগঞ্জ ও রূপগঞ্জ সংবাদদাতা
- ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৯
বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান, সাবেক সংসদ সদস্য, ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযুদ্ধকালীন এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল (অব:) কে এম সফিউল্লাহ বীরউত্তম ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গতকাল রোববার সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী জিয়াউর রহমান মনি বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। সফিউল্লাহ দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, থাইরয়েডে জটিলতা, ফ্যাটি লিভার, ডিমেনশিয়াসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। বিকেল ৪টায় ঢাকা সেনানিবাসের সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদে মরহুম কে এম সফিউল্লাহর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, বীর প্রতীক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান, প্রাক্তন সেনাবাহিনী প্রধানরা, ঢাকা ও মিরপুর সেনানিবাসের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং সব পদবির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। নামাজে জানাজা শেষে মরহুমের লাশ বনানী সামরিক কবরস্থানে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মরহুমের মাগফিরাত কামনা করা হয় এবং সেই সাথে তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। এর আগে গতকাল জোহরের নামাজের পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত কাজী আবদুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান দিপু, মরহুমের ছেলে কে এম ওয়াকুজ্জামান প্রমুখ।
কে এম সফিউল্লাহর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তার অবদান আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ তার বীরগাথা আজীবন চিরকৃতজ্ঞে স্মরণ করবে।’ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তিনি বীরউত্তম খেতাব পেয়েছেন। ১৯৯৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালে একদল সেনাসদস্য যখন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে, সফিউল্লাহ তখন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। এরপর খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের প্রতি তিনি আনুগত্যও প্রকাশ করেছিলেন। তবে কয়েক দিনের মধ্যে তাকে সেনাপ্রধানের পদ হারাতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধের আগে কে এম সফিউল্লাহ ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন কে এম সফিউল্লাহ। তার অধীনে থাকা ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল হবিগঞ্জ মহকুমা, কিশোরগঞ্জ মহকুমা, আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার অংশবিশেষ। মুক্তিযুদ্ধের অক্টোবর মাসে তার নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় এস ফোর্স। এই ফোর্সের অধীনে ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ১১ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। কে এম সফিউল্লাহর নির্দেশে ও নেতৃত্বে অসংখ্য দুর্ধর্ষ ও সফল অপারেশন পরিচালিত হয়। তিনি এসব অপারেশনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেন। কে এম সফিউল্লাহ ১৯৩৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৫০ সালে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে পড়া অবস্থাতে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে ডিফেন্স স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি করেন। তিনি স্কুল অব ইনফেন্ট্রিতে প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৯৭০ সালে পদোন্নতি পেয়ে আবার ব্যাটালিয়নে ফিরে আসেন কে এম সফিউল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন কে এম সফিউল্লাহ। ১৯৭৩ সালের তিনি ব্রিগেডিয়ার এবং একই বছরের ১০ অক্টোবর মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত তিনি সেনাপ্রধান ছিলেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত টানা ১৬ বছর তিনি কানাডা, সুইডেন, ইংল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯১ সালে দেশে ফিরে এলে তাকে এক বছরের জন্য ওএসডি করে রাখা হয়। ১৯৯২ সালে তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যান। ১৯৭৩ সালে রূপগঞ্জ গ্রামে তার বাবার নামানুসারে কাজী আবদুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে কে এম সফিউল্লাহর পরিকল্পনায় সিলেটের একাংশ, আশুগঞ্জ, ভৈরব ও মাধবপুর হানাদারমুক্ত হয়। তার নেতৃত্বে হানাদারমুক্ত হয় আশুগঞ্জ, ভৈরব, লালপুর, আজবপুর, সরাইল, শাহবাজপুর, মাধবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুর।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা