২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৩ রজব ১৪৪৬
`

১৬ বছর পর মুক্ত বিডিআর জওয়ানরা

৪ কারাগার থেকে মুক্তি ১৭৮ জনের
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তির পর স্বজনদের মাঝে এক সাবেক বিডিআর সদস্য : নয়া দিগন্ত -


পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ধারায় দায়ের হওয়া মামলায় জামিনপ্রাপ্তরা কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ মোট চার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের পর কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১, ২ ও হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা বিস্ফোরক দ্রব্য মামলার জামিনপ্রাপ্ত আসামিরা বের হন। এর আগে তাদের মুক্তি পাওয়া উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকেই চার কারাগারের প্রধান ফটকের বাইরে পরিবারের স্বজনরা অপেক্ষা করতে থাকেন।
ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন মো: জাহাঙ্গীর কবির নয়া দিগন্তকে বলেন, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, নিউমার্কেট থানা এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় চার কারাগারে আটক মামলার আসামিদের জামিনের আদেশের কাগজ আসার পর যাচাই বাছাই শেষে বিডিআর বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ৪১ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ থেকে ২৬ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে ৮৯ জন, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১২ জনকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে আরো ১০ জনের জামিননামা পাওয়ায় মোট ১৭৮ জনকে মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় অপেক্ষারত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গতকাল সকাল থেকেই বিডিআর জওয়ানদের স্বজনরা ফুল ও ফুলের মালা নিয়ে কারাগারের মূল ফটকের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কখন কারাগার থেকে তাদের প্রিয় মানুষটি বের হয়ে আসবেন। বেলা ১টার দিকে যখন বিডিআর জওয়ানদের জামিনের মুক্তি দেয়া শুরু হয় তখন স্বজনরা দৌড়ে গিয়ে তাদের প্রিয় মানুষটিকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় এক ভিন্ন রকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এমন দৃশ্য দেখে অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
মুক্তি পাওয়া বিডিআর জওয়ানরা মুক্তির পর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমাদেরকে বিনা দোষে বিনা কারণে অন্যায়ভাবে কারাগারে ১৬ বছর আটকে রাখা হয়। জীবনের বড় একটি অংশ এই কারাগারেই কেটে গেল। এখন আমরা মুক্ত আকাশ দেখতে পাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে। আল আমিন নামে একজন বিডিআর সদস্য বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামাতে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমাদেরকে বিনা দোষে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এখনো এই কারাগারে বিনা দোষে আমাদের অনেক ভাই আটকে আছেন। তাদেরকে সরকার যেন দ্রুত মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন।
একজন বিডিআর সদস্য কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের জীবন তো শেষ। এরপরও পরিবারের কাছে আসতে পেরে এখন খুবই আনন্দ লাগছে। দেখা গেছে, কারামুক্ত বিডিআর সদস্যদের বরণ করতে তাদের সন্তানরাও আসেন কারাগার এলাকায়। এ সময় অনেক সন্তান তাদের বাবাকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। কেউ আবার ফুল দিয়ে বরণ করেন।

ঢাকা জেলা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত ১৯ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জ কারাগারের অস্থায়ী আদালতে ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ২ এর বিচারক ইব্রাহিম মিয়ার আদালত সাক্ষ্য গ্রহণ ও জামিন শুনানি শেষে বিস্ফোরক মামলায় আসামিদের জামিনে মুক্তির আদেশ দেন।
আদেশে বলা হয়, যারা বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল নেই তারা জামিনে মুক্তি পাবেন। একইভাবে হত্যা মামলায় এরই মধ্যে যাদের সাজা ভোগ সম্পন্ন হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যদি উচ্চ আদালতে আপিল না থাকে তাহলে তারাও মুক্ত হবেন। আদালতের শর্তাবলি পর্যালোচনা করে গত ২২ জানুয়ারি ১৭৮ জনের জামিননামার কাগজ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।
অন্যদিকে গাজীপুর মহানগর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, গতকাল ভোরে ১৩ জন বিডিআর সদস্যের মুক্তির কাগজপত্র কারাগারে পৌঁছালে যাচাই-বাছাই শেষে অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকায় তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। এর পর বেলা সাড়ে ১১টায় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ থেকে ২৫ জন মুক্তি পান। বিষয়টি নিশ্চিত করে কাশিমপুর কারাগার-১ এর জেল সুপার মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম বলেন, ৮৪ জন বিডিআর সদস্যের মধ্যে জামিন পাওয়া ২৫ জনকে মুক্তি দেয়া হয়। তাদের মুক্তির কাগজপত্র কারাগারে এলে যাচাই-বাছাই শেষে অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকায় তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। সবশেষ বেলা দেড়টায় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্তি পান ৮৯ জন বিডিআর সদস্য। সিনিয়র জেল সুপার মো: আল জানান, এই কারাগারে বিডিআরের ৩৭৮ জন বন্দীর মধ্যে ৭৯ জন জামিন পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকায় মুক্তি দেয়া হয়েছে।

বিডিআর সদস্যদের মুক্তির খবরে সকাল থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। পর্যায়ক্রমে জামিনে মুক্তি পাওয়া বিডিআর সদস্যরা জেলখানার বাইরে অপেক্ষমাণ স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরিবার ও বিডিআর সদস্যদের হাউ-মাউ কান্নার শব্দে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকে এক হৃদয়স্পর্শী পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
মুক্তি পাওয়া ময়মনসিংহ ৪৫ ব্যাটালিয়নের সিপাহি মো: এনামুল বলেন, আমরা যারা নিরপরাধ ছিলাম আমাদেরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। আমাদের সবাইকে চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে এবং সব রকম সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এ ঘটনায় যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের শাস্তি দিতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদেরকে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি শুধু বলা হয়েছিল সাক্ষ্য দিতে হবে। কার নামে সাক্ষ্য দিতে হবে আমরা কিছুই জানি না। সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমাদেরকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠায় খুনি হাসিনা সরকার।
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকা সদর ব্যাটালিয়নের সিপাহি আবু হাসান বলেন, যখন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে তখন আমার চাকরির বয়স মাত্র ছয় মাস। পিলখানাতে যে পাঁচটি গেট আছে তা কেবল জানতাম কিন্তু কোনো গেটই আমি চিনতাম না। অথচ আমাকে করা হয়েছে আসামি। যেসব সিনিয়র স্যারদের আমরা বাবা সমতুল্য সম্মান করতাম আজকে তাদের হত্যার দায়ে আমাদেরকে মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করতে হয়েছে ১৬টি বছর। তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমরা যেন আমাদের হারানো সম্মান ফিরে পাই।
ঢাকা সদর ব্যাটালিয়নের আরেক সিপাহি জামাল উদ্দিন খানের মেয়ে জুয়েনা জামাল ঐশী বলেন, আমার বাবাকে আমি চিনি না। বড় হয়ে শুনেছি আমার বয়স যখন এক বছর তখন আমার বাবাকে বিডিআর হত্যা মামলায় আসামি করে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর বাবার মুখ দেখতে পারবো এই অনুভূতির কথা কি বলে শেষ করা যাবে? কোনো দিন বাবার আদর পাইনি। আজ মন ভরে বাবাকে দেখবো। জুয়েনা জামাল ঐশী যখন কথা বলছিলেন তখন তার চোখের পানি টলমল করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পটভূমি : ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে ভয়াবহ বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। হত্যা মামলার রায়ে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায় দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ে ১৩৯ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। পাশাপাশি আরো ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেয়া হয়। খালাস পান ২৮৩ জন। তবে হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা যান। ফলে হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে।

এদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ কারণে এই মামলার বিচারকার্যক্রম ঝুলে ছিল এতদিন ।
গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্ত আবার শুরুর দাবি উঠে। এরপর গত ১৯ ডিসেম্বর অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যান শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এই হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তের জন্য গত ২৪ ডিসেম্বর আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশনকে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়, যার ধারাবাহিকতায় আজ পিলখানা ট্র্যাজেডির বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলায় ১৭৮ জন সাবেক বিডিআর সদস্য মুক্ত হয়েছেন।
কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘জামিন সংক্রান্ত সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নিয়ম অনুযায়ী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। এতদিন কারাগারে আটক থাকার পর আজ তাদের মুক্তির মাধ্যমে বিস্ফোরক মামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শেষ হলো।

 


আরো সংবাদ



premium cement