২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৩ রজব ১৪৪৬
`

সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদই বাধা

বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা
-


পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান বিচারপতির দফতর থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ যেভাবে আছে, সেভাবে রেখে পৃথক সচিবালয় বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃক্সক্ষলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’ সংবিধানের এই ১১৬ অনুচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুলের শুনানিতে রিটকারী আইনজীবী এসব যুক্তি তুলে ধরেন।

রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির আদালতে বলেন, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা। এই অনুচ্ছেদটিকে যদি অসাংবিধানিক ঘোষণা না করা হয়, তা হলে বিচার বিভাগকে পরিপূর্ণ স্বাধীন করার যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এই বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা বলতে বুঝায় তার একটি পৃথক সচিবলায় প্রতিষ্ঠা করা। তাদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি এবং শৃঙ্খলা সব কিছুই সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে এখন এটি রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত আছে। যদি সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যাস্ত করা যায় তাহলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের ওপর সরকারের যে নিয়ন্ত্রণ আছে তা থাকবে না। আইন মন্ত্রণালয় অতীতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে, রায় দেয়ার ক্ষেত্রে, তারিখ দেয়ার ক্ষেত্রে, সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে, বদলি করার ক্ষেত্রে, রায় দিলে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি পাঠিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে, এই সব ধরনের অসাংবিধানিক ও স্বাধীনতাবিরোধী যে কর্মকাণ্ড তাদের ওপর করা হয় তা থেকে তাদেরকে মুক্ত করে দেয়া প্রয়োজন। এখানে অনেক মেধাবী অফিসার আছেন, অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছেন। যোগ্য ব্যক্তিকে যদি স্বাধীনতা দেয়া হয় তাহলে তারা স্বাধীনভাবে বাংলাদেশের জন্য, বিচার বিভাগের জন্য কাজ করতে পারবেন।

তিনি আরো বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ যে সংবিধানে থাকা উচিত নয় এই কথা পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে, ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন এবং জাজেস কেস সুপ্রিম কোর্ট সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, ১১৬ অনুচ্ছেদের কারণে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা চাই ১১৬ অনুচ্ছেদ অতি দ্রুত আমাদের হাইকোর্ট বিভাগ শুনানি করে অসাংবিধানিক ঘোষণা করুক। নিম্ন আদালতের বিচারকদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হোক। বিচার বিভাগের পৃথক সচিবলায় প্রতিষ্ঠা করে তা আইন মন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত হোক।

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল ১১৬ অনুচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুলের শুনানিতে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির এসব যুক্তি তুলে ধরেন। এরপর আদালত রাষ্ট্রপক্ষের শুনানির জন্য মুলতবি রেখেছেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদ উদ্দিন ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন।
মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, শুনানিতে বলেছি, বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যে শৃঙ্খলা বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে ২০১৭ সালে, সেটি করা হয়েছে সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। অথচ এটি করার কথা ছিল সংবিধানের ১১৬ এবং ১১৬ (ক) এর বিধান অনুযায়ী। তা করে নাই দেখে তৎকালীন সরকার বার বার সময় নিয়েছে। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট এর সাথে একমত পোষণ করেননি। ৫৮ বার সময় নেয়ার পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বেঞ্চ থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে এই শৃঙ্খলা বিধিটি ১৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অনুমোদন করানো হয়; এটি সাংবিধানিক নয়। শৃঙ্খলা বিধি ১৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হবে না। এটি তৈরি করবে উচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট, রাষ্ট্রপতির দফতর নয়। আমরা যে স্বাধীনতার কথা বলছি তা হলো সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীনতা।
শুনানিতে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের কারণে আমাদের হৃদয়ে রক্তকরণ হচ্ছে। নিম্ন আদালতের বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। রাতে কোর্ট বসিয়ে বিচারকদের সাজা দিতে বাধ্য করার ঘটনা ঘটেছে।

গত ২৭ অক্টোবর সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকা কেন অসাংবিধানিক হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রাথমিক শুনানি নিয়ে এ রুল জারি করেন।
গত ২৫ আগস্ট ওই বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন দায়ের করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী এ রিট দায়ের করেন। তারা হলেনÑ আইনজীবী মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন, মো: আসাদ উদ্দিন, মো: মুজাহিদুল ইসলাম, মো: জহিরুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, শাইখ মাহাদী, আবদুল্লাহ সাদিক, মো: মিজানুল হক, আমিনুল ইসলাম শাকিল এবং যায়েদ বিন আমজাদ। রিটে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে বিবাদি করা হয়। রিট আবেদনে একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে আদালতের নির্দেশনা চাওয়া হয়।


আরো সংবাদ



premium cement