২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৩ রজব ১৪৪৬
`

গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে দুই শতাধিক লাশ উদ্ধার

-

- চরম মূল্য দিয়েছে গাজার শিশুরা
- পশ্চিমতীরে ইসরাইলি হামলা অব্যাহত আরো ২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা

দখলকৃত পশ্চিমতীরের জেনিনে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান চলছে। পশ্চিমতীরজুড়ে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চলমান হামলা আরো তীব্র হয়েছে। বুরকিন এলাকায় ইসরাইলি হামলায় বৃহস্পতিবার রাতে দুই ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে জেনিন প্রদেশে তিন দিনের অভিযানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১২-তে।
আলজাজিরা জানায়, ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, নিহত মুহাম্মদ আবু আল-আসাদ ও কুতাইবা আল-শালাবি দু’জনই ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের সদস্য এবং চলতি মাসে কালকিলিয়া প্রদেশের ফুন্দুক গ্রামে ইসরাইলি নাগরিকদের ওপর হামলার সাথে যুক্ত ছিলেন। ওই হামলায় তিনজন ইসরাইলি নিহত ও ছয়জন আহত হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিহতদের লাশ এখনো হস্তান্তর করেনি ইসরাইল।
ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানায়, বুরকিনে অভিযানের সময় ইসরাইলি বাহিনী একটি বাড়ি ঘিরে ফেলে, সেখানে গুলি ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে পরে তা বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা হয়। বুরকিনের মেয়র হাসান সোবহ অভিযোগ করেছেন, ইসরাইলি সেনারা হামলার সময় ফিলিস্তিনি নারীদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।

এ দিকে বুধবার ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইন (ডিসিআইপি) জানায়, ১৬ বছর বয়সী মুতাজ ইমাদ মুসা আবু তাবিখকে ইসরাইলি বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে পশ্চিমতীরে ইসরাইলি হামলায় সাত কিশোর নিহত হয়েছে, যাদের চারজন ড্রোন হামলায় এবং তিনজন গুলিতে মারা যায়। ১৯৫৩ সালে উদ্বাস্তুদের আশ্রয়ের জন্য জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক স্থাপিত জেনিন শরণার্থী শিবির দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলি সামরিক অভিযানের লক্ষ্যবস্তু।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র নাদাভ শোশানি দাবি করেছেন, শিবিরটি থেকে সন্ত্রাসী হামলার প্রস্তুতি নেয়া হয়। অন্য দিকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) বলছে, এসব হামলার উদ্দেশ্য পশ্চিমতীরকে ধীরে ধীরে দখল করা। পশ্চিমতীরে ইসরাইলি হামলা ও বসতি স্থাপন কার্যক্রমে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ফিলিস্তিনি গবেষক ও অ্যাকটিভিস্ট হামজা জুবাইদাত।

আলজাজিরাকে তিনি বলেন, ইসরাইল ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোকে বিচ্ছিন্ন করছে। এতে চিকিৎসা, শিক্ষা ও পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলাফল হচ্ছে আরো দারিদ্র্য ও ভোগান্তি। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, পশ্চিমতীর, গাজা ও ফিলিস্তিনি অধিকৃত অঞ্চলগুলোর ভবিষ্যৎ ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত।
গাজায় দুই শ’ লাশ উদ্ধার : দীর্ঘ ১৫ মাসের বেশি সময় পর গত ১৯ জানুয়ারি থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর পর থেকে গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনির লাশ পাওয়া গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উপত্যকায় পাঁচ হাজার নারী ও শিশুসহ ১৪ হাজার ২০০ মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে। রয়টার্স জানায়, ফিলিস্তিনের বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার প্রধান মাহমুদ বাসল বুধবার বলেছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া প্রায় ১০ হাজার ফিলিস্তিনির লাশ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেসালের মতে, কমপক্ষে দুই হাজার ৯০০ জন সম্পূর্ণরূপে পচে-গলে গেছে। তাদের কোনো চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই। উদ্ধারকারী দল সময়মতো পৌঁছাতে না পারায় ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘উদ্ধার দল ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া আহত নাগরিকদের কাছ থেকে প্রতিদিন উদ্ধারের জন্য ফোন পেয়েছেন।’ উদ্ধারকারী দলগুলো সব ফোনের সাড়া দিতে পারেনি, কারণ ইসরাইলি বাহিনী অ্যাম্বুলেন্স ও তাদের ক্রুদের ওপরও হামলা চালিয়েছে। বেসালের মতে, যন্ত্রপাতির অভাবের কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে। ইসরাইল উদ্ধারকর্মীদের বেশ কয়েকটি যানবাহনও ধ্বংস করে ফেলেছে এবং অন্তত ১০০ কর্মীকে হত্যা করেছে।
বেসাল বলেছেন, বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা ১০০ দিনের মধ্যে লাশগুলো উদ্ধারের আশা করেছিল। তবে বুলডোজার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবের কারণে প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন অনুসারে, গাজায় ৫০ মিলিয়ন টনেরও বেশি ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে ২১ বছর সময় লাগতে পারে এবং ১.২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে।

ইউনাইটেড নেশনস স্যাটেলাইট সেন্টার (ইউএনওএসএটি) জানিয়েছে, গাজার প্রাক-যুদ্ধ কাঠামোর দুই-তৃতীয়াংশ, এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে, যা ভূখণ্ডের সব কাঠামোর প্রায় ৬৯ শতাংশ।
চরম মূল্য দিয়েছে গাজার শিশুরা : এক বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি হতাহত হয়েছে নারী ও শিশুরা। অবরুদ্ধ এই উপত্যকাকে ধ্বসস্তূপে পরিণত করেছে ইসরাইল। সেখানে মসজিদ, হাসপাতাল, স্কুল, আবাসিক ভবন এমন কোনো স্থান বাকি নেই, যেখানে ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালায়নি। খবর আলজাজিরার। গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনুসে এখন পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন রামজি নামের এক ফিলিস্তিনি। তিনি বেইত হানুনের বাসিন্দা। গাজা সঙ্ঘাতে কী কঠিন সময় পার করেছেন সেই বর্ণনা দিয়েছেন রামজি।

বেইত হানুনে ইসরাইলি হামলায় সব কিছু হারিয়েছেন রামজি ও তার পরিবার। একেবারে নিঃস্ব হয়ে তারা জাবালিয়ায় চলে যান। সেখান থেকে নুসেইরাত শরণার্থী শিবির, এরপর রাফা এবং সেখান থেকে খান ইউনুসে আশ্রয় নেন তারা। রামজি বলেন, আমরা সব কিছু হারিয়েছি। আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমরা এখন হামাস সিটির পূর্বাঞ্চলে একটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছি। রামজির দুই সন্তানই বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় ভুগছে। তিনি বলেন, আমাদের আর কিছুই নেই, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই। আমরা প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কষ্ট পাচ্ছি। গত রাতে ভারী বৃষ্টিতে সব কিছু তলিয়ে গেছে। আমরা কষ্ট পাচ্ছি। রামজি বলেন, দিনশেষে আমাদের সন্তানদের চরমমূল্য দিতে হয়েছে। আমরা জানি না যে এখন কী করব।

গাজায় যুদ্ধবিরতি চলছে। কিন্তু এমন একপর্যায়ে এসে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে যখন ফিলিস্তিনিরা পুরোপুরি নিঃস্ব। তাদের হারানোর আর কিছু বাকি নেই। তাদের মাথার ওপরের ছাদ, পায়ের নিচের মাটি, খাবার সব কিছুই কেড়ে নিয়েছে দখলদার বাহিনী। এক বছরের বেশি ধরে ইসরাইলি হামলায় ৪৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সেখানে ৪৭ হাজার ১০৭ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে আরো এক লাখ ১১ হাজার ১৪৭ জন।

 


আরো সংবাদ



premium cement