২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ মাঘ ১৪৩১, ২২ রজব ১৪৪৬
`

শীর্ষ অর্থপাচারকারীদের বিদেশে থাকা সম্পদ শনাক্তে জোর চেষ্টা

কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো
-


পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবার এবং এস আলম, বেক্সিমকো, সামিট, নাসার নজরুল ইসলাম মজুমদার, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ শীর্ষ অর্থ পাচারকারীদের বিদেশে থাকা অর্থ শনাক্তের জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোয়েন্দা ও পরামর্শ সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে। এই মুহূর্তে ঢাকায় অবস্থান করছেন যুক্তরাজ্যের ইন্টারন্যাশনাল এন্ট্রি করাপশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (আইএসিসিসি) বা আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন সমন্বয় কেন্দ্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআইএর উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা। তারা অর্থপাচারকারীদের নিয়ে যে গোয়েন্দা প্রতিবেদন রয়েছে তার দুর্বলতা তুলে ধরে এতে আরো তথ্য ও অ্যাভিডেন্স সন্নিবেশিত করতে পরামর্শ দিয়েছেন। একই সাথে যেসব ব্যাংক থেকে অর্থ পাচার হয়েছে ওই সব ব্যাংকগুলোতে আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মগুলোও কাজ শুরু করেছে। তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কি পরিমাণ অর্থ পাচারকারীরা বের করে নিয়েছে এবং ওই সব অর্থের গন্তব্য নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের কার্যক্রমের সাথে জড়িত রয়েছে এমন একটি সংস্থার সূত্র জানিয়েছে, পাচারকৃত অর্থ শনাক্তের পাশাপাশি তা দেশে ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তৎপরতা বেড়ে গেছে। একই সাথে তাদের দেশে থাকা সম্পদ দ্রুত জব্দ করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের সম্পদ কেউ কিনলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশ থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে।

আইএসিসিসির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এর লক্ষ্য হলো সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ, আত্মসাৎ, কাজের অপব্যবহার এবং অপরাধের অর্থ পাচারের মতো বড় দুর্নীতির অপরাধের তদন্তকারী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য সমন্বিত সহায়তা প্রদান করে থাকে। তারা পাচারকারীদের অর্থ কিভাবে শনাক্ত করা হয় এবং কিভাবে তা ফেরত আনা যায় সে বিষয়ে কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে। আইএসিসিসির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ থেকে যেভাবে অর্থ পাচার হয়েছে তা দেখে হতবাক হয়ে গেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে জনগণের অর্থ যে রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে দুর্নীতিবাজরা যে এভাবে পাচার করতে পারে তা দেখে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত দেড় দশকে প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ পাচারকারীদের মধ্যে রয়েছে পতিত প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য, তার মন্ত্রিপরিষদ, দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা। এসব অর্থ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। শুধু দেশের ব্যাংক খাত থেকেই এস আলম নামক ব্যাংক ডাকাত কোম্পানি পাচার করেছে তিন লাখ কোটি টাকার ওপরে। শুধু ছয় ব্যাংক থেকে বেনামে পাচার করেছে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। যার বেশির ভাগেরই সুবিধাভোগী পতিত প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা।

শীর্ষ অর্থপাচারকারীরা বিশ্বের যেসব দেশে অর্থ পাচার করেছে তা তথ্য সঠিকভাবে বের করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া যাতে সহজ হয় সেজন্য দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিদেশের অনেক সংস্থাও কাজ শুরু করেছে। বিশ্বের উদাহরণ সৃষ্টিকারী এ অর্থপাচার ঘটনা উদঘাটনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে নিজেদের পোর্টফোলিও ভারী করার জন্যও অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এরই অংশ হিসেবে এফবিআই ও আইএসিসিসি প্রতিনিধিরা বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তারা দফায় দফায় বিভিন্ন সংস্থার সাথে বৈঠকে বসছেন।
সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচারের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দেশীয় ও বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দের বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে ওইসব প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক আদালতে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার বিষয়ে কিছু দুর্বলতা রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। এসব প্রতিবেদনের দুর্বলতাগুলোকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। ওইসব দুর্বলতা কাটাতে আরো তথ্য সন্নিবেশিত করার জন্য তারা পরামর্শ দিয়েছেন। একই সাথে ব্যাংকের এভিডেন্সগুলো যথাযথভাবে বের করার জন্যও পরামর্শ দেয়া দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এ পর্যন্ত পাঁচ দেশে আট হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। শুধু যুক্তরাজ্যেই তার ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে। ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চারটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর বড় একটি অংশই পাচার করেছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বের হয়ে এসেছে। এর মধ্যে দুবাই, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড এই পাঁচ দেশেই বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। দেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের অভিশাপ এস আলম ৮টি ব্যাংক দখলে নিয়ে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা নামে বেনামে বের করে নিয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকিং খাত থেকে নামে বেনামে নেয়া ঋণের বেশির ভাগ অংশই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। এভাবে সামিট, বেক্সিমকোসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই অর্থপাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দেশ থেকে যেসব অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এস আলম, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সামিট, নাসা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপসহ শীর্ষ অর্থপাচারকারীদের দেশ বিদেশে থাকা অর্থ শনাক্ত করে তা দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ জন্য দেশ বিদেশে সব ধরনের আইনগত ও লজিস্টিক সাপোর্ট নেয়া হবে। পাশাপাশি এসব অপরাধীদের দেশে থাকা স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ শনাক্ত করে তা দ্রুত জব্দ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে অভিযোগ ছিল ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাটকারীরা দেশে থাকা তাদের স্থাবর সম্পদ বিক্রি বা হস্তান্তর করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যারা এসব সম্পদ কিনবে তা নিজ দায়িত্বেই কিনতে হবে। এর দায় দায়িত্ব কেউ নেবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এস আলমসহ অর্থপাচারকারীদের সম্পদ যারাই কিনবে তাদের বিরুদ্ধেই আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement