কৌশল ব্যর্থ হচ্ছে আ’লীগের
- মনিরুল ইসলাম রোহান
- ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ভয়াবহ পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলে রাজনীতিতে ফের পুনর্বাসনের জন্য একের পর এক কৌশল গ্রহণ করেও ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করলেও গেল সোমবার শপথ গ্রহণের দিনই এ দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করায় এখানেও বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে দলটি। এই পরিস্থিতিতে নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণেও খেই হারিয়ে ফেলছেন দলটির পালিয়ে থাকা নেতারা। অবশ্য ভবিষ্যৎ নতুন কৌশল নির্ধারণে কাজ চলছে বলে দলটির তৃণমূল ও মধ্যম সারির একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে এ তথ্য জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পতন হয় টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের। ওই দিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সব মন্ত্রী-এমপিও আত্মগোপনে চলে যান। আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারের টপ টু বটম সবাই পালিয়ে গেলেও হাল ছাড়েনি তারা। রাজনীতিতে পুনর্বাসন হওয়া ও অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য নানা কৌশল বেছে নেয় দলটির ঘাপটি মেরে থাকা সুবিধাভোগীরা। নেতারা কেউ প্রকাশ্যে রাজনীতির মাঠে না এলেও নীলনকশা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের ছায়া হয়ে কাজ করছেন তাদের দোসর সরকারি-বেসরকারি পদস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তা ও দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এসবের পেছনে খোদ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাসহ শেখ পরিবারের ডজনখানেক নেতা ভারতে অবস্থান করে কলকাঠি নাড়ছেন বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সম্প্রতি মধ্যরাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে ভয়াবহ আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডে ওই ভবনের ষষ্ঠ থেকে নবমতলা পর্যন্ত সব কিছু পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। সচিবালয়ের মতো সুরক্ষিত জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সন্দেহের তীর এখন আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী আমলাদের দিকে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে মন্ত্রী-এমপিরা পলায়ন করলেও সচিবালয়ে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন আওয়ামী লীগের দোসর সেই আমলারা। অন্তর্বর্তী সরকার হাতেগোনা দু-চারজন আমলাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালেও বেশির ভাগই স্বপদে বহাল রয়েছেন, আবার কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়ে নতুনরূপে প্রভাব খাটাচ্ছেন। আবার কারো কারো দফতর বদল হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ওই আমলারা মিলেমিশে একাকার হয়ে কাজ করছেন এবং ভেতরে ভেতরে সেই আগের প্রভাবই খাটাচ্ছেন তারা। বলা যায়, আওয়ামী লীগের দোসর আমলাদের হাতে শুধু সচিবালয় নয়, পুরো রাষ্ট্রেরই নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। তাদের ওপর ভর করেই আওয়ামী লীগ কর্মকৌশল নির্ধারণ করে বাস্তবায়নের পথে আগায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এই ক’মাসে সংঘটিত গ্রাম-পুলিশ আন্দোলন, আনসারদের আন্দোলন, বিভিন্ন দাবিতে সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের আন্দোলন, ইসকন ইস্যু, পল্লীবিদ্যুৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষসহ বিভিন্ন দাবিতে সচিবালয়ের আশপাশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও বাহিনীর চলা আন্দোলনের পেছন থেকে কলকাঠি নাড়েন আওয়ামী লীগ নেতারা। ওই সব আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার কৌশল বেছে নিলেও সরকারের কঠোরনীতির কারণে তা ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। আলোচনা আছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই ১০ আগস্ট জুডিশিয়াল ক্যুর মাধ্যমে ফের ক্ষমতায় ফিরতে চেয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। ওই ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে তা আর সম্ভব হয়নি। সেটা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ১৫ আগস্ট নিয়মিত কর্মসূচির আড়ালে ঢাকায় সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের জড়ো করে একটি ‘প্রতিবিপ্লব’ করার পরিকল্পনা করে আওয়ামী লীগ। এ জন্য তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং আওয়ামী ঘনিষ্ঠ আমলাসহ প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মকর্তার সাথে ভারত থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন এবং বিভিন্ন নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। ওই ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী আর্থিক থেকে সেবা খাত, শিক্ষা থেকে সুরক্ষা খাত, প্রশাসনিক থেকে আইনশৃঙ্খলা-সবখানেই একটি অস্থিরতা তৈরির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য সুকৌশলে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়েন সুবিধাভোগী আমলারা। যদিও ছাত্র-জনতার অব্যাহত প্রতিরোধের মুখে ওই সব পরিকল্পনাও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
এ দিকে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব উসকে দেয়ার মিশনেও আওয়ামী লীগ ভেতরে ভেতরে পরিকল্পনা করছে। এখনো দেশের বিভিন্ন গ্রাম-পাড়া-মহল্লায় অব্যাহতভাবে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ লেগে আছে। এসবের পেছনেও আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ কলকাঠি নাড়ছেন এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ মারমুখী হয়ে উঠছেন। এ দিকে ৫ আগস্টের পর গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোর পরিবেশ অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘মব জাস্টিসের’ ধোঁয়া তুলে শিক্ষার্থীদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। নতুন বছরের শুরু থেকেও দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ভয়াবহ ছক কষছে আওয়ামী লীগ। বোল পাল্টে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে মিশে যাওয়া আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী আমলা, পুলিশ প্রশাসন ও পদস্থ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সেই ছক বাস্তবায়নের নয়া কৌশল নেয়া হচ্ছে বলে আশঙ্কা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় দল ও সরকারের মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা রাখা সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত একটি বিদেশী গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যাদের সমর্থন জুগিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন সেটি করবে না বলেই তারা মনে করছেন।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো: ইসমাইল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য আওয়ামী লীগ যদি কোনো নাশকতা করে থাকে তাহলে প্রমাণ দিতে হবে। যেমন সচিবালয়ে আগুন লেগেছে, জাহাজে আগুন লেগেছে এগুলো যদি বলা হয় আওয়ামী লীগ করেছে তাহলে এর পক্ষে প্রমাণ থাকতে হবে। তদন্ত কমিটি কী করছে? তারা তো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাইডেন বিদায় নিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শপথ নিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কিছু নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের পলিসি চেঞ্জ হবে এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। বিশ্বেও বড় বড় দেশের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের বিষয়ে পলিসি চেঞ্জ করতে গেলে এটি নিয়ে তাদের বিভিন্ন পরিসরে আলোচনা করতে হয়। সেটি আবার বাংলাদেশের কোনো দলের কথায় তারা প্রভাবিত হয়ে পলিসি পরিবর্তন করবে এমনটাও নয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা