২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮ মাঘ ১৪৩১, ২১ রজব ১৪৪৬
`
বিবিসির প্রতিবেদনে নানা প্রশ্ন

টিউলিপ প্রসঙ্গ পিছু ছাড়ছে না স্টারমারের

-

গুম, খুন, দুর্নীতি আর লাখ লাখ কোটি টাকা পাচারের কেলেঙ্কারিতে শেখ হাসিনার শাসনামল কলঙ্কিত ছিল। শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের যে খালার সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সে বিষয়ে অনেক আগে থেকে জানার পরও লেবার পার্টি সতর্ক হতে পারেনি কেন তা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ মিডিয়া। বিবিসির রাজনৈতিক ও তদন্ত সংবাদদাতা জো পাইকের প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কেন হাসিনার সাথে দেখা করেছিলেন স্টারমার।
বিবিসির প্রখ্যাত এই সাংবাদিক তার প্রতিবেদন শুরু করেছেন বাংলাদেশী ব্যারিস্টার আরমানকে (আহমাদ বিন কাসেম) কিভাবে গুম করা হয়েছিল তার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে। তিনি সেই ঘটনা তুলে ধরে বলেন, মীর আহমাদ বিন কাসেমকে যখন রাতে সশস্ত্র ব্যক্তিরা বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, তখন সেখানে তার চার বছর বয়সী মেয়েও ছিল। কিন্তু সে এত ছোট ছিল যে বুঝতেই পারেনি কী ঘটতে চলেছে। ‘তারা আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি ছিলাম খালি পায়ে, ছোট মেয়েটা আমার জুতা হাতে নিয়ে পিছু পিছু দৌড়ে আসছিল। বলছিল, ‘নাও, বাবা।’ মনে হয়, সে ভাবছিল, আমি বাইরে যাচ্ছি।’ ৪০ বছর বয়সী আহমাদ বিন কাসেমকে আট বছর নির্জন কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছিল হাতকড়া পরা অবস্থায় চোখ বেঁধে। ৫ আগস্টের পর মুক্তি পান তিনি।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা হাসিনার শাসনামলেই ঘটেছে। এই সহিংসতায় শত শত মানুষ নিহত হয়, যার মধ্যে অন্তত ৯০ জন নিহত হয় তার ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার দিন।
কিয়ার স্টারমার সরকারের তদন্তে মন্ত্রিত্বের আচরণগত নীতিমালা টিউলিপ ভাঙেননি বলে দেখা গেছে। তবে যেকোনোভাবেই হোক পদত্যাগ করেছেন তিনি। যদিও বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার নয়। জো পাইক তার প্রতিবেদনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কাছে প্রশ্ন তুলে বলেন, এ ঘটনা তার বিবেচনাবোধ ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের ভোট আকর্ষণে লেবার পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যন্ত্রণাদায়ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলোর একটি হলো, কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া খালার সাথে টিউলিপের যে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সে বিষয়ে অনেক আগে থেকে জানার পরও লেবার পার্টি এখনকার সম্ভাব্য পরিণতি আঁচ করতে পারল না কেন। কেননা হাসিনার আমলে সেই ২০১৬ সালেই বিন কাসেমের ঘটনা প্রথম প্রকাশ্যে এসেছিল।
অনেক বছর আগেই এ নিয়ে (টিউলিপের ব্যাপারে) লেবার পার্টির কারো না কারো উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত ছিল। টিউলিপকে নিয়ে প্রথম অনাবিষ্কৃত উদ্বেগের ক্ষেত্র ছিল, বাংলাদেশে জোর করে গুমের ঘটনায় তার সাড়া দেয়ার ব্যর্থতার বিষয়টি। এরপরের ক্ষেত্রটি ছিল আওয়ামী লীগের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি। তার খালার শাসনামলে মানুষ ‘নিখোঁজ’ হয়েছিল, তাহলে স্টারমার কেন তাকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন?
দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ অস্বীকার করার পর টিউলিপ সিদ্দিক জুলাই থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমন মন্ত্রী ছিলেন। এর মধ্যে দাবি করা হয়েছে যে, সিদ্দিকের পরিবার বাংলাদেশে অবকাঠামোগত ব্যয় থেকে ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত আত্মসাৎ করেছে এবং লন্ডনে তিনি তার খালার সহযোগীদের দেয়া সম্পত্তি ব্যবহার করেছেন। পরে অবশ্য সরকারের নীতিশাস্ত্র পর্যবেক্ষণ সংস্থা আবিষ্কার করে যে তিনি মন্ত্রীর কোড ভঙ্গ করেননি, তবে সিদ্দিক পদত্যাগ করেছেন। যদিও বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। সিদ্দিকের বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ক্রমাগত প্রশ্নের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
এফটির (ফিন্যান্সিয়াল টাইমস) বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, ব্রিটেনে কমপক্ষে ১৭টি নির্বাচনী এলাকা রয়েছে, যেখানে ভোটার হওয়ার বয়সের বাংলাদেশী জনসংখ্যা লেবার সংখ্যাগরিষ্ঠের চেয়ে বেশি। স্টারমারের হলবর্ন ও সেন্ট প্যানক্রাস নির্বাচনী এলাকায় কমপক্ষে ছয় হাজার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রাপ্তবয়স্ক বাসিন্দা রয়েছে। এই উষ্ণতা ও রাজনৈতিক বাস্তববাদের মিশ্রণ কি সম্ভাব্য দুর্নীতির ঝড় থেকে স্টারমারের বিচারবুদ্ধিকে অন্ধকার করে দিয়েছিল? না হয় কেন জুলাই মাসে নির্বাচনে জয়লাভের পরপরই তিনি সিদ্দিককে ব্রিটেনের ট্রেজারি মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন? লেবার পার্টির একটি সূত্র বলে, এটি নতুন কিছু নয়। স্টারমারের বন্ধু এবং রাজনৈতিক মিত্রদের জন্য কিছু গোপন বিষয় রয়েছে।
যে কারণে স্টারমারকে নিয়ে প্রশ্ন : লেবার পার্টি দীর্ঘদিন ধরেই সিদ্দিকের সাথে তার কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত খালার যোগসূত্র সম্পর্কে অবগত ছিল। ২০১৬ সালে বিন কাসেমের মামলাটি প্রথম তার সাথে উত্থাপিত হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে, নিজ নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা নাজানিন জাঘারি রথ্যাটক্লিফকে ইরান থেকে মুক্ত করার জন্য দীর্ঘ প্রচার চালিয়েছেন টিউলিপ। বিপরীতে বাংলাদেশে তার খালার শাসনামলে লোকজনের দুঃখদুর্দশা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনসমক্ষে বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে তার নির্লিপ্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অতীতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে তার খালার বৈঠকে টিউলিপকে পাশে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হয়ে বিবিসি টেলিভিশনেও হাজির হয়েছেন তিনি। তার খালা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল থেকে দলটির নেতৃত্বে দিয়ে আসছেন। ২০১৫ সালে লেবার পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হতে সহায়তা করায় আওয়ামী লীগের সদস্যদের ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন টিউলিপ। দলটির সাথে নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি ২০০৮ ও ২০০৯ সালে তার ওয়েবসাইটে দুই পৃষ্ঠাজুড়ে বর্ণনা দেন। পরে অবশ্য তা মুছে ফেলা হয়। যদিও এক সময় পার্লামেন্টে টিউলিপ সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব খাটানোর কোনো সক্ষমতা বা আকাক্সক্ষা তার নেই।
সব মিলিয়ে, আওয়ামী লীগের সাথে টিউলিপের সংশ্লিষ্টতা গোপন ছিল না। তবে সম্ভবত লেবার পার্টি এ সংশ্লিষ্টতাকে খারাপ হিসেবে দেখেনি। এ জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আওয়ামী লীগের সাথে দলটির দূরত্ব বজায় রাখার লক্ষণ খুব কমই দেখা গেছে। তৎকালীন লেবার পার্টির এমপি জিম ফিজপ্যাট্রিক ২০১২ সালে কমন্স সভায় বলেছিলেন, তারা ‘সহযোগী সংগঠন’। একই রকম ধারণা পোষণ করতেন তার অনেক সহকর্মীও। ২০১৫ সালে স্টারমারও টিউলিপের পাশের আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন। একাধিকবার হাসিনার সাথে দেখা করেছেন তিনি।
হাসিনার সাথে স্টারমারের সাক্ষাৎ ঘটেছিল ২০২২ সালে। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওই সময় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে লন্ডনে ছিলেন। তবে স্টারমারের একজন সহযোগী যুক্তি দিয়ে বলেন, হাসিনার সাথে স্টারমারের ওই সাক্ষাৎ ছিল ‘খুবই যৌক্তিক’। আর বৈঠকটি হাসিনার নীতির প্রতি তার সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ছিল না।
বাংলাদেশকে বছরের পর বছর লেবার পার্টির পাশে রাখার এমন চেষ্টা হয়তো ছিল ব্রিটেন, বিশেষ করে রাজধানী লন্ডনের অংশবিশেষের রাজনৈতিক বাস্তবতারই প্রতিফলন।
ডেভিড বার্গম্যান, অনুসন্ধানী সাংবাদিক : এক দশক ধরে বাংলাদেশী রাজনীতির সাথে টিউলিপের সংযোগের ওপর আলোকপাত করে আসা অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান উল্লেখ করেছেন যে, প্রেক্ষাপটই সবকিছু। লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে ও টিউলিপ মন্ত্রী হওয়ার আগে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এটি কোনো বড় গল্প ছিল না।
বার্গম্যান যুক্তি দেন যে, দলের কারো অনেক বছর আগে উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত ছিল। প্রথমে টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়ে কার্যত অন্ধ ছিলেন। তারপরে তিনি ব্রিটেনে আওয়ামী লীগের সাথে কতটা জড়িত ছিলেন সে সম্পর্কে চেপে গিয়েছেন। যখন আমি একজন লেবার এমপির কাছে এই কথাটি বললাম, তারা জবাব দিলেন যে, ব্রিটিশ মিডিয়া, সেইসাথে লেবার এবং বাংলাদেশকে অন্ধ করে রেখেছে। তাদের একজন বলেন, ব্রিটেনে বাঙালি প্রবাসীর প্রায় ছয় লাখ। এটি পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ, তবুও ৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে আমরা [যুক্তরাজ্যের মিডিয়া থেকে] একটিও কথা শুনতে পাইনি।
হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত কিছুদিন ধরে চলতে পারে, যা স্টারমারের দলকে আগামী মাসগুলোতে আরো সমস্যা সামনে নিয়ে আসবে, যতক্ষণ টিউলিপ সিদ্দিক লেবার এমপি থাকবেন।


আরো সংবাদ



premium cement
বিশ্বকাপের সুপার সিক্সে বাংলাদেশ কারওয়ান বাজার থেকে মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীদের সরিয়ে দিলো পুলিশ আড়াইহাজারে অটোরিকশা উল্টে নিহত ১ রোনালদোর জোড়া গোলে আল নাসেরের জয় ঢাবিতে গাছ থেকে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার ইউক্রেন চুক্তি না হলে রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে : ট্রাম্প জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন সারজিস ডার্কওয়েব সিল্ক রোডের উদ্ভাবক রস উলব্রিক্টকে ক্ষমা ট্রাম্পের বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে বোমা হামলার হুমকি, নিরাপদে অবতরণ লন্ডন ক্লিনিকে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিসে’ চলবে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ট্রাম্পের শুল্কারোপের জবাব দেবে কানাডা

সকল