বাড়ির ধ্বংসস্তূপে ফিরছেন ফিলিস্তিনিরা
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৬
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতকামী সংগঠন হামাসের হাতে আটক তিন ইসরাইলিকে ছেড়ে দেয়ার পর ইসরাইলও তাদের কারাগারে বন্দি থাকা ৯০ ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুকে মুক্তি দিয়েছে। স্থানীয় সময় সোমবারের প্রথম প্রহরে বা রাত ১টার দিকে রেডক্রসের বাস তাদেরকে পশ্চিম তীরের রামাল্লায় নিয়ে আসে বলে জানিয়েছে আলজাজিরা। কোনো ধরনের উদ্যাপন থাকবে না ইসরাইলি বাহিনীর এমন সতর্কতা সত্ত্বেও আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব আর সমর্থকসহ হাজারো উচ্ছ্বসিত মানুষের বিশাল এক ভিড বাড়ি ফিরে আসা এ ফিলিস্তিনিদের বরণ করে নেয়। এদিকে ১৫ মাসের ইসরাইলি আগ্রাসনে উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিরা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। কিন্তু অনেক আশা নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফেরা ফিলিস্তিনিদের জন্য অপেক্ষা করছে শুধুই ধ্বংস স্তূপ। আলজাজিরা, রয়টার্স ও বিবিসি।
যুদ্ধবিরতির প্রথম দিনে দখলকৃত পশ্চিম তীর ও জেরুসালেমের ৬৯ নারী ও ২১ কিশোর বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরাইল। কিশোরদের কারো কারো বয়স মাত্র ১২। মুক্তি পাওয়া নারীদের মধ্যে আছেন ৬২ বছর বয়সী খালিদা জারারও। বামপন্থী পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের শীর্ষস্থানীয় এ সদস্যকে ‘প্রশাসনিক আটকাদেশ’-এর আওতায় ছয় মাস নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছিল। ‘প্রশাসনিক আটকাদেশ’ এর আওতায় ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ বা আদালতের রায় ছাড়াই সন্দেহভাজন যে কাউকে জেলে আটকে রাখতে পারে।
আছেন সাংবাদিক বুশরা আল-তাউইলও, ইসরাইল যাকে ২০২৪ সালের মার্চে জেলে পাঠিয়েছিল। খালিদা, বুশরাসহ গভীর রাতে ইসরাইলের কারাগার থেকে মুক্ত ৯০ নারী-শিশু দখলকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় এসে পৌঁছালে আবেগাপ্লুত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা মুক্ত ফিলিস্তিনিদের কাউকে কাউকে কাঁধেও তুলে নেন; কারো চোখে পানি, চলছে কোলাকুলি। উপস্থিত অনেকের হাতে এ সময় হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া গোষ্ঠীগুলোর পতাকাও ছিল।
আলজাজিরা জানায়, ২০২৩ সালের নভেম্বরের পর হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে এবারই প্রথম বন্দী বিনিময় হলো। এবার যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ঠিক কত ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়া হবে তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সংখ্যাটা এক হাজার থেকে দুই হাজারের কাছাকাছি হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। চুক্তির প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহে হামাস মোট ৩৩ ইসরাইলি বন্দীকে মুক্তি দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বন্দী মুক্তির পরবর্তী দিন শনিবার । দুই সপ্তাহের মধ্যে চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। ২০২৩ সালের অক্টোবরে আগ্রাসন শুরুর পর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৫ মাসে ইসরাইলের হামলায় প্রায় ৪৭ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তেলআবিবের হামলা ও বাড়ি ছাড়ার নির্দেশনায় গাজার জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশকে হতে হয়েছে বাস্তুচ্যুত।
রাফাহতে ফেরার স্বপ্নে ধ্বংসস্তূপের বাস্তবতা : যুদ্ধবিরতি শুরুর পর বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার গাজাবাসী তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে শুরু করেছেন। সেখান থেকে তোলা বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে, লাইন ধরে বাড়ির পথে হাঁটছেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। প্রকাশিত ছবিতে পোশাক এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বহনকারী লোকদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। কেউ আবার গাড়ির কনভয়ে চড়ে বাড়ির পথে ফিরছেন। কিছু গাড়ি আবার ফিলিস্তিনি পতাকাধারী লোকে পূর্ণ রয়েছে।
আলজাজিরা আরো জানায়, ১৫ মাসের ইসরাইলি আগ্রাসনের পর ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার রাফাহ শহরে নিজেদের বাড়িতে ফেরার আশায় ছিলেন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল শুধুই ধ্বংসস্তূপ।
৫৩ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি কৃষক আব্দ আল-সাত্তার রাফাহতে দু’টি বাড়ির মালিক ছিলেন। নয় মাস আগে ইসরাইলি বাহিনীর আক্রমণের পর থেকে তিনি উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছিলেন। আশায় ছিলেন, একটি বাড়ি যদি ধ্বংস হয়, তবে অন্য বাড়ি তার পরিবারের আশ্রয় হয়ে উঠবে। কিন্তু রবিবার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগেই তিনি তার বড় ছেলে মোহাম্মদকে সাথে নিয়ে ফিরে দেখেন তাদের দু’টি বাড়িই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির আগে রাফাহতে বহু পরিবার ফিরতে শুরু করে। তারা গাড়ি, গরুর গাড়ি আর বাইকে করে তাদের কিছু সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হয়। তাদের অনেকেই ধ্বংসাবশেষে অস্থায়ীভাবে ক্যাম্প গড়ে তোলে। পথ চলার সময় কেউ কেউ স্লোগান দেয়, ‘আমরা আবার গড়ব। আমরা বাঁচব।’ কিন্তু অনেকের জন্য ফেরার আনন্দ অচিরেই পরিণত হয় হতাশায়।
জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ মাস ধরে ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজার ৬০ শতাংশ ভবন আর ৬৫ শতাংশ রাস্তা ধ্বংস হয়েছে। রাফাহ শহরের মেয়র মোহাম্মদ আল-সুফি বলেন, শহরের ৭০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। শহর এখন বাসযোগ্য নয়। রাফাহ অঞ্চলের ফিলাডেলফি করিডর শহরের ১৬ শতাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এটি এখনো জনসাধারণের জন্য বন্ধ। পূর্ব রাফাহতে বিশাল অংশও চলাচলের অনুপযোগী। রাফাহতে ফিরে আসা অনেকেই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে খানের ইউনিসে আশ্রয় নিয়েছেন। এক বাসিন্দা বলেন, রাফাহ এখন কবরস্থানের মতো। এখানে জীবনযাপন অসম্ভব। তবুও, রাফাহতে অনেক পরিবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাদের শহর পুনর্গঠনের। এক বাবা বলেন, আমরা অনেক সহ্য করেছি। রাফাহই আমাদের ঘর। আমরা আবার গড়ব, যত সময়ই লাগুক।
প্রথম দিন গাজায় সাড়ে ৫ শতাধিক ত্রাণবাহী ট্রাক : ইসরাইলি বাহিনীর ভয়াবহ সামরিক অভিযানে বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির প্রথম দিন প্রবেশ করেছে ৫৫২টি খাদ্য ও জরুরি ত্রাণবাহী ট্রাক। গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা তুরস্কের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তাসংস্থা আনাদোলু এজেন্সিকে নিশ্চিত করেছেন এ তথ্য।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘রোববার সারা দিনে রাফা ও অন্যান্য সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে মোট ৫৫২টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে। ট্রাকগুলোতে গাজার বাসিন্দাদের জন্য জ্বালানি, ময়দা, চিকিৎসাসামগ্রী, শাকসবজি, মাংস ও অন্যান্য জরুরি ত্রাণ পাঠিয়েছে। এ ট্রাকগুলোর মধ্যে ২৪২টিকে উত্তর গাজায় পাঠানো হয়েছে।’ ইসরাইলি বাহিনীর ১৫ মাসের অভিযানে গাজার উত্তরাঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আগের দিন শনিবার গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের সহায়তা প্রদানের জন্য জাতিসঙ্ঘের সংস্থা আনরোয়া জানিয়েছিল, গাজার রাফা ও কারাম আবু সালেম ক্রসিংয়ের কাছে প্রবেশের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে চার হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক। সামনের দিনগুলোতে গাজায় আরও ট্রাক প্রবেশ করবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের পক্ষে বাইডেনের সাফাই : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর গত ১৫ মাস ধরে চালানো বর্বর হামলাকে ‘অত্যন্ত সফল’ বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ অভিযানের জেরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ‘আমূল পরিবর্তন’ আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। রোববার ছিল প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শেষ পূর্ণ কার্যদিবস। এ দিন সাউথ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের নিউ চার্লসটন শহরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাইডেন বলেন, ‘সীমাহীন যন্ত্রণা, ধ্বংস ও প্রাণহানির পর আজ থেকে গাজায় কামান-বন্দুকের শব্দ বন্ধ হলো। গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান অত্যন্ত সফল। কারণ এ অভিযানের জেরে হামাস একদিকে নিজের শীর্ষ নেতাদের হারিয়েছে, অন্য দিকে হামাসকে যারা অর্থ ও অস্ত্রসহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে, তাদেরও প্রায় কোমরভাঙা অবস্থা। হামাসের সবচেয়ে বড় সমর্থক ও সহায়তাকারী গোষ্ঠী ছিল হিজবুল্লাহ। এ যুদ্ধে হিজবুল্লাহ তার শীর্ষ নেতৃত্বকে হারিয়ে প্রায় তছনছ হয়ে গেছে। গোষ্ঠীটি আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে হামাসকে আর তারা সহায়তা করবে না। লেবাননে আমরা বহু বছর ধরে একটি কূটনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে চাইছি। সেই চেষ্টা আমাদের এখনও রয়েছে, কিন্তু এটিও সত্য যে লেবাননে সামরিক অভিযানে আমরা ইসরাইলকে সহায়তা করেছি।’
গাজা দখল না করলে সরকার উৎখাতের হুমকি নেতানিয়াহুর মন্ত্রীর : দীর্ঘ ১৫ মাসে প্রায় ৪৭ হাজার মানুষের প্রাণহানির পর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও হুমকি যেন এখনো থেকেই যাচ্ছে। ইসরাইলের উগ্র-কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ হুমকি দিয়েছেন, গাজা উপত্যকা দখল না করলে সরকার উৎখাত করা হবে। একইসঙ্গে চরমপন্থী এ মন্ত্রী গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে ‘খুব গুরুতর ভুল’ এবং ‘হামাসের কাছে আত্মসমর্পণ’ বলেও অভিহিত করেছেন। এ তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু। ইসরাইলের চরমপন্থী অর্থমন্ত্রী আর্মি রেডিওকে বলেন, ইসরাইলকে অবশ্যই গাজা দখল করে একটি অস্থায়ী সামরিক সরকার গঠন করতে হবে কারণ হামাসকে পরাজিত করার অন্য কোনও উপায় নেই। তার ভাষায়, আমি সরকারকে উৎখাত করব যদি তারা যুদ্ধে ফিরে না যায়। এর আগে, উগ্র ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির গাজা যুদ্ধবিরতির পর ক্ষমতাসীন জোট থেকে তার দলকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। সরকার থেকে বেন-গভিরের দল বেরিয়ে যাওয়ার পর ক্ষমতাসীন জোট এখনো ১২০ আসনের নেসেটে ৬২টি আসন নিয়ে টিকে আছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা