২০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬ মাঘ ১৪৩১, ১৯ রজব ১৪৪৬
`

গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর

৩ ইসরাইলি পণবন্দীর মুক্তি : বিধ্বস্ত উপত্যকা পুনর্গঠনই বড় চ্যালেঞ্জ
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘরে ফেরেন : মিডলইস্টআই -


ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নির্ধারিত সময়ের পৌনে তিন ঘণ্টা পর স্থানীয় সময় গতকাল রোববার বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে (৯টা ১৫ জিএমটি) বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এই চুক্তির অন্যতম মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার এ কথা নিশ্চিত করেছে। হামাস তিন বন্দীর নাম ইসরাইলি কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে। গতকালই তাদের মুক্তি দেয়ার কথা। তিন বন্দীর নাম প্রকাশ করেছেন হামাসের সশস্ত্র শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু ওবেইদা। তিনি বলেন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আমরা আজ তিনজনকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারা হলেনÑ রোমি গোনেন (২৪), এমিলি দামারি (২৮) ও দোরোন স্টেইনব্রিচার (৩১)। আলজাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স, আনাদোলু ও আই নিউজ।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে হামলা চালায়। তাতে এক হাজারের বেশি ইসরাইলির মৃত্যু হয়। এর জবাবে ইসরাইল গাজায় সর্বাত্মক হামলা শুরু করে। একতরফা হামলায় গত ১৫ মাসে প্রায় ৪৭০০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়।
এ দিকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতে পৌনে তিন ঘণ্টা দেরি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়েও গাজায় ইসরাইলের হামলা অব্যাহত ছিল। গতকাল সকালে ইসরাইলের বিমান হামলায় ভূখণ্ডটির অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা। অন্য দিকে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিরোধিতা করে পদত্যাগ করেছেন ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গাভির। দেশটির উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মভিত্তিক দল জিউইশ পাওয়ার পার্টির নেতা তিনি।
এর আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় তিন ঘণ্টা বিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে বলে ঘোষণা দেয়। বিবিসি জানিয়েছে, রোববার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যুদ্ধবিরতির প্রথম দিন হামাস কোন কোন বন্দীকে মুক্তি দেবে তার তালিকা না পেয়ে ইসরাইল যুদ্ধবিরতি কার্যকরের সময়সীমা পিছিয়ে দেয়। হামাস সে সময় বলেছিল, কারিগরি জটিলতায় তারা নাম দিতে পারছে না। তবে অল্প সময় পরেই তারা তিন নারী বন্দীর নাম প্রকাশ করে। পরে ইসরাইল সরকারের দাফতরিক এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রথম ধাপে মুক্তি পেতে যাওয়া ৩৩ বন্দীর ছবি ও নাম প্রকাশ করা হয়।

নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারি : ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা নস্যাৎ হলে তার বাহিনী ফের ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে প্রস্তুত। যুদ্ধবিরতি শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন বলে জানিয়েছে বিবিসি। নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেন, এই যুদ্ধবিরতি ‘স্বল্প সময়ের’ এবং ইসরাইল গাজায় ফের হামলার অধিকার রাখে, তাতে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনও থাকবে। আমরা মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা বদলে দিয়েছি। হামাস এখন সম্পূর্ণ একা, বলেন তিনি। চুক্তির লঙ্ঘন বরদাস্ত করবে না ইসরাইল, বলেছিলেন তিনি।

সরকার ছাড়লেন বেন-গভির : ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের উগ্র-ডানপন্থী রাজনৈতিক দল জিউইশ পাওয়ার (ওতজমা ইয়েহুদিত) রোববার গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকরের সাথে সাথে ইসরাইলি সরকার থেকে পদত্যাগ করেছে। হারেৎজ পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বেন-গভির ও তার দলের অন্যান্য মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে তাদের পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। দলের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই মুহূর্ত থেকে ওতজমা ইয়েহুদিত আর জোটের সদস্য নয়।
তারা পদত্যাগের কারণ হিসেবে সরকারের গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন ও ইসরাইলি কারাগার থেকে শত শত ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্তকে উল্লেখ করেছে। বেন-গভিরের দলের প্রত্যাহারের পরও ১২০ আসনের নেসেটে ক্ষমতাসীন জোট ৬২টি আসন নিয়ে টিকে আছে।

অবিস্ফোরিত বোমা : গাজায় ইসরাইলের ফেলা হাজার হাজার বোমা এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে অবিস্ফোরিত অবস্থায় চাপা রয়েছে, যেগুলো অপসারণ করতে প্রায় এক দশক সময় লেগে যেতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা। জাতিসঙ্ঘের বরাত দিয়ে আলজাজিরা ও আই নিউজের খবরে বলা হয়েছে, গাজা থেকে চার কোটি ২০ লাখ টনের বেশি ধ্বংসাবশেষ সরাতে হবে। এতে সময় লেগে যেতে পারে ১০ বছর; আর অর্থ লাগবে প্রায় ৭০ কোটি ডলার।
বিভিন্ন দেশে অবিস্ফোরিত বোমা অপসারণের কাজ করে ব্রিটেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘মাইন অ্যাডভাইজরি গ্রুপ’ (এমএজি)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (প্রোগ্রাম) গ্রেগ ক্রোদার মনে করেন, ‘অবিস্ফোরিত এসব বোমা অপসারণ কিংবা নিষ্ক্রিয় করতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগবে। খরচ হবে কোটি কোটি ডলার।’ এসব বোমায় হতাহতের ঝুঁকির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অনেকেই আছেন, যারা যথাযথ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন না।
তারা বাড়িতে যাবেন; একটি ট্রাক ভাড়া করবেন এবং হাত দিয়েই ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু করে দেবেন। এ সব কাজে অনেক শিশুও হাত লাগাবে, যেটা আরেকটা বড় ভয়ের ব্যাপার। এনভায়রনমেন্টাল কোয়ালিটি অথরিটি অব প্যালেস্টাইনের বরাতে আলজাজিরা বলছে, গাজায় অন্তত ৮৫ হাজার টন বোমা ফেলেছে ইসরাইলি বাহিনী। এর মধ্যে অনেক বোমাই ধ্বংসস্তূপের নিচে অবিস্ফোরিত অবস্থায় চাপা পড়ে আছে।

গ্রেগ ক্রোদার মনে করেন, প্রধান সমস্যা হলে, গাজা পুনর্গঠন করতে অনেক সময় লেগে যাবে। এর মানে হলো, সেখানে মৌলিক সেবাগুলো পুনরায় চালু হতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। শত শত তো অবশ্যই, খুব সম্ভবত হাজার হাজার বোমা অবিস্ফোরিত রয়ে গেছে। এমন আশঙ্কার ব্যাখ্যায় তিনি ২০০৮ সালের উদাহরণ তুলে ধরেন। বলেন, ওই সময় গাজায় চার সপ্তাহ যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী দুই বছর অবিস্ফোরিত বোমার মাধ্যমে তিন শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, গাজা ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহর, যেখানে ১৫ মাস অনবরত বোমা ফেলা হয়েছে। সম্মুখ লড়াইও চলেছে সেখানে। গাজা কতটা দূষিত হয়েছে, সেটা নির্ণয় করা সত্যিই জটিল ব্যাপার। কারণ ভবনগুলো ধসে পড়েছে এবং অবিস্ফোরিত বোমাগুলো কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে আছে। কী পরিমাণ বোমা অবিস্ফোরিত থাকতে পারে, সেটির ধারণা দিতে গিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলছেন, বিস্ফোরিত না হওয়ার ঘটনা সাধারণত শহর অঞ্চলেই বেশি ঘটে। গাজায় সেটা ১০ থেকে ৩০ শতাংশ হতে পারে। তবে এটি মূলত নির্ভর করে বোমার ধরনের ওপর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বোমা নিষ্ক্রিয় কিংবা অপসারণ করা বেশ জটিল। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতাকে অপরিহার্য বলছেন তারা। ক্রোদার বলেন, এই কাজে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। কারণ এতে অনেক ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি এবং দক্ষ লোকবল প্রয়োজন। ‘এ ছাড়া ইসরাইলের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তহবিলও পেতে হবে।’
গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা পুনর্গঠনেও দীর্ঘ সময় চলে যাবে। সেখানে সেইভ দ্য চিলড্রেনের হয়ে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মী বেকি প্লাট বলছেন, গাজার এমন চেহারা এর আগে কখনো দেখিনি। অল্প সময়ের মধ্যে গাজা কিভাবে পুনর্গঠন করা হবে, তা আমি কল্পনাও করতে পারছি না।

 


আরো সংবাদ



premium cement