২০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬ মাঘ ১৪৩১, ১৯ রজব ১৪৪৬
`
এস আলমের ব্যাংক ডাকাতির অভিনব চিত্র

সারা দেশেই ছিল হুন্ডির নেটওয়ার্ক

-


প্রবাসে থাকা শ্রমিক কর্মচারীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা হতো। বিপরীতে দেশে থাকা প্রবাসীদের সুবিধাভোগীদের সমপরিমাণ নগদ অর্থ পরিশোধ করা হতো। এ অর্থের জোগান দেয়া হতো ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে নগদ অর্থ উত্তোলন করে। আর এ জন্য ব্যবহার করা হতো বিকাশের কিছু এজেন্ট ও মানিচেঞ্জারদের। এভাবে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের সারা দেশেই ছিল হুন্ডির নেটওয়ার্ক। এর ফলে দেশে রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এস আলমের ব্যাংক ডাকাতির এই অভিনব চিত্র বের হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী এভাবে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে এস আলমের কর্মচারীদের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা নগদ অর্থ উত্তোলন করা হয়। শাখা ব্যবস্থাপক অর্থ উত্তোলনকারী, প্রকৃত সুবিধাভোগী এবং টাকার গতিপ্রবাহ আড়াল করার উদ্দেশ্যেই বিপুল অঙ্কের নগদ উত্তোলনে গ্রাহকের কোনো পরিচিতিপত্র বা কেওয়াইসি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিকাশ এজেন্টের নামে আন্তঃশাখা লেনদেন বা আইবিসিএ ইস্যুর বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শাখায় পরিচালিত এস আলমের ৫ বেনামি প্রতিষ্ঠান যেমন- ফেমাস ট্রেডিং করপোরেশন, মেসার্স সোনালী ট্রেডার্স, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশন এবং রেইনবো করপোরেশনের অ্যাকাউন্ট হতে টাকা উত্তোলন করে জনৈক আহাদের (হুবাইব উদ্দীন আহাদ) নামে গত বছরের ২৭ মে হতে ৩০ জুলাই পর্যন্ত দুই মাস তিন দিনে ইস্যুকৃত ৭টি আইবিসিএ এর বিপরীতে আনোয়ারা উপশাখা হতে সর্বমোট ৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়েছে। আনোয়ারা উপশাখায় জনৈক আহাদের মালিকানাধীন আহাদ এন্টারপ্রাইজের নামে ২০২৩ সালের ২৮ মে চলতি হিসাব খোলা হয় এবং হিসাব খোলার ফরমে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়ের ধরন উল্লেখ করা হয় ‘বিকাশের এজেন্ট’।

প্রতিবেদন হতে জানা যায় জনৈক আহাদ গত বছরের ২৭ মেতে উত্তোলিত টাকা হতে আইবিসিএর মাধ্যমে পুবালী ব্যাংকের কাসিমপুর শাখার মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজের হিসাবে ৫ লাখ টাকা, পুবালী ব্যাংকের নাজিরহাট শাখার মদিনা লাইব্রেরির হিসাবে ৫ লাখ টাকা, এক্সিম ব্যাংকের কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ শাখার সওদাগর ট্রেডিংয়ের হিসাবে ৫ লাখ টাকা এবং নগদে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে যেমন আবু হানিফের হিসাবে ৩ লাখ টাকা, মেসার্স মনোয়ারা এন্টারপ্রাইজের হিসেবে ২ লাখ টাকা এবং দেলোয়ার হোসেনের হিসেবে ২ লাখ টাকা নগদ জমা করেন। তা ছাড়া হিসাবটিতে ব্যাংকের চক মুঘলটুলি শাখা, খাতুনগঞ্জ শাখা, চকবাজার শাখা, মতিঝিল শাখা, মগবাজার শাখা, জমিগঞ্জ, ওসমানিনগর, সিলেট, দৌলতপুর শাখা, খুলনা, সোবরগাঁ জনপথ রোড শাখাসহ বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নগদ জমা হতো এবং তা একই দিনে ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী, বরগুনা, চাঁদপুর, দেবিদ্বার, মুকসদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর ও নগদ উত্তোলন করা হতো। জনৈক আহাদের নামে ইস্যুকৃত আইবিসিএসমূহের নথি পরীক্ষান্তে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলো জনৈক আবিদ গ্রহণ করেছে। আইবিসিএ আবিদের নাম্বারে টেলিফোন আলাপে তদন্তকারী দল জানতে পারে, আবিদ হলো আহাদের কর্মচারী এবং আহাদ প্রায়ই সৌদি আরব, দুবাই এবং মালয়েশিয়াতে যাতায়াত করেন। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দল দেখতে পায়, বিকাশ এজেন্ট আহাদ এন্টারপ্রাইজের হিসাবে এস আলম গ্রুপের হিসাব হতে খাতুনগঞ্জ শাখার দ্বারা আইবিসিএ এর মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা, স্বল্প সময়ের মধ্যেই নগদে উত্তোলন বা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর, হিসাবধারীর প্রায়ই সৌদি আরব, দুবাই এবং মালয়েশিয়াতে যাতায়াত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আহাদ অবৈধ হুন্ডির সাথে জড়িত এবং লেনদেনগুলোর মাধ্যমে হুন্ডির পেমেন্ট প্রদান করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে আইবিসিএর মাধ্যমে টাকা প্রেরণের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে এস আলমের ৫টি বেনামি প্রতিষ্ঠান যথা ফেমাস ট্রেডিং করপোরেশন, মেসার্স সোনালী ট্রেডার্স, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশন ও রেইনবো করপোরেশনের হিসাব হতে উত্তোলন করে জনৈক ফিরোজ মোল্লার নামে ইস্যুকৃত ১টি আইবিসিএ (নং-২৯১০৬২৩০০৫১০৭৫৪)-এর বিপরীতে লোকাল অফিস হতে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। আইবিসিএ এর অপর পৃষ্ঠায় উল্লিখিত ঠিকানা: ৪৮/এ/বি, বাইতুল খায়ের বিল্ডিং, ২য় তলা, পল্টন, ঢাকা ও মোবাইল নাম্বার ইন্টারনেটের মাধ্যমে যাচাইয়ান্তে দেখা যায় ফিরোজ মোল্লা একই ঠিকানায় অবস্থিত (বর্তমানে গুলশানে স্থানান্তরিত) মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ‘সিটি মানিটারি এক্সচেঞ্জে’র সাথে সংশ্লিষ্ট। এ ছাড়া মো: আবুল কালাম আজাদ (নং-২৯১০৬২৪০০২৬৮৫৫৩) নামে ইস্যুকৃত ১টি আইবিসিএ এর বিপরীতে তিনি ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস হতে গত বছরের ২৮ মে ১ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করেন। মো: আবুল কালাম আজাদের মোবাইল নাম্বার ইন্টারনেটের মাধ্যমে যাচাইয়ান্তে দেখা যায় তার নাম সিটি মানি এক্সচেঞ্জ, কালাম মতিঝিলের নামে লিপিবদ্ধ আছে অর্থাৎ আজাদ মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ‘সিটি মানিটারি এক্সচেঞ্জের সাথে সংশ্লিষ্ট মর্মে প্রতীয়মান হয়। মানি এক্সচেঞ্জ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে বিপুল অঙ্কের নগদ অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে, যার মাধ্যমে হুন্ডি বা অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন হয়ে থাকতে পারে মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ।

বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের প্রতিবেদনে ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে আইবিসিএ ইস্যুর মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের, প্রধান কার্যালয়ের (বর্তমানে মানিকগঞ্জ শাখায় পদায়িত) প্রিন্সিপাল অফিসার এস এম জামাল উদ্দীনের (রাসেল) নামে খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ফেমাস ট্রেডিং করপোরেশন, মেসার্স সোনালী ট্রেডার্স, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনের হিসাব এবং শাখার ক্লিয়ারিং অ্যাজাস্টমেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেবিট করে ইস্যুকৃত ৪টি আইবিসিএ এর বিপরীতে তিনি ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস ও গুলশান সার্কেল-১ শাখা হতে সর্বমোট ৩০ কোটি ৮১ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করেন। এ ছাড়া আলোচ্য হিসাবসমূহ ডেবিট করে ইউনিয়ন ব্যাংক, গুলশান শাখার ক্যাশ অফিসার মোহাম্মদ আলীর নামে ইস্যুকৃত ৫টি আইবিসিএ এর বিপরীতে তিনি ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস ও পল্টন শাখা হতে সর্বমোট ৭৩ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করেন। ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা নর্থ জোন অফিসের এফএভিপি তাহেরুল আমিনের নামে খাতুনগঞ্জ শাখা ইস্যুকৃত ২টি আইবিসিএর বিপরীতে তিনি লোকাল অফিস হতে সর্বমোট ২৩ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করেন। তাহেরুল আমিন তৎকালীন ডিএমডি আকিজ উদ্দিনের নির্দেশে এসব অর্থ গ্রহণ করেন এবং তা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার এস এম জামাল উদ্দীনের (রাসেল) কাছে প্রদান করেন বলে তদন্তকারী দলকে জানান। ইসলামী ব্যাংকের ট্রেনিং একাডেমিতে কর্মরত মেসেঞ্জার কাম গার্ড সমান গনির নামে ইস্যুকৃত ১টি আইবিসিএর বিপরীতে তিনি ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস হতে ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর ৫ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন ডিএমডি আকিজ উদ্দিনের নির্দেশে তিনি এ অর্থ গ্রহণ করে তার চেম্বারে পৌঁছে দেন।

প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, অর্থ উত্তোলনকারী, প্রকৃত সুবিধাভোগী এবং টাকার গতিপ্রবাহ আড়াল করার উদ্দেশ্যেই বিপুল অঙ্কের নগদ উত্তোলনে কোনো কেওয়াইসি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ তথা ব্যাংকিং নীতি পরিপালন করা হতো না। ঘোষিত ব্যবসায়ের (চিনি, গম, ঢেউটিন, তেল, খাদ্যশস্য এবং সিআইশিট ট্রেডিং) সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও ব্যাংকিং নীতি পরিপালন না করে চেকের বাহক হিসেবে অস্থিত্বহীন/অজ্ঞাত নাম ব্যবহার করে বিপুল অঙ্কের নগদ উত্তোলন এবং বিকাশ এজেন্ট, মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট/কর্মকর্তা/কর্মচারী, এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের কর্মকর্তা/কর্মচারীসহ সন্দেহজনক বিভিন্ন ব্যক্তির নামে আইবিসিএ ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ ও তা নগদে উত্তোলন করে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার সংঘটিত হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। ইসলামী ব্যাংকের সহযোগিতায় এস আলম গ্রুপের এহেন কার্যকলাপ ২০২২ সাল হতে দেশে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ক্রমাগত হ্রাস পাওয়া এবং কার্ব মার্কেটে নগদ বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য কারণ মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement