ইসলামী ব্যাংকের এক শাখা থেকেই প্রতিদিন নেয়া হতো ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত
- আশরাফুল ইসলাম
- ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
দেশের আর্থিক খাতের অভিশাপ বলে খ্যাত বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলমের ব্যাংক ডাকাতির প্রতিদিনই নতুন নতুন চিত্র বের হয়ে আসছে। এক একটি চিত্র গা শিউরে ওঠার মতো। এবার জানা গেল, কোনো প্রকার ডকুমেন্ট ছাড়াই প্রতিদিন ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার ভল্ট থেকে এস আলম ১০ কোটি টাকা থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থ বের করে নিত। যেখানে ভল্টের ধারণক্ষমতা ছিল ৫ কোটি টাকা, সেখানে চট্টগ্রামের আশপাশের শাখা থেকে নগদ অর্থ এনে এস আলমের মনোনীত প্রতিনিধির কাছে সরবরাহ করা হতো। আর এজন্য শাখা ব্যবস্থাপক নিজে তৎকালীন ডিএমডি মিফতা ও এমডির মৌখিক নির্দেশে এ অর্থ সরবরাহ করতেন। এসব অর্থ দেয়ার জন্য কোনো প্রকার ডকুমেন্ট রাখা হতো না। পরে এসব অর্থ এস আলমের বিভিন্ন বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ আকারে সমন্বয় করা হতো। কখনো কখনো সমন্বয়ও করা হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ চিত্র বের হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগ পাচারকারী শনাক্ত করতে ব্যাংকগুলোতে তদারকি জোরদার করেছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের একটি দল সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির খাতুনগঞ্জ শাখায় পরিদর্শন করে এস আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট হুন্ডি কার্যক্রমের তথ্য প্রমাণ পেয়েছে যার উপর একটি প্রতিবেদন আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে সিআইডি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রেরণ করেছে। ব্যাংক হতে গৃহীত ঋণের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিকাশ এজেন্ট, মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট/ কর্মকর্তা/ কর্মচারী, এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের কর্মকর্তা/ কর্মচারী এবং চেকের বাহক হিসেবে অস্থিত্বহীন/ অজ্ঞাত নাম ব্যবহার করে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তা/ কর্মচারীরা নগদ উত্তোলন করে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার করার প্রমাণ পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন হতে দেখা যায়, সাধারণত দিনের শুরুতে বা মধ্যবর্তী যেকোনো সময়ে খাতুনগঞ্জ শাখা হতে তৎকালীন ব্যবস্থাপক এস আলম গ্রুপ কর্তৃপক্ষের চাহিদা মোতাবেক প্রতিদিন ১০ কোটি হতে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত নগদ টাকা পৌঁছে দেয়া হতো বা এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধি শাখায় এসে গ্রহণ করতেন। অথচ ওই শাখার ভল্ট লিমিট ছিল মাত্র ৫ কোটি টাকা। এরূপ বিপুল অঙ্কের নগদ অর্থ প্রদান করার জন্য খাতুনগঞ্জ শাখাকে প্রায় প্রতিদিনই সকালে ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামস্থ অন্যান্য শাখা হতে নগদ টাকা সংগ্রহ করতে হতো। পরবর্তীতে দিন শেষে ইসলামী ব্যাংক হতে বা এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য ব্যাংক হতে নতুন ঋণ সৃষ্টি করে ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জমাকৃত অর্থ হতে তা সমন্বয় করা হতো। এ ক্ষেত্রে কখনো দিনের শুরুতে উত্তোলিত অর্থ দিন শেষে সংশ্লিষ্ট হিসাবসমূহের স্থিতি দ্বারা সম্পূর্ণ সমন্বিত না হলে অবশিষ্টাংশ শাখার সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে ডেবিট করে সমন্বয় করা হতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তকারী দলকে তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক এসভিপি মোহাম্মদ ইহসানুল ইসলাম জানান, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তৎকালীন ডিএমডি মিফতাহ উদ্দীনের নির্দেশে শাখার সাসপেন্স অ্যাকাউন্ট ডেবিট করে এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধিদের নগদ টাকা প্রদান করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন হতে দেখা যায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এমন প্রায় ১৮ কোটি টাকা অসমন্বিত অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ শাখার ক্যাশ হতে এস আলম গ্রুপকে নগদ টাকা প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু এস আলম গ্রুপ এ টাকার বিপরীতে নগদ জমা কিংবা কোনো চেক শাখাকে প্রদান করা হয়নি। শাখায় এরূপ কর্মকাণ্ড ২০২২ সাল হতে সংঘটিত হয়েছে। এ সময়ে শাখা ব্যবস্থাপক ছিলেন মোহাম্মদ ইহসানুল ইসলাম যিনি ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। আর মুহাম্মদ সিরাজুল কবির দায়িত্বে ছিলেন ২০২৩ সালের ২১ জুলাই থেকে গত বছরের ১১ আগস্ট পর্যন্ত।
ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে এস আলমের ৫টি বেনামী প্রতিষ্ঠান ফেমাস ট্রেডিং করপোরেশন, রেইনবো করপোরেশন, আনসার এন্টারপ্রাইজ, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশন এবং সোনালী ট্রেডার্সের চলতি হিসাবের মাধ্যমে ৮ মাসে (জানুয়ারি-২৪ থেকে আগস্ট-২৪ পর্যন্ত) এক হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা নগদে উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা খাতুনগঞ্জ শাখা হতে এস আলম গ্রুপের জিএম ইফতেখার উদ্দিন আহমদ, রবিউল ও তাদের প্রতিনিধি যেমন, এস আলম ভবনের কর্মচারী আবুল বশর, মোহাম্মদ হারুন, অমল কান্তিসহ এস আলম ভবনের সাথে সম্পৃক্ত আকরাম হোসেন মিনহাজ ও মোহাম্মদ হোসেন রুবেলের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। বাকি প্রায় ২৫৪ কোটি টাকা ইসলামী ব্যাংকের আন্তঃশাখা লেনদেন বা আইবিসিএ’র মাধ্যমে ব্যাংকটির অন্যান্য শাখায় পাঠিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে নগদে উত্তোলন করা হয়েছে। সব মিলে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত চার বছর ৮ মাসে পাঁচটি চলতি হিসাব হতে প্রায় তিন হাজার ২৪৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা নগদে উত্তোলন করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে আরো দেখা গেছে, নগদ অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংকিং রীতি-নীতি পরিপালন করা হতো না। নগদ টাকা উত্তোলনের জন্য সাধারণত অস্থিত্বহীন/ অজ্ঞাত নাম ব্যবহার করে ক্যাশ/ বাহক চেক ব্যবহার করা হতো। নগদ অর্থ উত্তোলনে গ্রহীতার/বাহকের কোনোরূপ পরিচয়পত্র সংরক্ষণ করা হতো না। কিছু চেকের পেছন পৃষ্ঠায় স্বাক্ষরে ছোট আদ্যাক্ষর থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সেটি কার স্বাক্ষর তা বোধগম্য নয় এবং শাখা থেকেও তা যাচাই করা হয়নি। অথচ বিএফআইইউ সার্কুলার অনুযায়ী ৫ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হলে গ্রহীতার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি রাখার বিধান রয়েছে। এস আলমের প্রতিনিধিদের লেনদেনের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। বস্তুত উত্তোলনকারীর পরিচয় গোপন করে প্রকৃত সুবিধাভোগীর তথ্য আড়াল করার উদ্দেশ্যে এরূপ অস্থিত্বহীন/ অজ্ঞাত নাম ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু খাতুনগঞ্জ শাখা হতে নগদ উত্তোলনই নয়, যখন অন্যত্র নগদ টাকার প্রয়োজন হতো তখন অন্যান্য শাখা যেখানে নগদ অর্থ সহজলভ্য ছিল (যেমন: লোকাল অফিস, গুলশান সার্কেল-১ শাখা, গুলশান শাখা, কাওরান বাজার) সেখান থেকে খাতুনগঞ্জ শাখা কর্তৃক বিকাশ এজেন্ট, মানি চেঞ্জার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়ের সাথে সম্পর্কিত নয় এরূপ সন্দেহজনক অনেক ব্যক্তিবর্গের নামে শাখাগুলোর অনুকূলে ইস্যুকৃত ওইঈঅ এর মাধ্যমে নগদ টাকা উত্তোলন করা হতো। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দৈবচয়ন ভিত্তিতে যাচাইকালে জুলাই, ২০২৩ থেকে আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে খাতুনগঞ্জ শাখা কর্তৃক ১১টি শাখা/ উপশাখার উপর ৩৫ জন ব্যক্তির নামে ইস্যুকৃত আইবিসিএ’র মাধ্যমে সর্বমোট ৩৩৪.১৮ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়েছে।
(দ্বিতীয় কিস্তি আগামীকাল প্রকাশিত হবে)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা