পুলিশের ২২টি আইনের সংশোধন চায় কমিশন
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৪৯
পুলিশের শক্তি প্রয়োগে সীমা নির্ধারণসহ ২২টি আইনের সংশোধন চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন।
বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের পাঁচটি স্তর অনুসরণ করা, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চেয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিশন। প্রতিবেদনে পুলিশের বল প্রয়োগ, আটক ও গ্রেফতার, রিমান্ডে এবং জিজ্ঞাসাবাদ, জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠন, চাকরির ভেরিফিকেশন, মানবাধিকার সুরক্ষা, প্রভাবমুক্ত জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী, যুগোপযোগী আইন, দুর্নীতির প্রতিকার, নারী ও শিশুদের সুরক্ষা, পুলিশের নিয়োগ বদলি পদোন্নতিসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া বাহিনী সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে এই কমিশন। ১০১ পৃষ্ঠায় কম্পিউটার কম্পোজ করা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ১৫টি সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়া সুপারিশমালার গুরুত্বপূর্ণ অংশ উপস্থাপন করতে গিয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেন, সব আইন খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। তবে এ ২২টি আইনের সংশোধন, পরিমার্জন বা কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ভিড় বা জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কিছু নিয়মকানুন আছে। এটার ব্যাপারে আমরা কোনো আইডিয়া দেইনি। ইউরোপের মডেলটাই ফলো করতে বলেছি। সেটার ব্যাপারে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ডিটেল একটা গাইডলাইন তৈরি করে দেয়া হয়েছে।’
পুলিশের শক্তি প্রয়োগ : পুলিশের বল প্রয়োগ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যে পাঁচ স্তরে বল প্রয়োগ করতে হবে তা হলো, পিআরবি ও জাতিসঙ্ঘের মানদণ্ড অনুসারে প্রথম থেকে তৃতীয় স্তরে শারীরিক সংস্পর্শ ব্যতীত অবৈধ জনতাকে বাধা দেয়া; নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা; বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে অবৈধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা।
চতুর্থ স্তরে প্রাণঘাতী বা ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করা বিষয়ে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কৌশলে শক্তি প্রয়োগ করেও অবৈধ জনতা ছত্রভঙ্গ না হলে বরং আরো সংগঠিত হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। মারমুখী আচরণ করলে ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটালে এবং পুলিশ ও সাধারণ জনগণকে আঘাত করে আহত করলে কমান্ডার তার সদস্যদেরসহ কভার নেবেন। ওয়াটার ক্যানন এপিসি ইত্যাদি ব্যবহার করবেন। স্পেসিফিক স্কিল প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। প্রয়োজনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে শর্টগান, সাউন্ড গ্রেনেড, ইন্ডিভিজ্যুয়াল ফায়ার আর্মস নির্দিষ্ট টার্গেটে ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করবেন।
এই স্তরে আত্মরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশকে একটি চরম ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং কেবল পুলিশ সদস্যদের বা ব্যক্তির আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগের জন্য প্রযোজ্য হবে। পঞ্চম স্তরে দলগত আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বিষয়ে বলা হয়েছে, বেআইনি সমাবেশের দলনেতা ও অন্য সদস্যদের সঙ্গে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে এবং বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বরং অবৈধ ঘোষিত জনতা নতুন শক্তি সঞ্চয় করে পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে। তবে কখনোই এই সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগ প্রয়োজনের অতিরিক্ত আরোপ করা যাবে না এবং অবৈধ জনতা ও আক্রমণকারীরা ছত্রভঙ্গ হওয়ার প্রবণতা দেখালেই শক্তি প্রয়োগের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। এই পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে প্যারা মিলিটারি ও অন্যান্য ফোর্সের সাহায্য নিতে হবে।
৫৪ ধারার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সুপারিশ : পরোয়ানা ছাড়া ৫৪ ধারায় গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে সুপারিশ করেছে এই কমিশন। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, ‘দুটো ক্ষেত্রেই হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের কিছু নির্দেশনা আছে, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যেত তাহলে হয়তো বা জনসাধরণের কষ্ট লাঘব হতো। এক্সেসিভ ফোর্স ব্যবহার, নির্বিচারে কোনো গ্রেফতার করতে পারত না। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এটার একটা রিভিউ পিটিশন দেয়া আছে, যার ফলে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনুরোধ করেছি, সরকার যেন এটা উইথড্রো করে, তা হলেই ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
আটক, তল্লাশি ও গ্রেফতার বিষয়ক সুপারিশ : আটক, তল্লাশি ও গ্রেফতার বিষয়ক সুপারিশে বলা হয়েছে, গ্রেফতারের সময় আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। আটক বা রিমান্ডে থাকা ব্যক্তিকে কাচের ঘরে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। বন্দীদের আদালতে আনা-নেয়ার যানবাহনের মান উন্নত করতে হবে। নারী আসামিকে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে শালীনতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় না দিতে চাইলে নাগরিক নিরাপত্তায় জরুরি কল সার্ভিস চালু করার কথা বলা হয়েছে। রাতে তল্লাশি করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। কেস ডায়েরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশ ব্যতীত এফআইআর বহির্ভূত আসামি গ্রেফতার করা যাবে না। বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।
পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে নির্দেশনা : চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে কমিশন যে সুপারিশ করেছে সেগুলো শিগগিরই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করেন কমিশন প্রধান সফর রাজ । তিনি বলেন, এটা খুব ইজি করা সম্ভব। কারণ এখন ন্যাশনাল আইডি কার্ড হয়েছে। চাকরির সময় আত্মীয়স্বজন রাজনীতি করে কি না এটা দেখা হতো। এসবির সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সুপারিশ করেছি যাতে সহজ হয় ভবিষ্যতে এবং এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তারা হয়তো আমাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এটা পরিবর্তন করবেন।
জিডি ও মামলার বিষয়ে সুপারিশ : জিডি ও মামলার বিষয়ে বলা হয়েছে, থানায় জিডি গ্রহণ বাধ্যতামূলক, কোনোক্রমেই জিডি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। মামলার তদন্ত ব্যয় বৃদ্ধি ও ভেরিফিকেশন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের জন্য থানায় বিশেষ বরাদ্দ ও ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ফৌজদারি মামলার তদন্তের জন্য বিশেষায়িত সেল গঠন করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রধারী চাকরিপ্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা রহিত করা যেতে পারে। চাকরিপ্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সনদ যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রহিত করে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংস্কার করা যেতে পারে। ভেরিফিকেশন সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
জিডি গ্রহণকালে আপত্তি বা কালক্ষেপণ ও কোনো দুর্নীতি হলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের অধিকার ও শিশুদের সার্বিক সুরক্ষার বিষয়ে শিশু আইন পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। পুলিশের মধ্যে জেন্ডার ও চিলড্রেন সেনসিভিটি নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত ডোপ টেস্ট ও সাইকোলজিক্যাল টেস্টের আওতায় আনতে হবে। পুলিশ লাইন্স, থানা ক্যাম্প ও ব্যারাকে স্বাস্থ্যসম্মত ও মানবিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি : নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বিষয়ে বলা হয়েছে, সহকারী পুলিশ সুপার নিয়োগের ক্ষেত্রে সিভিল সার্ভিস রুলসহ প্রয়োজনীয় বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সভায় আইজিপিকে রাখতে হবে। এসপি ও ওসিদের পদায়নের ক্ষেত্রে ফিটলিস্ট তৈরি করতে হবে। কনস্টেবল, এসআই ও এসআই পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে একবার উত্তীর্ণ হলে শারীরিক যোগ্যতা সাপেক্ষে তিন বছরের জন্য পদোন্নতিযোগ্য বিবেচনা করতে হবে।
প্রতি থানায় নারীদের জন্য পৃথক ডেস্ক : সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে নারী পুলিশের সংখ্যা ১৬ হাজার ৮০১ জন থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ২৯ হাজার ২৪৮ জন করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি থানায় নারী পুলিশের জন্য একটি ডেস্ক করার সুপারিশ করা হয়েছে। ওই ডেস্কে ২৪ ঘণ্টা যেন একজন মহিলা সাব-ইন্সপেক্টর থাকেন, এসআই থাকেন, কনস্টেবল থাকেন, যাতে মহিলা আসামিকে জেরা করা, কোর্টে আনা-নেয়া করা এবং মহিলা অভিযোগকারী যদি আসে এ জন্য সুপারিশ করা।
মানবাধিকার লঙ্ঘনে পুলিশের করণীয় : মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য সরাসরি সব পদক্ষেপ মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। পুলিশের প্রধান কার্যালয়ে একটি মানবাধিকার সেল কার্যকর করতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিকার পাওয়ার জন্য ট্রিপল নাইনে কল করে প্রতিকার পাওয়া যাবে। ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
দুর্নীতি প্রতিকার : পুলিশের দুর্নীতি ও প্রতিকার বিষয়ে বলা হয়েছে, পুলিশের কাজকর্মে ইচ্ছাকৃত ব্যত্যয় বা পেশার দুর্নীতি রোধে ওয়াচডগ বা ওভারসাইট কমিটি গঠন করা যায়। এ ছাড়া প্রতিটি থানা বা উপজেলায় একটি সর্বদলীয় কমিটি গড়ে তোলা, যারা স্থানীয় পর্যায়ে ওভারসাইট বডি হিসেবে কাজ করবে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেবে। পুরস্কার কাঠামোকে পুনর্মূল্যায়ন করা।
দুর্নীতি প্রতিরোধ শক্তিশালীকরণ বিষয়ে বলা হয়েছে, নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা, বদলি পদায়নে সততাকে গুরুত্ব দেয়া, কোনো থানার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া। সরকারি ক্রয়ে বলা হয়েছে থানায় বিবিধ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা, সদর দফতর ও ইন্সপেকশন শাখার মাধ্যমে ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়াদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।
এ ছাড়া টাউন হলে সভা ও নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করতে হবে। ‘একদিন পুলিশ হয়ে দেখুন’ ইত্যাদি রোলপ্লের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুলিশের কাজ সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিং, পুলিশের সেবামূলক ও জনবান্ধব কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
বিবিধ পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, কারাগার ও পুলিশ লাইন্সের মধ্যে যথাসম্ভব দূরত্ব কমাতে হবে। মাদক সংক্রান্ত অপরাধ দমনে ডাটাবেজ তৈরি করা ও বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (ডিসিএমএস) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের প্রবেশের সুযোগ দেয়া অথবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জন্য আলাদা সিডিএমএস চালু করা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা