১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০২ মাঘ ১৪৩১, ১৫ রজব ১৪৪৬
`

টিউলিপ নিয়ে এবার তোপের মুখে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী

-


ব্রিটিশ মিডিয়াগুলো এবার প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে কেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সিটি মিনিস্টারের দায়িত্ব থেকে টিউলিপ সিদ্দিককে পদত্যাগে বাধ্য করতে এত সময় নিলেন। টিউলিপ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের খুব কাছের বন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ক্ষমতাসীনদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে টিউলিপ সিদ্দিককে ব্রিটেনের দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। দ্য গার্ডিয়ানের এক বিশ্লেষণে এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, ডাউনিং স্ট্রিটের ভেতরে এমন কিছু লোক আছে যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে টিউলিপকে মন্ত্রী বানায়। তাকে লেবার পার্টি বা ক্ষমতাসীনদের ব্যানার হিসেবে ব্যবহারের একটি মনোভাব ছিল স্পষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশে তার খালা শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ডাউনিং স্ট্রিটের ওই লোকেরা হয়তো ভাবছেন, টিউলিপকে সামনে আনার আগে তারা যদি দ্বিতীয়বার ভাবতেন। ক্ষমতাসীনদের এ মনোভাবের কারণ হচ্ছে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির সাথে তার যোগসূত্রের মাত্রা স্পষ্ট হওয়া।
যখন তাকে ব্রিটিশ সরকারের দুর্নীতি দমন মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, তখন শেখ হাসিনার সরকার ছিল বেশ প্রতাপশালী। পারিবারিক গাম্ভীর্য টিউলিপকে সবার কাছে সমাদৃত করে। লেবার পার্টির নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সহযোগিতা করেন। টিউলিপ সিদ্দিকের পাশাপাশি কিয়ার স্টারমারের প্রচারে নেতাকর্মীরা দিন-রাত পরিশ্রম করেন।

কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ পরিস্থিতি যদি তখন থাকত তবে ডাউনিং স্ট্রিটের ভেতরের লোকজন তাকে দায়িত্ব দেয়ার আগে একটু চিন্তা করতে চাইতেন।
শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতির সাথে টিউলিপের নাম উঠে এসেছে। তিনি ব্রিটেনে দু’টি ফ্ল্যাট আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে নিয়েছেন। এ ছাড়া রাজধানীর পূর্বাচল নিউ টাউনের প্লট বরাদ্দে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির অভিযোগে পৃথক তিনটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক রুপন্তীকে।
বাংলাদেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার মহাপরিচালক আখতার হোসেন বলেন, পূর্বাচল নতুন শহরে প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করেছেন। এ বিষয়ে দুদকের কাছে যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে। সোমবার (১৩ জানুয়ারি) এ সংক্রান্ত পৃথক ৩টি মামলা করে দুদক, যা ব্রিটিশ মিডিয়ায় বেশ গুরুত্বের সাথে প্রচার পায়। এ ছাড়া অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত অন্য ঘটনায় টিউলিপের সংশ্লিষ্টতা তদন্ত করছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
একজন লেবার এমপি নাম প্রকাশ না করার শর্তে গার্ডিয়ানকে বলেন, এটি ছিল (টিউলিপকে মন্ত্রিত্ব দেয়া) ক্ষমতাসীনদের নিজস্ব লক্ষ্য। সবাই জানত যে, তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক রাজবংশের একজন সদস্য। যার বিশাল ক্ষমতা এবং অর্থের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। পৃথিবীতে কে ভেবেছিল যে তাকে এই চাকরি দিয়ে সবার দৃষ্টিতে পড়তে হবে!

গত বছর ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচনে জয় পায় লেবার পার্টি। এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন কিয়ার স্টারমার। তিনি নতুন সরকারে যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন সেখানে টিউলিপ সিদ্দিককে সিটি মিনিস্টারের দায়িত্ব দেন। তার কাজ ছিল দেশটির আর্থিক বিষয়াবলিতে সম্ভাব্য দুর্নীতি প্রতিরোধ করা। তবে যে দুর্নীতি প্রতিরোধের দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছিল, সেই দুর্নীতির অভিযোগের মুখে বাধ্য হয়ে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে তাকে।
টিউলিপ পদত্যাগ করার পর এবার নিজ দলের সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্টারমার। সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে এক লেবার এমপি বলেছেন, ‘টিউলিপকে মন্ত্রী বানানোর সিদ্ধান্ত ছিল আত্মঘাতী গোল। সবাই জানত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। যাদের অনেক ক্ষমতা ও অর্থ আছে। তাকে এই দায়িত্ব দিয়ে এতসব কিছু করার বিষয়টি কী ভালো ছিল?’
এ দিকে লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় একটি ফ্ল্যাট রয়েছে টিউলিপ সিদ্দিকের, যেটির মূল্য ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশী মুদ্রায় ২ কোটি ৯৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা)। গত ৩ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যের দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, ২ শয্যাকক্ষের সেই ফ্ল্যাটটি ২০০৪ সালে টিউলিপকে উপহার দিয়েছিলেন আবদুল মোতালিফ নামে এক ডেভেলপার।
মোতালিফ বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী এবং টিউলিপের খালা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। এই ফ্ল্যাটের তথ্য সামনে আসার পর ব্যাপক চাপের মুখে পড়েন টিউলিপ। এরপর বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এসবের পর তার মন্ত্রিত্ব নড়েবড়ে হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে সরে যেতে হয়েছে তাকে।
৪২ বছর বয়সী টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টির সদস্য হন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ২০১৫ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে পূর্ব লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড আসন থেকে প্রথমবারের মতো প্রার্থী হন। তার পর থেকে এ পর্যন্ত ওই আসনে চার বার প্রার্থী হয়েছেন টিউলিপ, প্রতিবারই জয়ী হয়েছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তাকে ট্রেজারি ও নগর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার।

গার্ডিয়ান দাবি করছে, হাসিনার পতনের পর শেখ পরিবারের দুর্নীতির সাথে টিউলিপের নাম ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও তার যোগসাজশ ছিল বেশ পুরনো। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পুরোটা সময় সহযোগিতা এবং অর্থ আত্মসাতে তার সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে একটি ছবি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রচার পাচ্ছে। ছবিটি ১২ বছর আগের। যেখানে বাংলাদেশের শেখ পরিবারের সাথে টিউলিপের ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করে। অথচ পরিবারের সাথে তার রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই বরং সম্পর্ক কেবলই আত্মীয়ের বলে বহুবার দাবি করে আসছেন টিউলিপ।
গার্ডিয়ান ওই ছবিটি জুড়ে দিয়ে এক বিশ্লেষণে জানায়, ২০১৩ সালে তোলা ছবিটি ২০১৫ সালে ব্যাপকভাবে ছড়ানোর পর টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে তখন থেকেই সতর্কীকরণ অবস্থা ছিল। ওই ছবিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী তার খালা শেখ হাসিনা, খালাতো ভাই সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপকে দেখা যায়। খালার পাশে টিউলিপ সিদ্দিক ছিলেন বেশ হাস্যোজ্জ্বল। ছবি প্রকাশিত হলে তখনই লেবার পার্টির ভেতরে আশঙ্কার ঘণ্টা বেজে ওঠে।
২০১৫ সালের সেই সময় টিউলিপ হ্যাম্পস্টেড এবং কিলবার্নের আসনের জন্য লেবার প্রার্থী ছিলেন। এটিকে কেন্দ্র করেই ছবিটি তখন নতুন করে প্রচার পায়। কিন্তু তিনি ক্রেমলিনে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি নিয়ে দলের নেতাদের উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কার্যত টিউলিপের পতনের ঘণ্টা বেজেছিল ১২ বছর আগেই। যদিও টিউলিপ দাবি করেন, আমি আমার খালার প্রতিনিধিদলের অংশ ছিলাম না। আমি গিয়েছিলাম কারণ আমার সাথে তার খুব একটা দেখা হয় না। বৈঠকে পুতিন বললেন, ‘তোমার পরিবার কি এখানে? আমি একটা ছবি চাই।’ অতীতের দিকে তাকালে, আমার ভাবা উচিত ছিল যে এটি কেমন দেখাচ্ছে। আমার মনে হয় পুতিন ভাববেন, ‘এই এলোমেলো মেয়েটি কে; যার সাথে আমি অস্ত্রের চুক্তি করতে যাচ্ছি?’
কিন্তু এত বছর পর সেই ছবিটিই শেখ হাসিনার অর্থ আত্মসাতে টিউলিপের সহযোগিতার দৃশ্যত প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট নেয়া, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে সহযোগিতা, অন্তঃসত্ত্বা সাংবাদিককে হুমকি, ব্যারিস্টার আরমানের স্ত্রীকে হেনস্তা করানো বা পূর্বাচলে প্লট জালিয়াতি ছাপিয়ে টিউলিপের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল- রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে টাকা আত্মসাতের মধ্যস্থতা করা। এ প্রকল্প থেকে ৫০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা) আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮ আগস্ট গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের এক প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য জানা যায়।

এতে বলা হয়, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা-রোসাট্রম মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এ অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেয়। যাতে মধ্যস্ততা করেন ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় ও ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক।
গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, রাশিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণে খরচ ধরা হয় এক হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। প্রয়োজনের তুলনায় যা অনেক বেশি। যাতে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই বাজেট থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা-রোসাট্রম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজের ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সাথে এ চুক্তি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ মধ্যস্থতার বিনিময়ে পাচার করা অর্থের ৩০ শতাংশ পেয়েছেন টিউলিপ, শেখ রেহানা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement