শাসন কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন
আজ সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পেশ- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:০৮
সংবিধান সংস্কারবিষয়ক কমিশন রাষ্ট্রীয় শাসনকাঠামোতে ব্যাপক সংস্কার আনার সুপারিশ করে অন্তর্বর্তী আদেশের আওতায় নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে মত দিতে যাচ্ছে। আজ বুধবার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে উপস্থাপনের জন্য তৈরি সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই প্রতিবেদনে সংসদের দুই কক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, নিম্নকক্ষে প্রচলিত ব্যবস্থায় নির্বাচন বহাল রেখে সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় উচ্চকক্ষের নির্বাচনের সুপারিশ করছে। কমিশনের একটি সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কমিশনের এক দায়িত্বশীল সূত্র অনুসারে, সংবিধান পুনর্লিখন নাকি সংশোধন করা হবে এ বিতর্কে না গিয়ে সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রশাসনের কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে এই খসড়া সংবিধান সংস্কার প্রতিবেদনে। কমিশনের প্রধান প্রফেসর আলী রীয়াজ আজ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করবেন। প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতেও পরিবর্তনের সুপারিশ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। নতুন প্রস্তাবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ এই তিনটিকে সংবিধানের মূলনীতি করার সুপারিশ করা হবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই তিন মূলনীতির কথাই বলা হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আগের মতো পরোক্ষভাবে অনুষ্ঠানের সুপারিশ থাকলেও তাকে নির্বাচিত করার ইলেক্টোরাল ভোটারের সংখ্যা বাড়ানো হবে। আগে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুসারে কাজ করার যে বাধ্যবাধকতা রাষ্ট্রপতির ছিল তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাদ দেয়া হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে।
জানা গেছে, দুই কক্ষবিশিষ্ট আইন সভার মধ্যে নিম্নকক্ষের সদস্যসংখ্যা ১০০ বাড়িয়ে ৪০০ করা হলেও এতে সংরক্ষিত থাকা নারী ও অন্য পিছিয়ে পড়া ১০০ সংসদ সদস্যকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। তাদের সংরক্ষিত আসনে অন্যরা নির্বাচন করতে পারবেন না। নি¤œ কক্ষের নির্বাচনে ব্রিটিশ পদ্ধতি অনুসারে অধিক ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচিত ঘোষিত হবেন। অন্যদিকে উচ্চ পরিষদের ১০৫ সদস্য নির্বাচিত হবেন নিম্নকক্ষের ভোটের দলীয় প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের মোট অনুপাত অনুসারে। বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি বাছাই করে তালিকা জমা দেবে।
বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ধরে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলে আসছে। বিএনপি লিখিতভাবে সংবিধান সংস্কার কমিশনকে যে ৬২ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল, সেখানেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের কথা বলা হয়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটিও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব দিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মতবিনিময়েও অংশীজনদের অনেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব দেন।
সংসদ সদস্যদের বর্তমান মেয়াদ এক বছর কমিয়ে চার বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে। দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সংসদ সদস্যপদ চলে যাওয়া সংক্রান্ত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, তাদের যেসব সুপারিশ থাকবে, তার অন্যতম লক্ষ্য হবে গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করা এবং সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ঠেকানো। এ জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেয়া হবে, যাতে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সুযোগ না থাকে। সাংবিধানিকভাবে এক ব্যক্তির হাতে যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে না যায়, তার জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে বেশ কিছু সুপারিশ করা হচ্ছে। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কয়টি মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেয়া; প্রধানমন্ত্রী একই সাথে দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা যাতে না হন এমন বিধান করার বিষয়ও রয়েছে তাতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুসারে, সংবিধানের মূলনীতিসহ মৌলিক কাঠামোতে যে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে তা সংশোধন বা পুনর্লিখন দুইভাবে কার্যকর করা যেতে পারে। পুনর্লিখনের ক্ষেত্রে নতুন সংসদ সদস্যরা গণপরিষদ সদস্য হিসেবে কাজ করবেন। তারা নতুন করে সংবিধান পুনর্লিখন ও পাস করবেন। গণপরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ অনুসারে নির্বাচন করতে চাইলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করতে পারেন। সে আদেশ অনুসারে নতুন নির্বাচন হবে। এটির বৈধতা পরের সংসদকে দিতে হবে।
অন্য দিকে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সুপারিশ কার্যকর করতে চাইলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সংশোধিত কাঠামো জারি করবেন। সে অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনোত্তর সংসদ সংবিধানের সংশোধিত কাঠামো অনুমোদন করবেন। আর পূর্ববর্তী সময়ে হওয়া নির্বাচনকে বৈধতা দান করবেন।
জানা গেছে, সংবিধান সংশোধনের যে ব্যাপক সুপারিশ করা হচ্ছে তা কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। বিশেষত ৫ আগস্টের বিপ্লবের পক্ষের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হতে হবে। এর আগের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন ছাড়াই ১৯৯০ সালে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন করেন। তখন দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি চালু ছিল। এ সময় ৭ দল, ১৫ দল, ৫ দল ও জামায়াতে ইসলামী এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন। পরে সংবিধান সংশোধন করে এর বৈধতা দেয়া হয়।
বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি যেকোনো বড় সংস্কারের বিরোধিতা করে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। বাকি দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ ফ্যাসিবাদ বিরোধী দল মৌলিক সংস্কার শেষ করে যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দাবি করছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান এ ক্ষেত্রে আদর্শ সময় বিবেচনা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়াও নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনও আজ তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে অন্য দু’টি বিচারব্যবস্থা ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে চলতি মাসের শেষে। সংস্কার কমিশনগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করবে। এ লক্ষ্যে তাদের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ থাকবে, সেগুলো মূলত দুই ধরনের হবে। কিছু হবে স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য, আর কিছু দীর্ঘমেয়াদি। তবে কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু করবে অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি মাসেই এ আলোচনা শুরু হতে পারে। সংস্কার প্রস্তাব এবং এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য হলে সংলাপ থেকে একটি রূপরেখা আসতে পারে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা