রাজধানীর উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে বিশৃঙ্খলা
রাজউকের ১৪০ পরিদর্শক যথাযথ কাজ করছেন না : ভিডিও ডকুমেন্টশনে ড্রোন প্রযুক্তির উদ্যোগ- হামিম উল কবির
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৮, আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৫৯
বিশাল ঢাকা শহরের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে চলছে চরম বিশঙ্খলা। ফলে ঢাকা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে। উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালনকারী মাঠ পরিদর্শকদের যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার জন্যই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে জানা গেছে, রাজউকের মাঠ পরিদর্শক মাত্র ১৪০ জন। এক হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটারের বিশাল ঢাকা শহরের সববন পরিদর্শনেই পরিদর্শকরা হিমশিম খাচ্ছেন। প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অতি নগণ্য হলেও এই পরিদর্শকদের মাঠে যাওয়ার জন্য কোনো যাতায়াত ভাতাও বরাদ্দ নেই। অন্য দিকে তাদের জন্য গাড়িও বরাদ্দ নেই। চাকরি রক্ষার্থে বাধ্য হয়েই তাদের মাঠে যেতে হয় এবং বেতনের টাকা খরচ করেই তারা মাঠে যেতে বাধ্য হন। রাজউকে এটা ওপেন সিক্রেট যে, যাতায়াত ভাতা পান না বলে পরিদর্শকরা ভবন নির্মাণে কোনো ত্রুটি থাকুক আর না থাকুক মাঠ পরিদর্শকদের বাধ্যতামূলক কিছু অর্থ অবশ্যই দিতে হয়। আর ভবনের কোনো ত্রুটি থাকলে তো কথাই নেই, মাঠ পরিদর্শককে সন্তুষ্ট রাখাটাই যেন ভবন মালিকদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৯৫ সালে ঢাকার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) পাস করার সময় গাজীপুর, নারায়গঞ্জের কিছু অংশ যোগ করে রাজউকের আয়তন ধরা হয়েছিল এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু পরে গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের পর ঢাকা থেকে ৪৩৪ বর্গকিলোমিটার বাদ দেয়া হয়। ফলে বর্তমানে ঢাকার আয়তন এক হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটার। এই হিসাবে রাজউকের ৭.৮১ বর্গকিলোমিটারের জন্য একজন করে মাঠ পরিদর্শককে কাজ করতে হয়। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে থাকে। বিশাল এলাকার জন্য একজন মাঠ পরিদর্শক যথেষ্ট নয়। রাজউকের কর্মকর্তারাই বলছেন, প্রতি এক বর্গকিলোমিটারের জন্য একজন মাঠ পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হলে তারা সঠিকভাবে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারবেন যদি তাদের আন্তরিকতা থাকে।
ঢাকার বর্তমান উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের কী অবস্থা? এটা জানার জন্য প্রকৌশল বিদ্যায় পারদর্শিতা ছাড়াই ঢাকার যেকোনো বাসিন্দা বলে দিতে পারবেন যে, নির্মাণকাজে ঢাকায় চলছে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা। রাজউক থেকে প্ল্যান পাস করানোর পর তা যথাযথ মেনে ভবন নির্মাণ হয় এমন ঘটনা খুবই কম ঘটে। দেখা গেছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুসারে খুব কমই ভবন নির্মাণ হচ্ছে। ২০০৮ এর বিধিমালা অনুসারে ভবন নির্মাণ হলে একটি ভবনের সামনে-পেছনে এবং দুই পাশে যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। ফলে ভবনের বাসিন্দারা যথেষ্ট পরিমাণ আলো-বাতাস পেতে পারতেন। কিন্তু খুব কম ভবনেই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে অথবা হয়েছে। তবে আইকনিক ভবনগুলো যেহেতু অনেক দামে বিক্রি করা হয়, বিখ্যাত ডেভেলপার কোম্পানিগুলো নির্মাণ করে তারা বিধিমালা যথাযথভাবেই অনুসরণ করেন বলে প্রকৌশলীরাই বলছেন। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনগুলোর ক্ষেত্রে বেশির ভাগই বিধিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ করে না। মাঠ পরিদর্শকরা নিয়মিত পরিদর্শণ করে রিপোর্ট দিলে ভবন নির্মাণে বিশৃঙ্খলা অনেকটাই কমে যেতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দেখিয়ে মাঠ পরিদর্শকরা যথাযথ ভূমিকা পালন করেন না। একই অজুহাতে তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
রাজউকের বর্তমান সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) মোহা: হারুন-অর-রশীদ এ ব্যাপারে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ‘বিশাল ঢাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের জন্য মাত্র ১৪০ জন মাঠ পরিদর্শক যথেষ্ট নয়, এমনকি রাজউকের অর্গানোগ্রামে যে ২৪০ জন মাঠ পরিদর্শকের পদ আছে তা-ও যথেষ্ট নয়। মাঠ পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য রাজউকের একটি পরিকল্পণা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি সভাও করা হয়েছে। তবে নিয়োগের ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ। রাজউক থেকে প্রস্তাবাবলী প্রস্তুত করে আমরা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো। গৃহায়ন মন্ত্রণালয় জনপ্রসাশন মন্ত্রণায়ে পাঠাবে, দুই মন্ত্রণালয়েই এটা নিয়ে মিটিং হবে, পরে সিদ্ধান্ত নেবে। ফলে বাস্তবায়ন হতে কিছুটা দেরি হবে, এ কারণে কবে নাগাদ নতুন মাঠ পরিদর্শক নিয়োগ হবেÑ এটা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।’ মাঠ পরিদর্শকদের মাঠে গেলে কোনো ধরনের যাতায়াত ভাতা নেই কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে রাজউকের সদস্য মোহা: হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘তাদের জন্য যেহেতু যাতায়াত ভাতা নেই সে কারণে চলাচলের জন্য তাদের মোটরসাইকেল দেয়ার চিন্তা করছে রাজউক। এ বিষয়ে একটি সভা রাজউকে হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সবাইকে মোটরসাইকেল দেয়া হয়তো সম্ভব হবে না। প্রথমে তাদের জন্য ১০০ মোটরসাইকেল কেনার ব্যাপারটি প্রক্রিয়াধীন।’ তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট করে তারিখ বলা সম্ভব নয় যে কবে নাগাদ তাদের মোটরসাইকেল দেয়া হবে।’
ড্রোন প্রযুক্তিতে যাচ্ছে রাজউক : ঢাকার জোনিং ম্যাপ ডিজিটালাইড করার উদ্দেশ্যে এবং ভিডিও ডকুমেন্টেশন করতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ড্রোন প্রযুক্তিতে যাচ্ছে। এআরসিজিআইএস কোম্পানি থেকে সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার, সার্ভার সিস্টেমসহ এই প্রযুক্তি আনতে যাচ্ছে রাজউক। ড্রোন চালানোর জন্য ইতোমধ্যে রাজউকের সংশ্লিষ্ট জনশক্তিকে প্রশিক্ষণের কাজ চলছে। মোট তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে এই কাজে। এর মধ্যে সফটওয়্যারটির জন্যই ব্যয় করতে হবে প্রায় দুই কোটি টাকা। রাজউকের নগর পরিকল্পণা বিভাগের অধীনে এই প্রযুক্তি থাকবে, কাজও করবেন নগর পরিকল্পণা বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্টরা। ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে রাজউকে এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের কাজটি শুরু হয়েছে।
কেন এই প্রযুক্তি প্রয়োজন? এ প্রশ্নের উত্তরে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পণাবিদ মো: আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার জন্য এই প্রযুক্তিটা খুবই জরুরি। কারণ ঢাকা শহরে গড়ে ওঠা ভবনে প্রায়ই রাজউকের অনুমোদিত প্ল্যান অনুসারে ভবন নির্মাণ না করার অভিযোগ আসে। সরেজমিনে গিয়েও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেয়া হলেও ভবনের সামনে কমপক্ষে ২০ ফুট রাস্তা থাকে না। যেভাবেই হোক, রাজউককে ফাঁকি দিয়ে প্রয়োজনীয় রাস্তার জায়গা না রেখেই অথবা সরু গলির মধ্যে ভবন তৈরি করে ফেলছেন ভবন মালিকরা। আবার দেখা যায়, অনুমোদিত প্ল্যানে যে রকম আছে, বাস্তবে ভবন ওঠে গেছে ভিন্ন রকমভাবে। সব সময় সরেজমিনে পরিদর্শন করা সময়সাপেক্ষ হয়ে যায়। ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার করে একদিনের মধ্যেই নির্দিষ্ট এলাকার ভিডিও ও স্থির (স্টিল) ইমেজ তুলে আনা যায় এবং এর আলোকে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। প্রধান নগর পরিকল্পণাবিদ আশরাফুল ইসলাম আরো বলেন, এই ড্রোনে এআরসিজিআইএস কোম্পানির সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সহজেই ড্রোন প্রতিটি বাড়ির ছবি তুলে প্লট নাম্বারের সাথে মিলিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এগুলো রাজউকের ওয়েবসাইটে দেয়া থাকলে রাজউক যেমন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, আবার যে কেউ চাইলেই ঢাকার কোনো জায়গা অথবা ভবন কিনতে চাইলে ভবনের কি অবস্থা, সামনে পেছনে কতো জায়গা আছে, কতটুকু রাস্তা আছে, ভবনের সামনে যে রাস্তাটি আছে তা রাজউকের অনুমোদন অনুযায়ী আছে কি না তা দেখে নিতে পারবেন। এ ছাড়া রাজউকের ওয়েবসাইটে ঢুকে যে কোনো প্লটের নির্মাণাধীন ভবনটি বৈধ কি না, কোনো ডেভিয়েশন (বিচ্যুতি) আছে কি না তাও জেনে নিতে পারবেন।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, অনেক সময় সরকারি প্রয়োজনে রাজউককে কোনো জায়গা অধিগ্রহণ করতে হয়। অধিগ্রহণ করলে ভূমির মালিককে উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হয়। অনেক সময় চতুর ভূমি মালিকরা অধিগ্রহণ ঠেকাতে না পারলেও রাতারাতি স্থাপনা নির্মাণ করে দাবি করে থাকে যে, ‘তার জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করে বসবাস শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই।’ এটা প্রমাণ করতে পারলে সেই ভূমির জন্য সরকারকে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু কোনো স্থানের ভূমি অধিগ্রহণের আগে ভিডিও ডকুমেন্টেশন থাকলে সরকারকে আর ফাঁকি দেয়া সম্ভব হবে না।
আশরাফুল ইসলাম জানান, এই প্রযুক্তিটি এ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর ব্যবহার করছে। তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রাজউক ব্যবহার করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ড্রোনের ব্যবহার শুরু হলে ভবিষ্যতে আরো বহুবিধ কাজে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে জোনিং, পানির জরিপ, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক পরিষেবা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে শহর পরিকল্পনা পর্যন্ত করা যায়। জিআইএস প্রযুক্তি পরিকল্পনাবিদ এবং সংশ্লিষ্টদের শহরের বর্তমান চাহিদা বুঝতে সহায়তা করে থাকে। বিল্ডিং প্লেসমেন্ট, বর্জ্য নিষ্কাশন এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার চাহিদা বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে সব কিছুই জিআইএস ডেটাতে সুবিন্যস্ত করে সংরক্ষণ করা যায়। জিআইএস সংযুক্ত এই প্রযুক্তির সাহায্যে রাস্তার ম্যাপিং, যানবাহনের অবস্থা এবং পরিবহন রুট পরিবর্তন করার জন্য পরিবহন পরিকল্পনায় ব্যবহৃত হয়। এই প্রযুক্তি রিয়েলটাইমে রাস্তায় যানবাহনের প্রবাহ উন্নত করতে সহায়তা করতে পারে এবং যানজট কমাতে সাহায্য করতে পারবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা