সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা চায় বেশির ভাগ ইসলামী দল
- খালিদ সাইফুল্লাহ
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩২, আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:০৭
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনভিত্তিক প্রার্থী দেয়ার পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) নির্বাচনব্যবস্থা চায় বেশির ভাগ ইসলামী দল। তারা মনে করছেন, এ পদ্ধতি চালু হলে দেশ থেকে ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদ বিদায় নেবে। তবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পেলে এ পদ্ধতির সুফল নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে দলগুলোর নেতারা বলছেন, পতিত স্বৈরাচার নির্বাচনে অংশ নিলে দেশে আবারো ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে। এজন্য এখনই তারা সিদ্ধান্ত নিতে চান না।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) নির্বাচনব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। অর্থাৎ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন প্রদানের দাবি জানিয়েছে তারা। চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও একই দাবি জানিয়েছে। দল দু’টির নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এ বিষয়ে বক্তব্য রাখছেন। তারা বলছেন, এ পদ্ধতি চালু হলে দেশ থেকে ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারার বিলুপ্তি ঘটবে। জাতীয় সংসদে প্রকৃত মেধাবী, সৎ ও যোগ্য লোকেরা স্থান পাবে। এতে দেশের গণতন্ত্রও উন্নত হবে। মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন প্রদানের বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছে। তবে তাদের ভিন্ন চিন্তাও আছে। এ ছাড়া দেশের প্রথম সারির অন্যান্য ইসলামী দল এ বিষয়ে ইতিবাচক হলেও এ পদ্ধতি চালু হলে ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ আবার ফিরে আসার আশঙ্কা করছে তারা।
বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধানত দু’টি ব্যবস্থা বিদ্যমান। প্রথমত. একটি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন তিনি নির্বাচিত হবেন। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’। এ পদ্ধতি বাংলাদেশে চালু রয়েছে। অন্যটি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন (পিআর) পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি দল যে পরিমাণ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে সংসদে দলটির প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ হবে। অনেক দেশে এ দু’টি পদ্ধতির সমন্বিত ব্যবস্থাও চালু রয়েছে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনব্যবস্থা পৃথিবীর শতাধিক দেশে চালু আছে। উন্নত দেশগুলোর সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ দেশই আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা অনুসরণ করে। এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও নেপালে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে।
দেশের ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো দলেরই একক কর্তৃত্ব সৃষ্টি হবে না। এতে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার পথও বন্ধ হয়ে যাবে। তারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী হওয়ার পথ বন্ধ করার একমাত্র উপায় হলো সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলের ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠা বন্ধ হবে। নমিনেশন বাণিজ্য বন্ধ হবে। নির্বাচনে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ হবে। নির্বাচিত ব্যক্তিদের টাকা খরচ না হওয়ায় পরে যেকোনো উপায়ে টাকা কামানোর ধান্দা বন্ধ হবে। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের মূল স্পিরিট হলো সবাইকে নিয়ে চলা। আমি যেটা পছন্দ করি সেটা সবারই পছন্দ হবে এটা নাও হতে পারে। তারপরও সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। তিনি বলেন, যেকোনো বিষয়ে ভালো-মন্দ আছে। তবে আমরা দেখেছি এ পদ্ধতির ভালো দিকই বেশি। এটি দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভালো হবে। জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আজম জামায়াতের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, তিনিই প্রথম কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির কথা বলেছিলেন। একইসাথে তিনি এ বিষয়টিও জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন। তবে সে সময় এটি বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু এখন একটি পরিবেশ এসেছে। এজন্য আমরা আবার বিষয়টি উত্থাপন করেছি। এ পদ্ধতি চালু হলে গণতন্ত্রের জন্যই ভালো হবে এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা বন্ধ হবে।
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বিগত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাত্র ৩৫ ভাগ ভোট পেয়ে একটি দল ২০০ আসন পেয়ে যাচ্ছে। ৩৫ ভাগ জনগণের সমর্থন পেয়ে তারা ১০০ ভাগ জনগণকে শাসন করার ক্ষমতা পাচ্ছে। অথচ বাকি ৬৫ ভাগ জনগণ তাদের শাসন করার ক্ষমতা দেয়নি। এ ছাড়া নির্বাচনে কালো টাকার মালিক, দুর্বৃত্তরাও এমপি হয়ে যাচ্ছে। তারা সংসদে গিয়ে কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন সংখ্যা পেলে যে দল যত শতাংশ ভোট পেয়েছে সেই অনুসারে সংসদে তাদের তত শতাংশ এমপি থাকবে। এতে সব জনগণের প্রতিনিধি সংসদে থাকবে এবং একটি ব্যালান্সড ও কার্যকরী সংসদ গঠিত হবে। দলগুলো সংসদে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের নিযুক্ত করবে। বিশ্বের শতাধিক দেশে এ পদ্ধতি চালু আছে বলেও তিনি জানান। সংখ্যানুপাতিক আসনব্যবস্থা চালু হলে আওয়ামী লীগের অনেক সংখ্যক আসন পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা যে পদ্ধতির কথা বলছি সেটি একটি স্থিতিশীল ও কার্যকর পদ্ধতি। এটি চালু হলে ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদ কমে আসবে। তারা যদি বর্তমান পদ্ধতিতেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পায় তাহলেও তারা বেশকিছু আসন পেয়ে যাবে। কারণ তাদের নেতারা পালালেও সমর্থকরাতো দেশেই আছে। তিনি বলেন, তবে যে দল গুম-খুন করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে সেই দল নির্বাচনে আসবে কোন মুখে?
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের গত ১১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন প্রদানের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এ প্রসঙ্গে দলটির মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন প্রদানের প্রস্তাব করেছি। তবে আমরা মিশ্র পদ্ধতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছি। যেটি নেপালে আছে। তিনি বলেন, এ পদ্ধতি চালু হলে সব জনগণের প্রতিনিধি সংসদে থাকার সুযোগ হবে। ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার পথও বন্ধ হবে। তবে আগামী নির্বাচনে যদি ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ অংশ নেয়ার সুযোগ পায় তাহলে এ পদ্ধতি কোনো কাজে আসবে না। কারণ তাদেরও একটি বড় অংশ ভোটার রয়েছে। তারা শতাধিক আসন পেয়ে যেতে পারে। তাহলে তো আবারো সেই ফ্যাসিবাদী শক্তি ফিরে আসার সুযোগ পাবে। এখন তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি পারবে না তার ওপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে এ পদ্ধতি চালু হওয়া উচিত কি উচিত না? তিনি মনে করেন, আগামী নির্বাচনে একটি ফ্যাসিবাদী দল যারা সাড়ে ১৫ বছর দেশের জনগণকে হত্যা-গুম করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে তাদের এখনই জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ দেয়া উচিত হবে না।
খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের দল এ পদ্ধতি চালুর বিষয়ে এখনই সমর্থন দিচ্ছে না। কারণ তাতে আবারো ফ্যাসিবাদী শক্তি আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তারা যদি নিজেরা দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ নাও পায় তাহলে তারা অন্য দলের ওপর ভর করতে পারে। এতে তাদের শতাধিক আসন পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা এখনই এ পদ্ধতি সমর্থন করছি না। কারণ এ পদ্ধতিতে পরাজিত রেজিম সুবিধা নেয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তারা শতাধিক আসন পেয়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই আমরা সমর্থন করছি না। তবে তারা নির্বাচনে না থাকলে এ পদ্ধতি ভালো ফল বয়ে আনতে পারে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তখন আমরা সমর্থন করব কি করব না তখন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিব।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী নয়া দিগন্তকে বলেন, এ পদ্ধতির ভালো-মন্দ দু’টি দিকই আছে। এ পদ্ধতি চালু হলে ফ্যাসিবাদীরা ভালো আসন পেয়ে যাবে। তারা নির্বাচনে এতদিন যে টাকা লুটপাট করেছে তা ব্যয় করবে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনের আগে এমন আইন করা দরকার যাতে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে তারা যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। দাগী অপরাধীরা যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা