লোকসানে হতাশ কৃষক সবজি চাষ কমার আশঙ্কা
দাম কম পাওয়ায় জমিতে নষ্ট হচ্ছে ফুলকপি- শাহ আলম নূর
- ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ফুলকপি নিয়ে মহাবিপাকে প্রান্তিক কৃষকরা। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। ফলে উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না কৃষক। এক মাস আগেও ঢাকায় সবজির দাম ছিল আকাশছেঁায়া। এর মধ্যে প্রাকৃত্রিক দুর্যোগ কাটিয়ে আবাদে ফলন হয়েছে বাম্পার। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সবজি ঢাকায় আসতে থাকে উচ্চমূল্যের আশায়। এদিকে নানা ধরনের সবজিতে সয়লাব ঢাকার বাজার। ফলে সরবরাহ অতিরিক্ত হওয়ায় দাম যায় পড়ে। শীতকালীন সবজির মধ্যে ফুলকপির মধ্যে ফুলকপির দাম কমেছে অনেক বেশি। শিম, মূলা, নতুন আলু, শাল গম, লাউ ইত্যাদি সবজির সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না ফুলকপি। ঢাকার বিভিন্ন বাজার বা মহল্লায় একটি বড় ফুলকপি দাম ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হলেও প্রান্তিক কৃষক পাচ্ছেন মাত্র ৪ থেকে ৫ টাকা। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে, ক্ষেত থেকে তুলে বাজারে নিয়ে যেতে যে খরচ হয় বিক্রি করে তা মেটাতে পারছেন না কৃষক। ফলে অনেক কৃষক গত কিছুদিন ধরে জমিতেই পিষিয়ে দিচ্ছেন ফুলকপি। এতে অন্তত জৈব সার তৈরি হবে বলে আশা তাদের।
কৃষকদের অভিযোগ, যেখানে প্রতি বিঘা জমিতে ফুলকপি আবাদ করতে ব্যয় হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা; সেখানে তারা বিক্রি করে পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। এতে বিঘাপ্রতি জমিতে লোকসান হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এমন পরিস্থিতিতে কষ্টে উৎপাদিত ফসল গবাদি পশুকে খাওয়ানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অনেকেই ঋণ করে আবাদ করায় উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে ঋণও পরিশোধ করতে পারছেন না। তাদের মতে, ন্যায্যমূল্য না পেলে সামনে সবজির আবাদ কমে যাবে, যার প্রভাব পড়বে বাজারে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফসল উৎপাদনের মৌসুম শেষ হয়ে গেছে কিছুদিন আগেই। এখন উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রি করাই মূল কাজ। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কৃষক কঠোর পরিশ্রম করে যে ফসল ঘরে তুলেছেন, তা নিয়ে বাড়িতে আনন্দের হাওয়া বইতে পারত। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকের কষ্ট দুর্দশায় রূপ নিয়েছে। সঠিক দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক হতাশ হয়ে নিজের উৎপাদিত ফসল মাঠে নষ্ট করছেন। অনেকে আবার গবাদিপশুকে খাওয়াচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কৃষির প্রতি কৃষকদের আগ্রহ কমে যাবে। যা দেশের কৃষিব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক বলে মনে করা হচ্ছে।
ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফসল উৎপাদনের শুরুতেই কৃষকদের চড়া দামে বীজ, সার, কীটনাশক ও অন্যান্য উপকরণ কিনতে হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয় শ্রমের খরচ। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেও ফসল ঘরে তোলার পর বাজারে তা বিক্রি করে উৎপাদন খরচ ওঠানোও কঠিন হয়ে পড়েছে। যেমন, একটি ফুলকপির উৎপাদন খরচ ১০ থেকে ১২ টাকা। একজন কৃষক বিক্রি করছে ৪ থেকে ৫ টাকা। অথচ একটি ফুলকপির চারার দামই ৩-৪ টাকা। সার, কীটনাশক ও পরিচর্যার খরচ যোগ করে উৎপাদন শেষে প্রতি কেজি ফুলকপি বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ৪-৫ টাকায়। একইভাবে প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি করতে হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকায়। শিমের ক্ষেত্রে চিত্রটা আরো করুণ, প্রতি কেজি শিম ১০-১২ টাকা, যা উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম এবং মুলা ৭-১০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা।
বগুড়া জেলার, শেরপুর উপজেলার ফুলবাড়ী গ্রামের কৃষক ইকবাল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, গত বছর তিনি ফুলকপি উৎপাদন করে দাম বেশি পাওয়ায় লাভবান হয়েছিলেন। গত বছর ১২ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছিলেন। এবার তিনি বেশি দামের আশায় ২০ বিঘা জমিতে ফুলকপির চাষ করেছেন। দাম কম পাওয়ায় বড় অঙ্কের লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন বলে তিনি জানান। প্রতি বিঘা জমিতে তাদের ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে।
একই গ্রামের কৃষক তৌহিদুর রহমান বলেন, এক সপ্তাহ যাবত তিনি পাঁচ টাকা কেজি দরে ফুলকপি বিক্রি করছেন। গত কয়েক বছরে ফুলকপিতে লাভ বেশি হওয়ায় এবার অনেকেই ফুলকপির চাষ করেছেন। তবে উৎপাদন বেশি হয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন অধিকাংশ কৃষক। এমন পরিস্থিতিতে লাভ তো দূরের কথা খরচের টাকা তুলতে পারছেন না তারা।
এদিকে মানিকগঞ্জের একজন কৃষক নয়া দিগন্তকে বলেন, তার এক বিঘা জমিতে যে পরিমাণ ফুলকপি উৎপাদন হয়েছে তাতে মাঝারি আকারের তিনটি ট্রাক ভরা যাবে। তিনি এক বিঘা জমির ফুলকপি বিক্রি করেছেন ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এতে তার প্রতি বিঘাতে ক্ষতি প্রায় ২০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, একটি ফুলকপি ৫ টাকা কেজি বিক্রি করছে কৃষক। অথচ উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি পড়ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। আবার কিছুটা ছোট আকারের ফুলকপির প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৪ টাকায়।
ঢাকার কাওরান বাজারে আবদুল কাদের নামের এক আড়ৎদার বলেন, তিনি প্রতিদিন দেড় শ’ থেকে দুই শ’ মণ ফুলকপি নিয়ে আসেন। গাড়ী হিসাব করলে কোনো দিন এক গাড়ি আবার কোনো দিন দুই গাড়ি ফুলকপি তিনি বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসেন। গতকাল তিনি প্রতি মণ ফুলকপি ২০০ টাকা দরে ক্রয় করেছেন। এসব পণ্য পরিবহন খরচসহ দাম তিনগুণ দাম পড়ে। তারা এসব পণ্য খুব অল্প লাভ রেখে ছেড়ে দিচ্ছেন বলে জানান। তিনি বলেন, তারা এসব কপি পিস হিসেবে বিক্রি করেন। কোনোটা ১০ টাকা। আবার কোনোটা ১২ টাকা। গাড়ি ভাড়া, বস্তা, লেবার খরচসহ আনুষাঙ্গিক মিলে প্রতি পিস কপির দাম পড়ে ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা পড়ে যায়। এদিকে রাজধানীর কল্যাণপুর, শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, এসব বাজারে ভালো মানের একটি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা করে।
বগুড়া জেলার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মমতা হক নয়া দিগন্তকে বলেন, এখন ফুলকপির ভরা মৌসুম। উৎপাদন বেশি হওয়ায় দাম নিম্নমুখী। তবে কৃষক যাতে ভালো দাম পান, এর জন্য তারা কাজ করছেন। যেসব স্থানে চাহিদা বেশি, সেখানে যেন পণ্য বিক্রি করতে পারে এমন সুযোগ খেঁাজা হচ্ছে। বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষকদের জন্য তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। এজন্য কৃষকদের পণ্য বিপণন ও কোন সময় পণ্যের চাহিদা বেশি সেটা জানিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ধরনের শীতের সবজি আসছে। এজন্য কৃষক তাদের উৎপাদিত ফুলকপির দাম কম পাচ্ছেন। আবার এখন যারা ফুলকপিসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করছেন, তারা আগামী মাসে (ফেব্রুয়ারি) ভালো দাম পাবেন বলে তিনি মনে করেন। তখন প্রতি কেজি ফুলকপির দাম ৬০-৭০ টাকা পর্যন্ত আসতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
কৃষি পলিসি নিয়ে কাজ করছেন ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক কর্মকর্তা বলেন, কৃষকের পণ্যের দাম নিশ্চিত করতে বাজার মনিটরিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পণ্য বিক্রির জন্য মাঝপথে অনেক চ্যানেল রয়েছে। এসব চ্যানেল যতটা কমিয়ে আনা যায়, তত ভালো। একই সাথে মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়মিত কৃষকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কৃষক যাতে ন্যায্য মূল্য পান এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বাজার ব্যবস্থাপনায় সঠিক পদক্ষেপ। চাহিদা ও উৎপাদনের ভারসাম্য রাখতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা