দেশের স্বার্থে মৌলিক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে
- খালিদ সাইফুল্লাহ
- ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০, আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:৫৫
দেশের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, দেশ আমাদের সবার। কে কোন দলের, কে কোন ধর্মের-বর্ণের, এটা বড় বিষয় নয়। সবার আগে দেশ। নতুন একটি বছর শুরু হয়েছে। দেশবাসীর কাছে প্রত্যাশা করি, আহবান জানাই দেশের স্বার্থে মৌলিক বিষয়গুলোতে আমরা যেন ঐক্যবদ্ধ থাকি। রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়ে যদি মজবুত ঐক্য থাকে, ইনশাআল্লাহ এ দেশ-জাতির কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। অতীতে যারা অপকর্ম করেছে তাদের বিচার নিশ্চিত হোক এটা আমরা দাবি করি। তবে তাদের অপকর্ম নিয়ে বেশি মাতামাতি না করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ রচনা করি এবং পরিকল্পনা করি। বিভিন্ন অংশীজন এখানে আছে, রাজনৈতিক পক্ষ আছে, সুশীলসমাজ আছে, সমাজের বিভিন্ন সার্ভিস প্রোভাইডার আছে, তাদের সবার কাছে আমাদের প্রত্যাশা ও আহবান আমাদের সব কার্যক্রম দেশের স্বার্থে পরিচালনা করা হোক। ঐক্যের জায়গাটা আমাদের মজবুত থাকুক। ঐক্য বিনষ্ট হয়, এ রকম কোনো উদ্যোগ ও কার্যক্রম যেন আমরা কেউ না চালাই, সেটা আমিসহ সব পক্ষের কাছেই আহবান থাকবে।
রাজধানীর মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জামায়াত আমির ডা: শফিকুর রহমানের সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরা হলো-
নয়া দিগন্ত : অনেক বছর জামায়াত মুক্ত পরিবেশে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি, অফিসগুলোও বন্ধ ছিল, এখন সম্পূর্ণ অনুকূল পরিবেশ। আপনারা কেমন অনুভব করছেন?
জামায়াত আমির : ধন্যবাদ এই প্রশ্ন করার জন্য। আসলে জামায়াতে ইসলামীর শুধুমাত্র অফিস বন্ধ ছিল না। আওয়ামী সরকার সবদিক থেকেই জামায়াতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছর এবং মঈন-ফখরুদ্দীনের দুই বছর মিলে সাড়ে ১৭ বছর ধরেই আমাদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালানো হয়েছে। আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসসহ সারা দেশের অফিসগুলো গায়ের জোরে বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি আমাদের ঘরেও থাকতে দেয়নি। অনেক জায়গায় আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় তারা বুলডোজারও ব্যবহার করেছে। এর পাশাপাশি আমাদের নিবন্ধন অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর শাহবাগ মোড়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মাসের পর মাস রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রবিরোধী অনেক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। সেই সময় যেভাবেই হোক একটি সরকার ছিল, পাশাপাশি আরেকটি সরকারের কথায় জাতীয় পতাকা উঠতো এবং নামতো। আইনগতভাবে তাদের এ ধরনের এখতিয়ার ছিল না। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলতেন ‘আমার শরীরটা পড়ে থাকে সংসদে আর মন পড়ে থাকে শাহবাগে।’ এভাবে তাদের উসকানি দিয়ে সারা দেশে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে, নারী-পরুষ নির্বিশেষে জেলে ভরা হয়েছিল। এমনি শিশুদেরকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বৃদ্ধদেরও ছাড় দেয়া হয়নি। বিপুলসংখ্যক সহকর্মীকে, জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ খুন করা হয়েছে। অনেককে পঙ্গু করা হয়েছে। অনেককে গুম করা হয়েছে। আর বিচারের নামে যে প্রহসন করা হয়েছে, তামাশা করা হয়েছে, সেটা বাংলাদেশ এবং বিশ্ব পর্যালোচনা করেছে। দফায় দফায় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও সংস্থা, এ বিচারের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে। কিন্তু স্বৈরাচার সরকার এগুলো কানে তোলেনি।
আমাদের সভা-সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকার কোথাও প্রয়োগ করতে দেয়নি; দু’টি ছাড়া। একটি ২০২৩ সালের ১০ জুন এবং আরেকটি ২৮ অক্টোবর। ১০ জুন নানা নাটকীয়তার পর সরকার অনুমতি দেয়। আর ২৮ অক্টোবর সরকার অনুমতি না দিলেও জামায়াত সমাবেশ করবে এমন ঘোষণা দিলে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। তখন আমি জেলে ছিলাম। সেই অধ্যায়ে অনেক দুঃখ, অনেক কষ্ট আছে। আমরা একে একে আমাদের ১১ জন শীর্ষস্থানীয় দায়িত্বশীলকে হারিয়েছি। পাঁচ শতাধিক সহকর্মীকে আমরা জুলাই বিপ্লবের আগেই হারিয়েছি। জুলাই বিপ্লবের সময়ও আমরা বহু সহকর্মীকে হারিয়েছি, সেই সংখ্যাটি বলতে চাচ্ছি না। যেহেতু জাতির সামগ্রিক পরিবর্তনের একটি আন্দোলন ছিল সে জন্য শহীদদেরকে আমরা কোনো দলীয় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে একেবারেই রাজি না। এই আন্দোলনের ক্রেডিটও আমরা কোনোভাবেই দাবি করার পক্ষে নই। আমরা মনে করি এ ক্রেডিট ১৮ কোটি মজলুম মানুষের। নেতৃত্ব দিয়েছে আমাদের যুবসমাজ, ছাত্র-ছাত্রীরা। আমরা এজন্য গর্বিত। তাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।
দল হিসেবে আমাদের ওপর যে নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়েছে, তা অন্য কারো প্রতি হয়নি। যেমন অফিস আর কোনো দলের এভাবে পুরো সময়জুড়ে বন্ধ ছিল না। নিবন্ধন কারোরই কেড়ে নেয়া হয়নি, কাউকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কারো বাড়িঘরে বুলডোজার চালানো হয়নি। এসবগুলোই ছিল আমাদের ওপর একক। তবে অন্যদলগুলোর ওপরও তারা নির্যাতন করেছে, তাদের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়েছে, জেলে পুরেছে, পঙ্গু করেছে, গুম-খুন করেছে। কিন্তু এই চারটি জিনিস আর কারো ক্ষেত্রে ঘটেনি। শুধু এককভাবে জামায়াতের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ছাত্রশিবিরকে কোনো প্রতিষ্ঠানে সহ্য করা হতো না। তাদের নামের ছায়া পর্যন্ত তারা বরদাশত করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখেছি আবরার ফাহাদের কথা। তার দুটো দোষ। একটা হলো-সে দেশের পক্ষে ফেনী নদীর পানি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছে। অপরটি ছিল সে নামাজ পড়ত। তাকে বলেছে তুই যখন নামাজ পড়িস তাহলে তুই শিবির করিস। আর তুই শিবির বলে এই কাজ করেছিস। শিবির হওয়া সেই সময় মহাপাপের মতো তুলে ধরত। এমনকি মিডিয়াগুলোও বলতো শিবির সন্দেহে। মানে ব্যাপারটা চোর-ডাকাতের মতো, শিবির সন্দেহে হবে কেন? শিবির তো তখন কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন ছিল না। সরাসরি বলতে পারতো শিবিরের কর্মী বা শিবিরের নেতা। এটা না বলে বলতো শিবির সন্দেহে। এভাবে সারা দেশে একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। এমনকি ছাত্রী সংস্থার মেয়েদের সাথেও তারা দুর্ব্যবহার করতো, পিরোজপুরের ঘটনা তার সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ। সেই অবস্থা থেকে ৫ আগস্টের এ মহাপরিবর্তনের মাধ্যমে শুধু আমাদের নয়, গোটা জাতিকেই আল্লাহ তায়ালা মুক্তি দিয়েছেন। এজন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আর এই মুক্তির জন্য যেসব শহীদ রক্ত দিয়েছেন এবং পঙ্গু-আহত ভাইবোনদের ত্যাগ কোরবানিকে গভীরভাবে স্মরণ করছি। আলহামদুলিল্লাহ। আমরা এখন কিছুটা স্বস্তির সাথে কার্যক্রম চালাতে পারছি। মানুষের কাছে আমাদের বক্তব্য নিয়ে যেতে পারছি। এ জন্য আল্লাহ তায়ালারও শুকরিয়া আর দেশবাসীর জন্যও আমাদের শুভকামনা যে দেশবাসীও আমাদের সেভাবে গ্রহণ করছে।
নয়া দিগন্ত : বিগত সময়ে আপনাদের ওপর যে অন্যায়-অত্যাচার হয়েছে তার কি বিচার প্রত্যাশা করেন?
জামায়াত আমির : অবশ্যই। প্রতিটি অপরাধের বিচার চাই আমরা। আমাদের নেতৃবৃন্দকে বিচারের নামে অবিচার করে জুডিশিয়াল কিলিং করেছে। ফরমালি এর বিচার চাইতে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। যাদেরকে গুম করা হয়েছে, তাদের পরিবার-আত্মীয়স্বজন মামলা করবে, অনেক জায়গায় মামলা করেছে, আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এমনকি শুধু আমাদের নেতাকর্মী নয়, যেকোনো নিরীহ মানুষকে গুম-খুন করার পর, পঙ্গু করার পরে যদি তাদের পরিবার মামলা করে আর আমাদের কোনো সহযোগিতা চায় তাহলে আমরা তাদেরকেও সহযোগিতা করব। জুলুম শুধু আমাদের ওপর নয়, পুরো জাতির ওপর হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই, ন্যায়বিচার চাই। আমরা ওদের মতো অবিচার চাই না। ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলেই ভিকটিম ও তাদের পরিবার কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পাবে।
নয়া দিগন্ত : আপনার একটি বক্তব্য নিয়ে সম্প্রতি বেশ সমালোচনা হচ্ছে। আপনি আওয়ামী লীগকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। বিষয়টি যদি একটু পরিষ্কার করেন।
জামায়াত আমির : কিছু মিডিয়া এ অপকর্ম করেছে। আমি যা বলিনি তা লেখা হয়েছে জাতিকে উসকানি দেয়ার জন্য। ভিতরের নিউজে এটি নেই। শুধু হেডিং দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। আমি সাধারণ ক্ষমার কথা মুখে উচ্চারণও করিনি। যদি ওই বক্তব্যের ভিডিও দেখেন তাহলে এর প্রমাণ পাবেন। আমাদের ফেসবুক পেজে এবং ইউটিউবে এটা দেয়া আছে। কারণ সাধারণ ক্ষমা করার এখতিয়ার একমাত্র দেশের প্রেসিডেন্ট ছাড়া কারো নেই। আমরা কে সাধারণ ক্ষমা করার? তাছাড়া আওয়ামী লীগের নামও নেইনি। বলেছি, যারাই অতীতে আমাদের ওপর বিভিন্ন ভাবে জুলুম করেছে, আমরা দল হিসেবে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেব না। তবে প্রতিটি অন্যায়ের বিচার চাই। যদি ভিকটিম পরিবার আইনের আশ্রয় নেয় আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, অতীতে আরো অনেকে আমাদের ওপর জুলুম করেছে।
নয়া দিগন্ত : জামায়াতকে বর্তমানে অনেক সভা-সমাবেশ করতে দেখা যাচ্ছে। আপনিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা জেলায় জেলায় সমাবেশ করছেন। এটা কি নির্বাচনের প্রস্তুতি?
জামায়াত আমির : না। আমরা দীর্ঘ সময় কার্যক্রম চালাতে পারিনি। আমাদের কর্মীরাই আমাদেরকে অনেক দিন পায়নি। অনেক কর্মী কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের দেখেইনি। এমনকি আমাদের অনেক রুকনও দেখেনি। এটা আমাদের নিজস্ব কর্মসূচি। এখন আমরা কর্মী সম্মেলন করছি। আমরা জনসভা করছি না। জনসভা যখন করব তখন সেটা হবে নির্বাচন সংক্রান্ত। কর্মীদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নয়া দিগন্ত : জাতীয় নির্বাচন কত দিনের মধ্যে হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
জামায়াত আমির : এটার দিন তারিখ ক্ষণ কোনো দলের পক্ষে ঠিক করে দেয়া সম্ভব নয়। তবে একটা প্রত্যাশা থাকে। জাতি দীর্ঘদিন সঠিক নির্বাচন পায়নি। ২০১৪ সালে পায়নি, ১৮ সাল, ২৪ সালেও পায়নি। এখন যাদের বয়স ২৬-২৭ হয়েছে তারা কোনো নির্বাচনে ভোট দেয়নি। এজন্য আগে ভোটের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। আমরা জানি যে, গত সরকার অনেকগুলো সমস্যা সৃষ্টি করে রেখে গেছে। যাদেরকে দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা হবে সেসব জায়গায় সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কিছু বিধি ও আইনের সংস্কারের প্রয়োজন আছে। অতীতে নির্বাচিত সরকারকে এ ধরনের সংস্কার করতে দেখা যায়নি। যেহেতু একটি নির্দলীয় সরকার আছে। কোনো দলের প্রতি তাদের বিশেষ আনুগত্য নেই। তাদেরকে সামনে রেখে জনগণের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় কিছু মৌলিক সংস্কার হয়ে যাওয়া উচিত। এ সংস্কারগুলো হলে পরেই নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল মাঠ তৈরি হবে। তখন জনগণের ভোট দেয়ার পরিবেশ নিশ্চিত হবে। আমরা সরকারকে এ পর্যন্ত সময় দেয়ার পক্ষে।
ভোটার তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন দেখবে কেউ বাদ পড়ল কিনা। আমরা অবশ্য বলেছিলাম ঘরে ঘরে গিয়ে আপডেট করা উচিত। কারণ বিপুল সংখ্যক মানুষ এর আওতার বাইরে ছিলেন। আর দেশে ও প্রবাসে যারা আছে সবাই মিলেই দেশ। এজন্য প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল তাদের ভোটার করার। তাদের রেমিট্যান্স আমরা নিচ্ছি। রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলে মৌখিকভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছি। আর তাদের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করব না; তাতো হতে পারে না উন্নত অনেক দেশে প্রবাসীদের ভোটার করা হয়েছে। আমরা বলেছি এটাও নিশ্চিত হতে হবে। সংশ্লিষ্ট দূতাবাস ও হাইকমিশনের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা যায়। এই বেসিক কার্যক্রমগুলো পরিচালনা প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের মাঝামাঝি হতে পারে। আমরা এটাকে অযৌক্তিক মনে করছি না। কিন্তু এটা আরো ভালো হবে যদি তারা স্পষ্ট করে বলেন এই মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে তাহলে আস্থার একটি পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং সব দল সেভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারবে।
নয়া দিগন্ত : কোনো কোনো দল বলছে সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, তারা নির্বাচন আগে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
জামায়াত আমির : আসলে বিভিন্ন দলের বক্তব্য ভিন্ন ভিন্ন। বেশির ভাগ দল বলছে বেসিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করেই নির্বাচন হওয়া উচিত। আবার কোনো দল বলছে নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংস্কার নয়। আবার একই দলের ভিন্ন নেতা বলছে সংস্কার হতে পারে তবে তার জন্য খুব বেশি সময় নেয়া যাবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দিয়ে দিতে বলছেন। কেউ আবার বলছে সংস্কারের দরকার নেই, এখনই নির্বাচন দিয়ে দেন। এ রকম বহুমাত্রিক কথা আসছে। এই বক্তব্য এক ধারার না। একই দলের নেতাদের মধ্যেও ভিন্ন বক্তব্য আসছে। আমরা আমাদের জায়গায় আছি। আমরা বলেছি বেসিক সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে।
নয়া দিগন্ত : বর্তমানে জামায়াতের বেশ জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। জামায়াত কি আগামী নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেবে?
জামায়াত আমির : আমাদের যে সমাবেশ হচ্ছে তা কর্মীদের নিয়ে সমাবেশ। এখানে সাধারণ জনগণকে আমরা দাওয়াত দিচ্ছি না। সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে যেটা হবে সেটা জনসভা হবে। জনসভা হলে মানুষের সমাগম কী হলো না হলো সেটা পরে দেখা যাবে। আর জনসমাগমের ওপর নির্ভর করে একটি দল তার নির্বাচনী পলিসি করবে না। আমরা এককভাবে নির্বাচন করব নাকি দেশের স্বার্থে, বৃহত্তর স্বার্থে সবাই মিলেমিশে নির্বাচন করব সেটি বলার সময় এখনো আসেনি। নির্বাচনের আবহ তৈরি হলে অনেক পোলারাইজেশন হবে, সবদিক দেখে জাতির স্বার্থ সামনে রেখে ইনশাআল্লাহ আমরা সিদ্ধান্ত নেব। নির্বাচন যেকোনো তিন ফর্মে অংশগ্রহণ হতে পারে। এককভাবে হতে পারে, আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে হতে পারে, অথবা কোনো অ্যালায়েন্সের ভিত্তিতে হতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা এখনো কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেইনি।
নয়া দিগন্ত : আগামী নির্বাচনে জামায়াত কতটি আসনে প্রার্থী দেবে?
জামায়াত আমির : জাতীয়ভাবে যতগুলো সংগঠন আছে তারা তো ৩০০ আসন নিয়েই তাদের দেশকে বিবেচনা করে। জামায়াতও সেভাবেই বিবেচনা করে। একটি জাতীয় সংগঠন হিসেবে ৩০০ আসনকে সামনে রেখেই চিন্তা করতে হবে। কিন্তু ৩০০ আসনেই আমরা দলীয়ভাবে করব কি না, আমাদের দলেরই প্রার্থী দিবো কি না, সেটি বলার সময় এখনো আসেনি। সময় এলে আপনারা জানতে পারবেন।
নয়া দিগন্ত : আগামী নির্বাচনে বিএনপি ও ইসলামী দলগুলোর সাথে আপনারা কোনো জোট গঠন করবেন কি না?
জামায়াত আমির : আমরা আসলে সুনির্দিষ্ট কোনো দলের সাথে জোট করার এখনো কোনো উদ্যোগ নেইনি এবং সে ব্যাপারে কোনো বক্তব্যও আমরা দেইনি। আমাদের কাছেও এ ধরনের কোনো বক্তব্য আসেনি। আমরা যারা ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারা পাশাপাশি থেকে লড়াই করেছে তাদের সবার সাথেই কমবেশি মতবিনিময় হয়েছে। আমাদের হয়েছে, অন্যদেরও হচ্ছে। জোট কিংবা সমঝোতার জন্য দুটো জিনিস অবশ্যই লাগবে। একটা হচ্ছে সব পক্ষের একই ফিলিংস যে, আমরা এটি করতে চাই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- চিন্তা ও কর্মসূচির মিনিমাম মিল থাকতে হবে। এখন সেই মিনিমাম মিল যাদের সাথে হবে, তাদের সাথে সমঝোতা বলেন, জোট বলেন যেকোনো সময় করা যাবে। এবং এটা দেশের স্বার্থে হবে।
নয়া দিগন্ত : রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জামায়াতে ইসলামী কতটা প্রস্তুত?
জামায়াত আমির : বেসিক একটি প্রশ্ন এটি। এখন যদি জনগণ আমাদেরকে তাদের রায় দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয় তাহলে আমরা প্রস্তুত কি না? জনগণকে বাদ দিয়েতো জামায়াতে ইসলামী নয়। একটি দল রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এর মানে কি পিয়ন থেকে রাষ্ট্রপতি সবাই দলেরই হতে হবে? এ দেশের যোগ্য মানুষদের যোগ্য জায়গায় বসিয়ে তাদেরকে কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে হবে এবং একটি দল যেভাবে দেশ পরিচালনা করতে চায়, এই চাওয়ার সাথে যারা সার্ভিস প্রোভাইডার তাদের চাওয়াকে মিলাতে হবে এবং তাদের কার্যক্রমকে মিলাতে হবে। এখন যারা বিভিন্ন দায়দায়িত্বে আছেন যেহেতু একটি পরিবর্তন হয়ে গেছে, এখানে কেউ যদি সুনির্দিষ্ট অপরাধের সাথে জড়িত হন তার তো বিচার হবে, এটা আলাদা। কিন্তু সবাই তো এ রকম না। বাকি যারা যে জায়গায় আছেন, যোগ্য মানুষ সেই জায়গায়ই থাকবেন। আমরা আসার সাথে সাথে সবাইকে বাদ দিয়ে নতুন লোক দিয়ে দিলে তাহলে এই লোকগুলো যাবে কোথায়? তাদের অধিকার সংরক্ষণ হবে কিভাবে? আমাদের দুটি বিষয় দেখতে হবে- একটি হলো-যেন দুঃশাসনের আবহ সৃষ্টি না হয়, আর একটি হলো যেন দুর্নীতির প্রবাহ সৃষ্টি না হয়। এই দুর্নীতি আর দুঃশাসন যদি আটকানো যায় তাহলে আমরা এ দেশের মানুষকে সুশাসন উপহার দিতে পারব ইনশাআল্লাহ। এ ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর।
নয়া দিগন্ত : রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে কোন কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেবে জামায়াত?
জামায়াত আমির : শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। শিক্ষাকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। দুটি দিক- একটি হলো নৈতিক শিক্ষা যা এখানে নাই বললেই চলে, আরেকটি হচ্ছে বৈষয়িক শিক্ষার যে মান সেটাও নাই বললেই চলে। আমরা আগে একটি মানসম্মত শিক্ষা জাতিকে উপহার দেয়ার চেষ্টা করব। শিক্ষার জায়গাটা যদি ঠিক হয় তাহলে সমাজের সব ক্ষেত্রে সঠিক মানুষগুলোই যার যার জায়গায় সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারবে। কিন্তু শিক্ষাই যদি মানসম্মত না হয়ে এলোমেলো হয় তাহলে একটি ভালো জাতি গড়ে তোলা অসম্ভব। এটা আমাদের একনম্বর অগ্রাধিকার।
দ্বিতীয় অগ্রাধিকার থাকবে দুর্নীতি রোধ। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে, যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর ছোট একটি গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে। তারাও এটি ভোগ করতে পারে না। তারা বিদেশে টাকা পাচার করছে। তা ছাড়া ঘুষ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি থাকার কারণে সমাজের ঘাটে ঘাটে সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে। ছোট ব্যবসায়ীদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। বাজারে গেলে সাধারণ মানুষের মাথা ঘুরে যাচ্ছে। দুর্নীতি-দুঃশাসনের কারণে এটি হচ্ছে। আমরা দুর্নীতি বন্ধে কাজ করব। তৃতীয় অগ্রাধিকার থাকবে বিচার বিভাগ। যে দেশে বিচার বিভাগ সঠিকভাবে ফাংশন করে, সেই সমাজও সঠিক হয়। কিন্তু বিচারের আসনে বসে যে দেশে অবিচার করে সে দেশে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় এবং মানুষের কোনো অধিকারই বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। এরপর অর্থনীতি, ব্যাংক-বীমা, ননব্যাংকিং সেক্টর দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। গত সরকার উন্নয়নের কথা বলে সব ব্যাংক ফোকলা করে চলে গেছে। এখন আমরা পুরো জাতি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছি। এ রকম আরো কিছু বিষয় আছে। যেগুলো ঠিক করে দেশকে সাজাতে হবে। সবার সহযোগিতা নিয়েই সাজাতে হবে।
নয়া দিগন্ত : জামায়াতে ইসলামী নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। নারী, সংস্কৃতি, সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে অনেকে বলতে চান। আসলেই কি তাই ঘটবে?
জামায়াত আমির : আমাদের বিরুদ্ধে অনেক আজগুবি অভিযোগ করা হয়। যেসব বিষয়ে আমরাও জানি না। সেগুলো আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। আমরা একটি আদর্শিক দল। দলের নেতাকর্মীদের কার্যক্রম যা আছে এটাকে যারা স্বচ্ছভাবে, সৎভাবে মোকাবেলা করার সৎ সাহস রাখে না, তারাই আমাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ছড়ান। এর সাথে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই। নারী কেন; কোনো সভ্য রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকই ইচ্ছামতো যেমন চাই তেমন চলতে পারে না। রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্য থেকে সংবিধান মেনেই তাকে চলতে হয়। এটা শুধু নারী কেন, পুরুষকেও রাষ্ট্রের কাঠামো মেনে চলতে হয়। নারী ছাড়া কি একটি সমাজ গঠন হয়? পরিবারই তো নারী ছাড়া গঠন হয় না। সেখানে এত বড় রাষ্ট্র নারী ছাড়া কিভাবে গঠন হবে? এজন্য নারী-পুরুষ সবার সম্মিলিত চেষ্টায় একটি সমাজ সুন্দর হতে পারে এবং উন্নতি অগ্রগতির দিকে যেতে পারে। উন্নতি টেকসই হয়। নারীরা ঘরের মাঝে যে কাজ করেন তার একটি স্বীকৃতি আছে। আবার অনেকে চাকরিতে যান। যদি কারো সে রকম প্রয়োজন থাকে, আগ্রহ থাকে, যোগ্যতা থাকে তিনি নারী বা পুরুষ হোন তিনি তার জায়গা পেয়ে যাবেন। সেখানে রাষ্ট্রকে কিছু দেয়ার এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অবদান রাখার সুযোগ পাবেন। রাসূল সা: নারীদের যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে গেছেন। শিক্ষায় তাদের নিয়োগ করেছেন, ব্যবসা করেছেন। মা খাদিজা একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন।
এগুলো তো প্রতিষ্ঠিত সত্য। এগুলো যারা ইসলাম সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না, মানুষের মধ্যে এক ধরনের কনফিউশন তৈরি করার জন্য তারা এ অপপ্রয়াস চালায়। আমাদের কার্যক্রমতো মানুষ দেখছে। আমরা তো আমাজন থেকে আসিনি। এ দেশেই আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, এ সমাজেই আমরা চলাফেরা করি। আমরা কেমন, আমরা কিভাবে কার্যক্রম চালাই, ব্যবসা ব্যাণিজ্য করি, বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান চালাই তা মানুষ দেখে। সবই তো মানুষের চোখের সামনে হচ্ছে। এগুলো যারা বলে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত ক্ষতি করার জন্য বলে।
নয়া দিগন্ত : জামায়াতে ইসলামীকে অনেকে মৌলবাদী, স্বাধীনতা বিরোধী ও ভারত বিরোধী দল বলে থাকেন। এ ছাড়া ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে আপনাদের অবস্থান জানতে চাই।
জামায়াত আমির : আমরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করি না, আমরা ধর্মের রাজনীতি করি। আমরা যে ধর্মে বিশ্বাস করি এটা রাজনীতি থেকে বহির্ভূত না। যদি হতো তাহলে রাসুল সা: এবং পরে খোলাফায়ে রাশেদীন দুনিয়া শাসন করতেন না। রাজনীতির উদ্দেশ্য কী? রাজনীতির উদ্দেশ্য হলো সুশাসন উপহার দেয়া। আর এর ভেতরে রাষ্ট্রের সব কিছু সার্ভিস আছে। আমরা এটা করি। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি তারা করেন যারা নির্বাচন এলে মাথায় হিজাব-টুপি দেন, এর আগে দেন না। নির্বাচন এলে মসজিদে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন, সালাম দেন। কবর জিয়ারত করেন। ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগান। আমরা প্রতিদিনই নামাজ পড়ি, আল্লাহর দেয়া বিধান মেনে চলার চেষ্টা করি। দলীয়জীবনে প্রাকটিস করি। আল্লাহ এ বিধান দিয়েছেন সবার জন্য। আমরা সেটা মেনে চলি। আমরা সে বিধানের পক্ষেই কথা বলি। এটাই আমাদের রাজনীতি।
স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের কোন কাজটা স্বাধীনতা বিরোধিতার পর্যায়ে পড়ে? ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতাবিরোধী কোন কাজটি করেছি। ১৯৭১ সালে শুধু আমরা নয়, সে সেময় অনেক দল বিরোধিতা করেছিল। বামপন্থী দলও ছিল। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি তো বাংলাদেশ হওয়ার পরও স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। একটি ইসলামী দল, মুসলিম জাতীয়তাবাদী দলও যুদ্ধে যায়নি। বামপন্থীরা অনেকে যায়নি। মাওলানা ভাসানীর দল যুদ্ধ করতে গেলেও পারেননি। তাদের জায়গা দেয়া হয়নি। সেটা ভিন্ন কথা।
জামায়াতের কনসেপ্ট ছিল- যদি ভারতের সহায়তায় দেশ স্বাধীন হয়, ভারত একটি বৃহৎ দেশ-তাহলে আদৌ সেই স্বাধীনতার সুফল বাংলাদেশের জনগণ উপভোগ করতে পারবে কি না সন্দেহ ছিল। গত ৫৩ বছরে এই রায় অলরেডি জনগণ পেয়ে গেছে যে আমরা সেই সুফল ভোগ করতে পেরেছি কি না। কারণ স্বাধীন দেশে আরেক দেশের পররাষ্ট্র সচিব এসে যখন ঠিক করে দেন কে নির্বাচনে যাবে আর কে যাবে না, কে কার সাথে জোটে যাবে, কে সরকার গঠন করবে, কে বিরোধী দলে বসবে। এটা কি স্বাধীনতার উপর নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ নয়? এরকম একটা দুইটা নয়, বহু ঘটনা দেশে ঘটেছে।
’৭১ এ জামায়াত নেতারা যে আশঙ্কা করেছিলেন, আমি তখন ছোট, আমি তখন ওই দলও করতাম না, এখন বাস্তবে সেটিই হয়েছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে তার চেয়েও বেশি ঘটতে দেখেছে জনগণ। এই জায়গায় জামায়াতের আশঙ্কার জায়গা ছিল।
আমাদের ভারতবিরোধী বলা হয়। আমরা ভারত কেন; কোনো দেশেরই বিরোধী নই। আমরা আমাদের দেশের পক্ষে। আমাদের দেশের জনগণের অধিকার এবং তাদের স্বার্থকে দেখাই আমাদের দায়িত্ব। এটা শুধু আমাদের নয়, যে দলই এ দেশে রাজনীতি করবে তাদের সবাই দেশ ও জনগণের পক্ষে কাজ করবে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ যদি কারো দ্বারা বিঘ্ন হয় তাহলে দলের প্রথম দায়িত্ব হলো নিজের দেশকে আগে সতর্ক করা। দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছে, আমার অধিকার যে কেড়ে নিচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। জামায়াত এ দুই নীতির বাইরে যায়নি। আমরা ভারতকে প্রতিবেশী হিসেবে সম্মান দেখাতে চাই। কিন্তু আমরা এটাও আশা করি ভারতও আমাদের সম্মান করবে। আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতেও তাই লেখা আছে। সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়। প্রতিবেশীদের সাথে শত্রুতা করে লাভ নেই। আমি প্রতিবেশীকে কষ্ট দিলে সেও আমাকে কষ্ট দিবে। এটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। কোনো দেশপ্রেমিক দল এটা চাইতে পারে না। আমরাও এটা চাই না। আমরা তো ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলি না। ভারত যদি আমাদের দেশে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে আমরা তার প্রতিবাদ করি। এটা ভারত কেন যে কোনো দেশ হলেই করব। ফেলানির লাশ ঝুলবে আর কথা বলব না? সীমান্তে লাশ পড়ে থাকবে আর কথা বলব না? তিস্তার পানি দেবে না, কথা বলব না? তা কি হয়?
নয়া দিগন্ত : অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাস পার হয়েছে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবোত্তর নতুন বাংলাদেশে তারা জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ করতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
জামায়াত আমির : তাদের ঘাড়ে একটি দুর্বহ বোঝা চেপেছে। তারা কি বলেছিল আমাদের সরকারে বসিয়ে দাও! একজনও বলেনি। তাদেরকে আমরা বসিয়েছি। গণবিপ্লবের কারণে মানুষের মনে আকাক্সক্ষা জন্ম নিয়েছে যে, আমরা এ দেশে সম্মান ও মর্যাদার সাথে বাঁচতে পারব। তাদের কাছে আমাদের দুটি বেসিক চাহিদা। একটি হলো কয়েকটি মৌলিক সংস্কার। আর দ্বিতীয়টি হলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। এ ছাড়া যতক্ষণ তারা দায়িত্বে থাকবেন ততক্ষণ দেশে যতটুকু পারে সুশাসন কায়েম করা, আইনশৃংখলা রক্ষা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর লেখাপড়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা ইত্যাদি। আমরা দেখছি তারা চেষ্টা করছে। তবে তাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। এটা জাতিকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু তাদের সুষ্ঠুভাবে সেটা করতে দিচ্ছে না। যারা পরাজিত হয়েছে তারা শুরু থেকেই বাধা দিচ্ছে। শেখ হাসিনা বিদেশে বসে উসকানি দিচ্ছেন। তারা আগে যেভাবে তাণ্ডব করেছিল, এখনো তাই করতে চাচ্ছে। কিন্তু জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের কারণে সেটি ভেস্তে গেছে।
নয়া দিগন্ত : অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তাতে আপনারা কতটুকু সন্তুষ্ট?
জামায়াত আমির : তারা বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কমিটিগুলো কেবল সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো নিয়ে টেবিলে আলোচনা হবে। তারপর বোঝা যাবে। সফলতা সবার সহযোগিতার উপর নির্ভর করছে।
নয়া দিগন্ত : অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
জামায়াত আমির : অনেক প্রত্যাশাই তাদের কাছে আছে। কতটুকু পূরণ করতে পারবে তা জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু সহযোগিতা করবে তার ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এখন শীতকালে স্বাভাবিকভাবেই দ্রব্যমূল্য কিছুটা কমেছে। কিন্তু এখানে যে সিন্ডিকেট রয়েছে সেটি আগে ভেঙ্গে দিতে হবে। যেসব পণ্য আমদানি করা হয় সেটি বাড়াতে হবে। যেগুলো দেশে উৎপাদন হয় সেটি সংরক্ষণ বাড়াতে হবে। তাহলে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। জনগণের জন্য সহনীয় হবে। দ্বিতীয়ত, সংস্কারের বেসিক কাজ সেরে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা এবং জনগণের কাছে স্পষ্ট করা যে কখন তারা নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। তৃতীয়ত হলো, যারা অপকর্ম করেছে তারা এখনো অনেক জায়গায় রয়ে গেছে। তাদের বিচার করা। বিশেষ করে বড় মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা। এটা সবার জন্য শিক্ষণীয় হবে। বড় অপরাধীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। এরপর শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। বই বছরের প্রথম দিন দেয়া যায়নি যুবলীগের এক নেতার কারণে। তাকে শাস্তি দিতে হবে। দ্রুত বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া। ব্যাংকিং সেক্টর এখনো ঠিক হয়নি। এখনো অনেক দুর্বৃত্ত সেখানে বসে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সব ব্যাংকই ঠিক করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনকারী ছাত্রদের নতুন দল গঠন করার উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে। এটাকে কিভাবে দেখছেন?
জামায়াত আমির : যারা ছাত্রজীবন শেষ করেনি জাতীয় রাজনীতিতে তাদের না আসা ভালো। আগে তারা শিক্ষা জীবন শেষ করুক। তারা আগে তাদের নিজেদের তৈরি করে নিক। তবে ছাত্রজীবন শেষ হয়ে গেলে, ২৫ বছর বয়স হলে এমপি পদে নির্বাচন করা যায়, সেজন্য তাদের রাজনীতিতে আসায় কোনো বাধা থাকা ঠিক নয়। এটা তাদের নাগরিক অধিকার। তাদের যদি ছাত্রত্ব শেষ হয়ে থাকে তারা রাজনৈতিক দল করবে, এটা নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এ রকম তো আরো অনেক দল আছে।
নয়া দিগন্ত : অনেকে আশঙ্কা করছেন তারা কিংস পার্টি করবে কিনা?
জামায়াত আমির : কিংস পার্টি হবে যদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়। যেহেতু এটি অরাজনৈতিক সরকার, তাদের উচিত হবে না সুনির্দিষ্ট কোনো দলকে সাপোর্ট করা এবং এটাও উচিত হবে না- কোনো একটি দলের চাপের কাছে মাথানত করা। বরং তারা দায়িত্ব পালন করবেন সংবিধান ও অর্পিত দায়িত্বের আলোকে।
নয়া দিগন্ত : আপনাকে ধন্যবাদ।
জামায়াত আমির : আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা