দ্বিগুণ দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে এ দেশে!
প্রতি কেজিতে সরকারের শুল্ক ৪০.৫০ টাকা- নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো
- ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বিগত পতিত সরকারের আমলে বিভিন্ন আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে যেমনি জনগণের পকেট কাটা হতো তেমনি ফ্যাসিস্ট ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছামাফিক দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটত। কিন্তু সরকার পতনের পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও রমজানের অতিচাহিদা সম্পন্ন পণ্য চিনির শুল্ক অনেকটা আগের মতোই রয়ে গেছে। প্রতি এক কেজি আমদানি করা পরিশোধিত চিনিতে সরকার শুল্ক কর নিচ্ছে ৪০ টাকা ৫০ পয়সা, যা এক কেজি চিনির আমদানি মূল্যের অর্ধেক। এটাকে রীতিমতো জনগণের সাথে তাচ্ছিল্য বলছেন ভোক্তারা। তা ছাড়া এক দিকে দেশীয় বেসরকারি চিনিকলগুলোর আমদানি কমেছে, অন্য দিকে রমজানের বাড়তি চাহিদা মাথায় রেখে এখনই পরিশোধিত চিনি আমদানির উদ্যোগ নেয়া না হলে সঙ্কট বাড়বে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের উচিত অর্থনৈতিক লাভালাভের চেয়ে জনতুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে শুল্ককর কমানো।
রমজানের আর মাত্র দেড় মাসের কিছু বেশি সময় বাকি। কিন্তু এখনো চিনির আমদানি পর্যাপ্ত নয়। পাকিস্তানের সাথে সরাসরি জাহাজ যোগাযোগ চালু হওয়ার পর প্রায় ২৫ হাজার টন পরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে বাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাবও লক্ষ করা গেছে।
কিন্তু সরকার চিনির আমদানি পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করলেও এর প্রভাব খুব একটা উল্লেখযোগ্য নেই। বরং ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড এমনকি নেপালের নাগরিকদের চেয়েও অস্বাভাবিক বেশি দামে চিনি কিনতে হচ্ছে এ দেশের মানুষদের। এর ওপর সরকার পরিবর্তনের পর পতিত ফ্যাসিস্ট ঘনিষ্ঠ বড় বড় ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়েছেন। এস আলম সুগার মিলের আমদানি নেই বললেই চলে। ফলে বাজারে চিনির সঙ্কটেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বরাবরই চিনির উচ্চমূল্যের জন্য উচ্চ শুল্ককর আরোপকেই দুষছেন। অবশ্য ভোক্তারা সরকারের উচ্চ শুল্ককর আরোপের সাথে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর অসাধুতাকেও দায়ি করছেন।
খাতুনগঞ্জের একাধিক বৃহৎ পাইকারি ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে জানান, গতকাল প্রতি মণ রেডি চিনি (তাৎক্ষণিক ডেলিভারি নিলে) দেশীয় মিলেরগুলো ৪২৬০-৪২৬৫ টাকা এবং পাকিস্তানি চিনি ৪২৬০ টাকা করে বিক্রি হয়। এ ছাড়া যারা ডিও কিনেন তাদের প্রতি মণ ৪১০০ টাকা দরে কিনতে হয়েছে।
খুচরা দোকানি দিদারুল আলম জানিয়েছেন, কষ্টিংসহ প্রতি কেজি চিনি গতকাল ১১৬ টাকায় কিনতে হয়েছে। ফলে তারা প্রতি কেজি ১১৮ টাকায় বিক্রি করছেন। আবার কোনো কোনো দোকানে প্রতি কেজি ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা দোকানগুলোতে ৫০ কেজির বস্তা ৫৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলেও জানা গেছে। মূলত পাকিস্তানি চিনি বাজারে আসার পর প্রতি মণে প্রায় ৩০০ টাকা করে কমেছে।
বাংলাদেশে মূলত দেশবন্ধু, আবদুল মোনায়েম, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপ ছিল অপরিশোধিত চিনির মূল আমদানিকারক। দেশের মোট আমদানিকৃত চিনির ৯০ শতাংশই যেহেতু অপরিশোধিত চিনি, সেজন্য এসব বেসরকারি চিনিকল মালিকরাই চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। সরকার পরিবর্তনের পর এসব বৃহৎ আমদানিকারকরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমদানি কমিয়েছেন। পাশাপাশি সরকারও অতি ব্যবহার্য এই পণ্যটির ওপর উচ্চহারে শুল্কারোপ করে জনগণের পকেট কাটতে থাকে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমাদের দেশে যখন চিনির দাম প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাড়তি থাকে তখন চোরাচালানি হয়ে বিপুল পরিমাণ চিনি সীমান্তের নানা স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সূত্র জানিয়েছে, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো দিয়ে বিপুল পরিমাণ চিনি চোরাই পথে দেশে প্রবেশ করছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব যেমনি হারাচ্ছে, পাশাপাশি লাভবান হচ্ছে চোরাকারবারিরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিশোধিত চিনি আমদানিতে বেসরকারি আমদানিকারকদের সরকারি পৃষ্টপোষকতা দেয়া না হলে আসছে রমজানে চিনির সঙ্কট হবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
আমদানি পর্যায়ে উচ্চ শুল্ককর : বাংলাদেশে মূলত অপরিশোধিত চিনি প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করা হয়। গত ৫ বছরে গড়ে সাড়ে ১৯ লাখ টন চিনি আমদানি হয়। যার ৯০ শতাংশের অধিক অপরিশোধিত চিনি। গুটি কয়েক বেসরকারি চিনিকল মালিক এসব অপরিশোধিত চিনি আমদানি করতেন এবং তারাই চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন। তা ছাড়া ক্ষুদ্র আমদানিকারকরা যাতে পরিশোধিত চিনি আমদানি করে সুবিধা করতে না পারেন সেজন্য এক দিকে কাস্টম ডিউটি দ্বিগুণ করে রাখা হয়, অন্য দিকে দর উঠানামার মাধ্যমে পরিশোধিত চিনি আমদানিকারকদের লোকসানে ফেলে দিতেন। ফলে অনেক আমদানিকারকই মুখ ফিরিয়ে নেন। বর্তমানে এসআলম সুগার মিলের আমদানি বন্ধ। অন্যান্য আমদানিকারকরাও আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন।
গত অক্টোবর পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮০৩ টন চিনি আমদানির তথ্য মিলেছে, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৭ হাজার ২৮৪ মে:টন কম বলে কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে। কাস্টম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোগ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় চিনি থেকে। তাই সরকারি রাজস্ব আহরণে যাতে বড় ধরনের প্রভাব না পড়ে সেজন্য শুল্ক কমানো হয়েছে নামমাত্র।
বর্তমানে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে ৩০০০ টাকা কাস্টম ডিউটি দিতে হয়। এ ছাড়া টনপ্রতি নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি)-১৫%, ভ্যাট-১৫%, অগ্রিম আয়কর (এআইটি)-২% এবং অগ্রিম কর (এটি)-৫% প্রযোজ্য হয়। এ ছাড়া পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে টনপ্রতি ৪৫০০ টাকা কাস্টম ডিউটি, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি)-১৫%, ভ্যাট-১৫% এবং ২% অগ্রিম আয়কর (এআইটি) প্রযোজ্য হয়। বর্তমানে প্রতি টন পরিশোধিত চিনি ৬৬০ মার্কিন ডলারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে এবং প্রতি টন পরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৪০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হচ্ছে। যা প্রতি কেজি হিসেবে একজন আমদানিকারককে ৪০ টাকা ৫০ পয়সা শুল্ককর দিতে হচ্ছে বলেও সূত্র জানায়। এ ছাড়া প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি ৫৪০ মার্কিন ডলারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে এবং প্রতিটন অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রায় ২৭ হাজার টাকা শুল্ককর দিতে হচ্ছে বলে সূত্র জানায়।
প্রতিবেশীসহ কয়েকটি দেশের চিনির বাজার : বিভিন্ন ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, থাইল্যান্ডে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে দশমিক ৬৪ মার্কিন ডলারে যা বাংলাদেশী টাকার অঙ্কে ৭৬ টাকা। ভারতে বাংলাদেশী টাকার অঙ্কে ৬৯ টাকায় (৫০ রুপি) প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে। আর পাকিস্তানে টাকার অঙ্কে ৬১-৭২ টাকায় (১৪৫-১৭০ পাকিস্তানি রুপি) প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি টাকার অঙ্কে ৯৫ টাকা (১১০ নেপালিজ রুপি) দরে বিক্রি হচ্ছে।
একেবারে ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কায়ও প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি বাংলাদেশী টাকার অঙ্কে ১৪৭ টাকা (৩৬৯ শ্রীলঙ্কান রুপি) দরে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা