০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১, ৭ রজব ১৪৪৬
`

তিব্বতে শক্তিশালী ভূমিকম্পে শতাধিক নিহত

চীনের তিব্বতে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত একটি এলাকা : বিবিসি -


চীনের তিব্বতের প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত বিবিসি, আলজাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরে এ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৯৫ বলা হলেও চায়না নিউজ সার্ভিসের মতে, কমপক্ষে ১০৬ জন নিহত এবং ১৭৪ জন আহতের কথা বলা হয়। এ ছাড়া প্রায় তিন হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিনহুয়া জানায়, মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ০৫ মিনিটে জিজাং (তিব্বত) স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের জিগাজে শহরের নেপাল সীমান্তের কাছে ডিংরি কাউন্টিতে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান এবং উত্তর ভারতের কিছু অংশে হিমালয়জুড়ে কম্পন অনুভূত হয়।
ভূমিকম্পে প্রথমে ৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গলেও পরে তা বেড়ে ৩২, এরপর ৫৩ এবং সর্বশেষ শতাধিক ছাড়িয়ে যায়। মার্কিন মিডিয়া সিএনএন বলছে ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) অনুসারে ৭.১-মাত্রার ভূমিকম্পটি স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৫ মিনিটে ১০ কিলোমিটার (৬.২ মাইল) গভীরতায় আঘাত হানে এবং এরপরে একাধিক আফটারশক হয়েছিল। তবে চায়না ভূমিকম্প নেটওয়ার্ক সেন্টারের (সিইএনসি) অনুসারে রিখটার স্কেলে এ ভূমিকম্প ছিল ৬.৮ মাত্রার। ভূমিকম্পে প্রত্যন্ত হিমালয়ের গ্রামগুলোতে বাড়িঘর ভেঙে যায়, কাছাকাছি তিব্বতের পবিত্র শহর কেঁপে ওঠে এবং মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে দর্শকরা বিচলিত হয়ে পড়েন। এর কেন্দ্রস্থল, তিব্বতীয় মালভূমিতে উচ্চ টিংরি কাউন্টিতে অবস্থিত, বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত থেকে প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে নেপালের সীমান্তের কাছাকাছি ছিল।

সিনহুয়া জানায়, এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে চার শ’ কিলোমিটার দূরে ডাংরিতে মাউন্ট এভারেস্টের উত্তর দিকে। কম্পন অনুভূত হয়েছে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পর্যন্ত। কাঠমান্ডুর একটি বেসরকারি সংস্থা নেপাল সেন্টার ফর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের বিশাল নাথ উপ্রেতি বলেন, ভূমিকম্প খুব শক্তিশালী ছিল। লোকজন ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায়। বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তারগুলো ছিঁড়ে যায়।
ভূমিকম্প আঘাত হানার পর স্থানীয় একজন ফোনে এএফপিকে বলেছেন, এখানে ঘরগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতিটি ‘খুব গুরুতর’ এবং অ্যাম্বুলেন্সগুলো সারাদিন আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ডিংরি কাউন্টি ও এর আশপাশের এলাকায় খুব শক্তিশালী কম্পন অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্প কেন্দ্রের কাছাকাছি অনেক ভবন ধসে পড়েছে। চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী সিসিটিভির প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, দেয়াল ভেঙে পড়েছে এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হাঁটছেন। কেউ কেউ স্থানীয়দের গরম রাখার জন্য মোটা কম্বল দিচ্ছেন।

সিসিটিভির কিছু ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনার সময় মানুষ ভয়ে দৌড়াচ্ছে এবং সবকিছু কাঁপছে। তিব্বতের ভূমিকম্প ব্যুরো বিবিসিকে জানায়, তারা ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারছে না। এখনো নিহতের সংখ্যা যাচাই করছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং পূর্ণ মাত্রায় অনুসন্ধান ও উদ্ধার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সঠিকভাবে পুনর্বাসন এবং শীতকালে তাদের নিরাপত্তা ও উষ্ণতা নিশ্চিতে জোর দিয়েছেন। সিনহুয়া জানায়, ‘ভূমিকম্পের প্রভাব মূল্যায়ন করতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কাউন্টির বিভিন্ন শহরের সাথে যোগাযোগ করছে।’ ডিংরিতে তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৭.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এবং গতকাল সন্ধ্যায় তা মাইনাস ১৮-এ নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করেছে চীনের আবহাওয়া বিভাগ।
চীনা বিমানবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে এবং ড্রোন পাঠিয়েছে। অঞ্চলটি এভারেস্টের পাদদেশে অবস্থিত। সেখানে তাপমাত্রা অনেক কম। সেখানে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। উঁচু পাহাড়ি এলাকার জন্য তাঁবু, কম্বল এবং হিমশীতল এলাকার জন্য ত্রাণসহায়তা পাঠানো হচ্ছে।
যদিও এই অঞ্চলে ভূমিকম্প সাধারণ ঘটনা, তবে মঙ্গলবারের ভূমিকম্পটি গত পাঁচ বছরে ২০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল বলে সিউএনসি জানিয়েছে। এ দিকে কাঠমান্ডুর পাশাপাশি এভারেস্টের নিকটবর্তী উচ্চ পর্বতমালায় নেপালের লোবুচের আশপাশের অঞ্চলগুলো কম্পন এবং আফটারশকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

এভারেস্টের কাছাকাছি অবস্থিত নেপালের নামচে অঞ্চলের সরকারি কর্মকর্তা জগৎ প্রসাদ ভুসাল বলেন, এখানেও বেশ প্রবলভাবে কম্পন অনুভূত হয়েছে, সবাই জেগে আছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। নেপালি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখপাত্র ঋষি রাম তিওয়ারি বলেছেন, ‘ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠার পর নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।’
এ দিকে ভূমিকম্পের কেন্দ্রের কাছাকাছি অঞ্চলটি খুব কম জনবসতিপূর্ণ কিন্তু ছোট গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন এবং প্রায়ই হিমালয় উপত্যকায় প্রবেশ করা কঠিন। সিনহুয়া তথ্য অনুসারে, প্রায় ৬,৯০০ লোক ভূমিকম্পের কেন্দ্রের ২০ কিমি. (১২-মাইল) ব্যাসার্ধের মধ্যে ২৭টি গ্রামে বাস করে বলে অনুমান করা হয়েছে। চীনা সোসাল মিডিয়া প্রচারিত ভিডিওগুলোতে ভূমিকেন্দ্র থেকে প্রায় ৮৬ কিলোমিটার (৫৩ মাইল) দূরে লাহটসে কাউন্টির রাস্তায় ক্ষতিগ্রস্ত ছাদ, দোকানের সামনে এবং ধ্বংসাবশেষের স্তুূপ দেখা যায়। রাস্তার পাশে পার্ক করা কিছু গাড়ি ও মোটরসাইকেলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা ফুটেজে দেখা গেছে।
ভূমিকম্পের নিকটতম প্রধান শহর হলো শিগাৎসে, যা প্রায় ১৮০ কিমি. (১১১ মাইল) দূরে অবস্থিত। শহরটি প্রায় ৮০০,০০০ লোকের বাসস্থান এবং তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা পঞ্চেন লামার ঐতিহ্যবাহী আসন (দালাই লামার পরেই যার অবস্থান)। ভারতে স্ব-আরোপিত নির্বাসনে বসবাসরত দালাই লামা বলেছেন ভূমিকম্পে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের জন্য আমি আমার প্রার্থনা জানাই এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বাইনাং কাউন্টির বাসিন্দা পু চি বলেন, আমি মঙ্গলবার সকালে বিছানায় শুয়েছিলাম, হঠাৎ ঘরের ঝাঁকুনি অনুভব করে দেখতে পাই সিলিং লাইট দুলতে শুরু করেছে। আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম, তাই দ্রুত কিছু জামাকাপড় ছুড়ে ফেলে বাইরে দৌড়ে যাই এবং পরিবারের অন্যদের ডাকতে থাকি।

 


আরো সংবাদ



premium cement