সমাজের গভীর বিভক্তি দূর করতে ট্রুথ ও রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন প্রয়োজন
- ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৬
নয়া দিগন্তের সাথে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ স্কলার আজমল মাসরুর সমাজের গভীর বিভক্তি দূর করতে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেয়েশন কমিশন গঠন প্রয়োজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ মুসলিম স্কলার ও কমিউনিটি নেতা আজমল মাসরুর বাংলাদেশী সমাজের গভীর বিভক্তি দূর করে সংহতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে একটি ট্রুথ ও রিকনসিলেয়েশন কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সময় প্রয়োজন। এ সময় জনগণের কাছ থেকে নিতে অন্তর্বর্তী সরকার গণভোটে গেলে ভালো হতো। সেটি হলে সংস্কার নির্বাচন নিয়ে চলমান বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হতো।
বাংলাদেশে সফরে এলে দৈনিক নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জনাব মাসরুর এ কথা বলেন। উত্তরায় তার বাসায় এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী ও মাল্টিমিডিয়া এডিটর যুবরাজ ফয়সল। জনাব আজমল মসরুর পৈতৃকভাবে ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ইমাম, ইসলাম প্রচারক ও রাজনীতিবিদ। মূল ধারার বিভিন্ন গণমাধ্যম ও মুসলিম চ্যানেলে তিনি রাজনৈতিক আলোচনা ও কমিউনিটি-বিষয়ক উপস্থাপক হিসেবে সুপরিচিত। মাসরুর ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইসলামিক সোসাইটি অব ব্রিটেনের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের প্রতিনিধিত্ব করে ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বেথনাল গ্রিন ও বোতে দাঁড়িয়ে ২০.১ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। ২০২৪ সালে তিনি নতুন বেথনাল গ্রিন ও স্টেপনি নির্বাচনী এলাকায় স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে ৩০.৫ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় হন। জয়ী প্রার্থীর সাথে ব্যবধান ছিল দেড় হাজার ভোটের মতো।
প্রশ্ন : নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য। আমরা জানি আপনি দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর পর বাংলাদেশে এসেছেন। এবার যে বাংলাদেশটাকে আপনি দেখছেন তার সাথে আগের এক্সপেরিয়েন্সের পার্থক্যটা কী বলবেন?
আজমল মাসরুর : আমি বাংলাদেশে এসেছি ১৫ বছর পর। আসবো বলে আশা ছিল বেশ ক’বার কিন্তু আসতে পারিনি। আপনাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক দুশ্চিন্তা ছিল। আসার সময় কী যে হয় তা নিয়ে উদ্বেগ ছিল। গত সরকারের কাছ থেকে দেশে না আসার জন্য ডাইরেক্টলি আমাকে ওয়ার্নিং দেয়া হয়েছে। আমার ফ্যামিলি আমার ওয়াইফ আমার বাচ্চারা সবাই বলছে আপনি কেন যাবেন, আপনাকে যদি অ্যারেস্ট করে ফেলে আমরা কী করব। আমি বলি একবার গিয়ে দেখে আসি কী হয়। গতবার যখন এসেছিলাম তখন অনেক প্রবলেম দেখছিলাম সমাজের মধ্যে। নানামুখী পলিটিক্যাল ক্রাইসিস, আমি রাস্তাঘাটে ভাঙচুর দেখেছি আর গাড়ি জ্বালানো হচ্ছে দেখেছি। তখন দেখেছি নানা ধরনের অস্থিরতা। ১৭ বছর আগে এখানে ফ্রিডম ছিল, মুখ খুলে কথা বলতে পারত মানুষ। বাকস্বাধীনতা ছিল এ দেশে। আমি যদি কোনো পলিটিক্যাল পার্টির সাথে যুক্ত থাকি সেটি তখন সমস্যা ছিল না। কোনো রিলিজিয়াস গ্রুপের সাথে যদি আমি কথা বলি সেটি সমস্যা ছিল না। কিন্তু গত ১৫ বছরের মধ্যে সেটি আর থাকেনি। আমরা যেটাকে ব্রিটেনে বলি সবাইকে ক্যান্সেল করে শুধু আমার কথাই রাইটÑ এই কালচারটা ডমিনেন্ট হয়ে গিয়েছিল।
এবার ঢাকায় এসে আমার একটা জিনিস আশ্চর্য লাগল, আমি দেখতে পেলাম যে লোকদের শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলার মধ্যেও একটা শান্তি। দেখতে পাচ্ছি আগে একধরনের উৎকণ্ঠা দেখা যেত। কে কোনভাবে কাকে ফাসায়ে দেয়, বিমানবন্দরে আসার পর কে ঘুষ চাবে, কে ব্যাগ নিয়ে নেবে, কে প্রশ্ন করবে উল্টো হলে আটকে দেবে। এবার কিন্তু এ ধরনের কোনো ফিলিং হয়নি। আমি এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে, গ্রামে গিয়ে, শহরে গিয়ে দেখলাম লোকজন মুখ খুলে কথা বলতে পারছে। এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখি একটা মিছিল হচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আমার সাথের একজনকে, জবাব দিলেন আমাদের এই দেশে লোকদের ফ্রিডম আবার চলে এসেছে এবং তাদের ভয়ভীতি চলে গেছে। দিস ইজ দ্যা মোস্ট ইম্পর্টেন্ট ডেভেলপমেন্ট, হিস্টরিক ডেভেলপমেন্ট এ সময়ের।
প্রশ্ন : হ্যাঁ আপনি বলছিলেন যে বাংলাদেশে একটা মুক্ত আবহ তৈরি হয়েছে, যেটা আপনি ফিল করলেন ১৫ বছর পর আসার পরে। বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্টগুলো তো আপনি লন্ডনে থেকে অবজার্ভ করেছেন, যদিও ফিজিক্যালি আপনি এখানে থাকতে পারেননি। ৫ আগস্টের পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কার করার জন্য অনেকগুলো উদ্যোগ নিয়েছে। এখন আপনার কি মনে হয় এই রাষ্ট্রকে যদি সংস্কার করতে হয় বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতে যে দুরবস্থা তৈরি হয়েছিল ব্যাংকের ফান্ড বের করে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সব জায়গায় যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল সেখান থেকে উঠে আসার জন্য সরকার কী করতে পারে?
আজমল মসরুর : আপনার প্রশ্নের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুঃখের ব্যাপার যে রয়েছে সেটি হলো বাংলাদেশে এখন ব্যাংক ক্রাফট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইকোনমিক্যালি আমরা দেউলিয়া, পলিটিক্যালিও আমরা দেউলিয়া হওয়ার অবস্থার মুখোমখি। আমাদেরকে এমন একটা সময়ের মধ্যে রেখে যাওয়া হয়েছে যে একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করতে পারে না। গত ১৫ বছর যেটা দেখা গেছে তা কিন্তু কমিউনিস্ট কান্ট্রিতে। রাজতান্ত্রিক কোনো আরব কান্ট্রিতে আমরা দেখেছি। এটা ইজিপ্টে বা নর্থ কোরিয়ার কালচারে ছিল। ্আমাদের দেশে গত ১৫ বছর এমন এক অবস্থা ছিল যে কত শত কোটি টাকা এ দেশ থেকে চুরি করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এখন এটা থেকে কেমনে উদ্ধার পাওয়া যায় সেটি একটি বড় ইস্যু।
এ অবস্থাটা থেকে আমাদের এই দেশটা কেমন করে গড়ে তোলা যায় সেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রথমে আমি সবাইকে বলব যে আপনারা সময় দিন প্লিজ। রোম ওয়াজ নট বিল্ড ওভারনাইট। কোন শহর কোন দেশে এক দিনে হয় ন্ াইংল্যান্ডের ডেমোক্র্যাসি ৩০০ বছর পরে শক্ত হয়েছে। আমেরিকার ডেমোক্র্যাসি ৫০০ বছর স্ট্রাগল করে স্ট্রং হয়েছে আর ফ্রান্সের ডেমোক্র্যাসি ১০০০ বছর পরে এখনো স্ট্রাগলিং করছে। আমাদের দেশের লোকদের একটু ধৈর্যের দরকার। আমাদের সোসাইটিতে যে বিভক্তি তার হিলিং দরকার। এত এনিমেটি, এত জেলাসিÑ এগুলো সরাতে হলে হিলিং দরকার। হিলিংয়ের জন্য আমি আগেও বলছি এখনো বলব প্রফেসর ইউনূসের সাথে আমার যদি কখনো মিটিং হয়, আমি উনাকে একটাই প্রস্তাব দেবোÑ প্রফেসর সাহেব আপনাদের দেশে সাউথ আফ্রিকার মতো ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন কমিশন দরকার। গত ১৫ বছরে যা হয়েছে, ১৯৭১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যা হয়েছে এগুলোর রিকনসিলেয়েশন দরকার। ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন কমিশন এমন একটা প্ল্যাটফর্ম ও সেফ স্পেস হবে যেখানে সবাই মনের কথা খুলে বলতে পারবে। যারা যারা তাদেরকে এত কষ্ট দিয়েছে তারা এ কথাগুলো শুনতে পারবে আর যারা কষ্ট দিয়েছে তারা তাদেরকেও দেয়া অ্যাপোলজির অপরচুনিটি নিতে পারবে। ফার্স্ট স্টেপ হয়ো দরকার হিলিং, আমরা আরবি ভাষায় ওটাকে বলি ইসলাহ। এ জন্য একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন কমিশন দরকার। কোনো ডেমোক্র্যাটিক্যালি ইলেকটেড গভর্মেন্ট সংস্কার করবে না। আমি প্রধান উপদেষ্টাকে বলব যে প্লিজ এখনই আপনি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন কমিশন করেন। আর দরকার লাগলে আমরা সাহায্য করবো।
আরেকটি সমস্যা হলো ভারতের সাথে আমাদের সমস্যা। ইন্ডিয়ার সাথে আমাদের অনেক দিন নেইবার রিলেশনশিপ ছিল এবং আমরা আশা করব এটা থাকবে। তবে গত ১৫ বছর ইন্ডিয়া কিন্তু আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। এটার জন্য আমাদের তাদের সাথে এত কুইকলি ফ্রেন্ডলি হওয়া উচিত নয়। আমি বলব আমাদের উচিত অন্য দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি করা। আমাদের পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ভালো করা দরকার, মালয়েশিয়ার সাথে, ইন্দোনেশিয়ার সাথে, শ্রীলঙ্কার সাথে সম্পর্ক ভালো করা দরকার। আমাদের সব নেইবারিং কান্ট্রিসের সাথে একটা স্ট্রং অ্যালায়েন্সের দরকার পলিটিক্যাল লেভারেজের জন্য। তাদের সাহায্য সহযোগিতা তাদের ইকোনমিক সাপোর্টের মাধ্যমে আমরা এটা শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারব। ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের সাথে আমাদের সম্পর্ক কমাতে হবে, বিকজ তারা আমাদেরকে এক হাত দিয়ে লোন দেবে আর আরেক হাত দিয়ে আমাদের সম্পত্তি নিয়ে যাবে। অনেক সময় দেখা যায় আইএমএফের উদ্দেশ্যটা যেন হচ্ছে আরেকটা দেশকে লাইফ লং স্লেভ বানানো। বাংলাদেশের মধ্যে এই ক্যাপাসিটি আছে যে স্বাধীনভাবে নিজ দেশকে গড়ার। আমি আশা করব এই কিছু কাজ যদি আমরা এক্ষুনি করা শুরু করি ওভার দ্যা নেক্সট ফাইভ টের ফিফটিন বা টুয়েন্টি ইয়ারে বাংলাদেশটা আরো শক্ত হবে এবং বাংলাদেশের লোকদের এর রেজিলিয়েন্সটা আরো বাড়বে ইনশা আল্লাহ।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন বাংলাদেশের সামাজিকভাবে যে বিভাজন, রাজনৈতিকভাবে যে বিভক্তি এবং হিংসা থেকে উত্তরণের জন্য ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন কমিশন করা দরকার এ সরকার সংস্কারের জন্য প্রায় ১১টার মতো কমিশন করছে কিন্তু ওই ট্রুথ কমিশন যেটা আপনি বলছেন এই নিয়ে দাবি উঠলেও এটি করা হয়নি। আবার আপনি বললেন যে এই সরকারকে সময় দেয়া দরকার। সময়ের বিষয়ে কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি যারা আছে তারা কিন্তু ধৈর্য ধরতে নারাজ। আপনি প্রফেসর ইউনূসের জায়গায় আপনি যদি প্রধান উপদেষ্টা হতেন তাহলে আপনি এটাকে কিভাবে ফেস করতেন?
আজমল মসরুর : আমি বিএনপি কে বলব আপনাদের এত তাড়াহুড়া কেন? লোকদের বিশ্বাস আপনারা অর্জন করতে পারেননি। আওয়ামী লীগ সরকার তো বিশ্বাস বা ঘাতকতা করে দেশ থেকে পালিয়ে গেল আপনাদের এত তাড়াহুড়া কেন। একটা দেশ সংস্কার করতে হলে সময় লাগবে। আমি যদি প্রফেসর ইউনূস হতাম তাহলে আমার প্রথম কাজ হতো পাবলিক ম্যান্ডেটের জন্য আমি একটা রেফারেন্ডাম করতাম। জনগণকে জিজ্ঞাসা করতাম আমি কত বছরের মেয়াদ নিয়ে কাজটা চালাবো। এক বছর তিন বছর না পাঁচ বছর। জনগণ যদি বলে এক বছর, এক বছর পরে আমি নেমে যাব। জনগণ যদি বলে তিন বছর আমি জনগণের তিন বছরের মানে নিয়ে যাবো। আমি প্রফেসর ইউনূস হলে এক্ষুনি রেফারেন্ডটা দিতাম। এরপরে সেকেন্ড পদক্ষেপ আমি নিতাম এই ম্যান্ডেট নেয়ার পরে একটা ইউনিটি গভর্মেন্ট ক্রিয়েট করতাম নট বেসড অন এনি পলিটিক্যাল এফিলিয়েশন বাট যোগ্যতাসহ বিভিন্ন সেক্টরের লোকদেরকে জড়িত করে একটা ইউনিটি ইন্টেরিয়াম গভর্মেন্ট ক্রিয়েট করতাম। ওটা দেশকে চালাত অন দ্যা বেসিস অব দ্যা আউটকাম অব রেফারেন্ডাম। আর তার পদক্ষেপ হতো জনগণের কাছ থেকে অব্যাহতভাবে শোনা তারা কী চাচ্ছে। অফকোর্স, তাদের মাধ্যমে দেশ চলবে না এটা বুঝতে পারছি। জনগণের ভয়েস হচ্ছে একটা মার্কেটপ্লেসের মতো। এটাকে ফিল্টার করতে হবে কিন্তু জনগণের কথা শুনতেই হবে জনগণ হচ্ছে দ্যা রিয়েল পাওয়ার।
(সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় অংশ আগামীকাল)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা