০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১, ৭ রজব ১৪৪৬
`

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিএনপি স্থানীয় নির্বাচন চায় না

গণ-অভ্যুত্থান শুধু ৩৬ দিনের আন্দোলনের ফল নয়
-

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপি। দলটির অভিমত, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো নজির নেই। জাতীয় নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে কোনো কোনো পক্ষ এ ক্ষেত্রে সরকারের উপর চাপ তৈরি করতে পারে। তবে তাদের উচিত রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে কেবল জাতীয় নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি স্থির রাখা। একই সঙ্গে জুলাই-গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলেছেন, ঘোষণাপত্রে গণতন্ত্রের জন্য বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর বিগত ১৬ বছরের লড়াই-সংগ্রাম ও ত্যাগের উল্লেখ নেই। কোনো কোনো পক্ষ এই দীর্ঘ সংগ্রামকে ভুলিয়ে দিতে চায়। তাই এ বিষয়ে দলটি সোচ্চার হবে।

গত সোমবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতারা এমন অভিমত দেন। রাত পৌনে ৯টা থেকে পৌনে ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠক হয়। লন্ডন থেকে বৈঠকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
গত ৬ জানুয়ারি রাজধানীতে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও এ মতামত আছে। ঢাকার বাইরে মতবিনিময় করতে গিয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এ চিত্র পাচ্ছে। এর আগে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একাধিক মতবিনিময়েও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার বিষয়ে পরামর্শ উঠে এসেছিল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। এ বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। দলটির নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান না বলে অভিমত দেন। তারা বলেন, এই ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। সরকারের উচিত, জন-আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি দেয়া। সরকারকে কোনো চাপ কিংবা কোনো পক্ষ বা কারোর স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে জনস্বার্থে দেশকে নির্বাচনমুখী করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

সূত্রমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ‘জুলাই-গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। বিএনপির নেতারা মনে করেন, এই ঘোষণাপত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের স্বীকৃতি থাকতে হবে। কেননা, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতে গিয়ে এই সময়ে তাদের অসংখ্য নেতাকর্মী গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। নেতাদের দাবি, হঠাৎ করে নয়Ñ বিএনপির গত ১৬ বছরের আন্দোলনের পটভূমিতে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। সুতরাং এই গণ-অভ্যুত্থান কেবল ৩৬ দিনের আন্দোলনের ফল নয়। কিন্তু বিএনপির সেই দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। এ লক্ষ্যে শিগগিরই সভা-সেমিনারের মধ্য দিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, তাদের ত্যাগের বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া আগামীতে সরকারের সাথে আলোচনায়ও এ বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরবে বিএনপি।
গত ৩১ ডিসেম্বর ছাত্রদের ‘জুলাই-গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেয়ার উদ্যোগ এবং শেষ মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক ঐকমত্যে এই ঘোষণাপত্র তৈরির ঘোষণায় তা স্থগিত করা হয়। ডিক্লারেশন প্রশ্নে ছাত্র এবং সরকারের এই অবস্থান বিএনপির কাছে স্পষ্ট নয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এই ইস্যুতে সরকার যখন আলোচনার উদ্যোগ নিবে, তখন বিষয়টি তুলে ধরবে বিএনপি।

দেশে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর হতে পারে বলে গত ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অভিমত দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টিতে আলোচনায় বিএনপি নেতারা অভিমত দেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর। এটা নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। তবে এমনটা করলে তাতে জটিলতা বাড়বে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কালক্ষেপণ হবে। সুতরাং ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছরই থাকা উচিত। প্রধান উপদেষ্টার ওই বক্তব্যের পরদিন রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ভোটারের বয়স ১৮ বছর তো আছে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। যদি কমাতে চান, সেটা নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব করুক। এভাবে না বলে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়টা আনা উচিত ছিল, এটা ভালো হতো। তাহলে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। মানুষের মনে এখন বেশি করে আশঙ্কা তৈরি হবে, এটা করতে গিয়ে আরও সময় যাবে, কালক্ষেপণ হবে। মানুষের মনে ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে, কেন যেন এই সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে।

জানা গেছে, ছাত্রদের জুলাই ঘোষণাপত্রের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাহাত্তরের সংবিধানকে বাতিল করা। এ ক্ষেত্রে বিএনপির আপত্তি রয়েছে, যেটি দলটির নেতারা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন। স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা হয়েছে। নেতারা মনে করেন, সংবিধানের বাইরে গেলে দেশে অস্থিরতা তৈরি হবে। তা ছাড়া ছাত্ররা যে সংবিধান বাতিল করে দেয়ার কথা বলছে, সেই বাহাত্তরের সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনসহ রাষ্ট্রের সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ এই সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রের কাঠামোগত একটা অবস্থান আছে। সুতরাং যারা এটা বাতিলের কথা বলছে, তাদের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপির অভিমত, সংবিধান কখনো কবর দেয়া যায় না। পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংশোধন হতে পারে। সেটাই হবে সর্বোত্তম পন্থা।

এ দিকে সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার ব্যাপারে একটা ধারণা দিলেও এখনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেয়নি। এর পেছনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপ থাকতে পারে বলেও বৈঠকে কেউ কেউ অভিমত দেন। তারা বলেন, ছাত্ররা সরকারি সহযোগিতায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে। সেই দলকে সংগঠিত করা এবং সারা দেশে এর কার্যক্রম বিস্তৃত করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। সে জন্য তারা দ্রুত নির্বাচন চায় না। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে এবং জনগণের পালস (মনের ভাব) বুঝে সরকারকে রোডম্যাপ দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে সামনের দিকে এগোনো দরকার। কারণ, দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। তা ছাড়া নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, সঙ্কটও তত বাড়বে।

বৈঠকে খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে আলোচনায় বিএনপি নেতারা বলেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার সব সুযোগ বন্ধ করে রেখেছিল। গুরুতর অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিদেশে যেতে দেয়া হয়নি। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি এখন যে বিদেশে যাচ্ছেন, এটা তাদের জন্য অনেক স্বস্তির বিষয়। বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসনের সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়া হয়। একই সাথে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়, চিকিৎসা শেষে তিনি দ্রুত দেশে ফিরে আসবেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement