০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১, ৬ রজব ১৪৪৬
`
ব্রিটিশ এমপিকে প্রধান উপদেষ্টা

নির্বাচনের তারিখ নির্ভর করছে সংস্কার কতটা তার ওপর

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্যের এমপি রূপা হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সাথে সাক্ষাৎ শেষে ফটোসেশনে অংশ নেন : পিআইডি -


অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য দু’টি সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের মধ্যভাগ। তবে, নির্বাচনের তারিখ নির্ভর করছে জনগণ কতটা সংস্কার চায় তার ওপর।
আগামী নির্বাচন সম্পূর্ণ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। সেখানে ছিল ভুয়া সংসদ, ভুয়া এমপি ও ভুয়া স্পিকার। দেশের জনগণ এখন তাদের কণ্ঠ ফিরে পেয়েছে। তাদের কণ্ঠ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল।’
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি ড. রুপা হক গতকাল শনিবার রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সাক্ষাতে এলে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় রুপা হক আগামী নির্বাচনের আনুমানিক সময়সূচি, অন্তর্র্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কার উদ্যোগ ও রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চান। উত্তরে এসব কথা বলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এ সময় অন্তর্র্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কার উদ্যোগ ও রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে রুপা হক বলেন, জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশ দেখে আমি উৎসাহিত। তিনি আগামী সাধারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন অধ্যাপক ইউনূস তাকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে জনগণের ওপর চালানো দমন-পীড়নের কথা তুলে ধরেন।
ব্রিটিশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার এবং উন্নয়ন পরিচালক জেমস গোল্ডম্যান এ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে রুপা হক যুক্তরাজ্যের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বিডার চেয়ারম্যান আশিক মাহমুদ চৌধুরী এবং এসডিজিবিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদের সাথে বৈঠক করেন।
যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ইউকে বিসিসিআই) একটি প্রতিনিধি দল তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে রয়েছেন। এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউকে বিসিসিআই চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ ওবিই এবং ইউকে বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট এম জি মৌলা মিয়া।
লুৎফে সিদ্দিকী যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ী, বিশেষ করে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ব্যাপক সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে।’
নাগরিক শক্তির সাথে জাতীয় নাগরিক কমিটির চিন্তা-ভাবনার সম্পর্ক নেই : সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস
অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৯ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক নিউ এজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সংস্কার নিয়ে বৃহত্তর ঐকমত্যে পৌঁছাতে তার সরকার চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি রাজনৈতিক দল ও সমাজের অন্যান্য অংশের সাথে বিষয়ভিত্তিক বৃহত্তর সংলাপ শুরু করবে। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবনে সাক্ষাৎকারটি নেন পত্রিকাটির সম্পাদক নুরুল কবির ও সহকারী সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি গতকাল প্রকাশিত হয়।
সাক্ষাৎকারটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন: আপনার ৪ মাস হলো প্রায়। এই ৪ মাস ও তার আগের ৪ মাসের সময়ের মধ্যে যদি নিজে কখনো চিন্তা করেন, তাহলে কোন পর্বটা আপনার ভালো বা খারাপ লাগে?
ড. ইউনূস: খারাপ কোনোটাই না। খারাপটা বলবো না। তবে এটা ভিন্ন, আগে ছিল আমার নিজস্ব জগত, সারা জীবন ধরে যা যা করে আসছি তার মধ্যেই ছিলাম। নিজস্ব আয়োজন, নিজস্ব চিন্তা। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সেটা আমার মতো করে আমি ট্যাকেল করেছি। আমার উত্তরগুলো দিয়েছি। আমি আমার মতো করে চলেছি। সেটা একেবারেই আমার নিজস্ব জগত। এটা একটা ভিন্ন জগৎ। এটা আমার নিজস্ব জগত না। এই জগতে আমি কোনো দিন ছিলাম না। থাকার কোনো আগ্রহও ছিল না। এটার ডান-বাম আমার জানা নেই। অনেকটা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলার মতো অবস্থা। কাজেই ভিন্ন জগত। কিন্তু এটা একটা চ্যালেঞ্জ আছে। আমাকে আহ্বান জানিয়েছে, তবে প্রথমে একটু সঙ্কোচ করছিলাম যে যাওয়া ঠিক হবে না। যেহেতু আমি এই জগতের মানুষ নই। তারা আমাকে পার্সুয়েট করেছে যে, এই পরিস্থিতিতে আপনার আসা দরকার। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছি।

প্রশ্ন: আগস্টের ৮ তারিখ এই জগতটা যদি আপনার জন্য শুরু না হতো, তার পেছনের যে ৪ মাস। মনে হয় ততদিনে আপনার জেলে থাকার কথা ছিল?
ড. ইউনূস: হয়তো, তখন আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কোন কোন দেশে যাব। বাংলাদেশে যাতে ফিরে যেতে না হয়। একটি উপলক্ষে আমি আরেক দেশে ছিলাম। সেখানে বসে প্রস্তুতি নিচ্ছি ফিরে যাওয়া ঠিক হবে কি না। যাওয়ার সময় উত্তেজনা দেখে গেলাম। কারফিউ দেখে গেলাম। এর ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। কাজেই উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। কারফিউ ভেঙেই গেলাম, না হলে যেতে পারতাম না। ভাগ্যিস পথে কেউ ধরেনি। তবে অত কড়াকড়ি কারফিউ ছিল না। এমন অবস্থা দেখে গেছি, ক্রমাগতভাবে এটা দেখছি। পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখছি। কাজেই ক্রমাগতভাবে ফিডিংটা পাচ্ছিলাম। তার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটল। এটা অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা। তখনো বুঝিনি এর মধ্যে আমাকে জড়িত হতে হবে। এর মধ্যে একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। কাজেই চার মাস এভাবেই গেছে আমার।

প্রশ্ন: ৮ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণের পরে আপনার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে যে আইনগত অভিযোগ ছিল, সেগুলো কোর্ট থেকে একের পর এক উঠে যায়। মানুষের এমনকি ভাবনার সুযোগ আছে যে, আপনার পজিশনের ভারে কিংবা প্রভাবে সেখানে এই রকম ঘটনা ঘটেছে।
ড. ইউনূস: আমি বলব এটা সরকারে থাকি বা দেশে না থাকি, এগুলো এমনি চলে যেত। কাজেই কোনো ভিত্তি নেই। যারা আদালতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। তারাই এটা বোঝাতে পারতেন যে, এটার কোনো ভিত্তি নেই। এটার প্রশ্ন নেই, তথ্য নেই। কাজেই এটা খুবই ঠুনকো জিনিস। এটা জানা-অজানার কোনো বিষয় না। যেহেতু এটা বিচারের বিষয় বিচারেই চলে যেতো। কাজেই আমি থাকলেও যেতো, না থাকলেও যেত। ঘটনাচক্রে আমি ছিলাম।
প্রশ্ন: বিচারব্যবস্থার ওপর তৎকালীন সরকারের যে প্রভাবের কথা মানুষ বলছিল। বা বলাবলি আছে এখনো। আপনি কি মনে করেন ওনারা ক্ষমতায় থাকলেও কোর্ট ওভাবে ব্যবহার করত?
ড.ইউনূস: আগে যারা ছিল তারা তো করেনি। আর করেনি বলেই তো আদালতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। এখন যারা এসেছে তারা বিচার চাচ্ছে, বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে।

প্রশ্ন: তখন যেভাবে চলছিল, তাহলে তো জেলে যাওয়ার কথা ছিল
ড. ইউনূস: তখন তো জেলে যাওয়ার পথেই ছিলাম। প্রতিবারেই মনে হচ্ছে এবারই মনে হয় জেলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে প্রস্তুতি নিয়ে গেছি এবার ফেরা নাও হতে পারে। আমার সহযোগী যারা আছেন, তারা তাদের আত্মীয়-স্বজনকে বলে গেছেন। আমি বলেছি- আমার কিছু করার নেই। যা নিয়তি আছে হবে, আমি আমার পরিবারকেও প্রস্তুত করিনি। রেখে দিলে রেখে দেবে, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আমি সহজভাবে নিচ্ছিলাম। এটা নিয়তির খেলা। সুতরাং প্রস্তুতি নিয়ে আমার কোনো কাজ নেই।
প্রশ্ন: আপনি মাত্র বললেন, এটা একটা ভিন্ন জগৎ। রাষ্ট্র পরিচালনায় এই রকম একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব, যেটা আপনি চিন্তা করেননি। ২০০৭ সালে যখন আপনি একটা দল করতে গিয়েছিলেন। এটা তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিন্তা করেছিলেন। সেটা যদি আপনি চালিয়ে যেতেন, তাহলে তো আপনাকে রাজনৈতিক দায়িত্বই পালন করতে হতো?

ড. ইউনূস: সেটার কারণ ছিল, রাজনৈতিক দলতো ছিল না আমার। আমার বন্ধু-বান্ধব বলতো আপনি একটা দল করেন। এভাবে পেছনে লেগে রইলো। আপনি ছাড়া পারবে না কেউ। আশপাশের লোকজন যা যা বলে আরকি। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েই শেষে বললাম আমি করব দল। সাংবাদিকরা ধরলো, তখন আমি বললাম হ্যাঁ আমি দল গঠন করবো। তখন বিভিন্ন জায়গায় আমি আসা-যাওয়া করছিলাম। উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিলাম, চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। প্রত্যেকবার এয়ারপোর্টেই এ কথাগুলো হচ্ছিল। আর কোথাও না। এক সময় ধরলো- তাহলে কী নাম দেবেন? আমি বললাম নাম ঠিক করিনি। করলে আপনাদের জানাবো। তখন একটা নাম দিলাম। সেটা হলো নাগরিক শক্তি। তারপর বুঝলাম বিষয়টা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তখন সবাইকে বললাম, মতামত নাও। কোনোভাবে এটা থেকে দূরে সরে যাওয়া যায় কি না চেষ্টা করছিলাম। নামও হলো মতামতও হলো। তারপর দেখলাম এর মধ্যে বেশি ঢুকে যাচ্ছি। তখন আমি বললাম না আমি কোনো রাজনৈতিক দল করছি না। তখন রাজনীতির মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এসব আমার মাথায় ছিল না। পরিকল্পনা ছিল না, এটা দীর্ঘমেয়াদি জিনিস।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক দল তো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত?

ড. ইউনূস: আমি তখন রাজনৈতিক দল করতে চাচ্ছিলাম না। ঠেকা দেয়ার জন্য এগুলো বলে যাচ্ছিলাম। সবাই ধাক্কা দিচ্ছে আপনাকে করতে হবে। শেষে মনে করলাম এটা বেশ গভীরে চলে যাচ্ছে। তখন পরিষ্কার বলে দিলাম। সবাই হতবাক হয়ে গেল। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলাম।
প্রশ্ন: আপনি কি বন্ধুদের সাথে আলাপ করেছিলেন?
ড. ইউনূস : বন্ধুদের সাথে আলাপ করিনি। এজন্য তারা আরো হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারা বলল আমাদেরকে বললেন না। আমরা এতদিন ঘুরলাম।
প্রশ্ন: তাদের (বন্ধু) মনঃক্ষুণœ হওয়ার কথা। তারা কি এখন আনন্দে আছে?
ড. ইউনূস: তারা কাছে আসে না। কোন দিকে নিয়ে যায় আবার!
প্রশ্ন: ওই নাগরিক শক্তির সাথে ছাত্রদের জাতীয় নাগরিক কমিটির চিন্তার বা ভাবনার কোনো সম্পর্ক আছে?
ড. ইউনূস: নাগরিক শব্দটা কমন আছে। তা ছাড়া আমার সাথে তাদের কোনো আলোচনা হয়নি। তারা শব্দটা কোথায় পেল।
প্রশ্ন: নাগরিক শব্দটা যেকোনো মানুষ ব্যবহার করতে পারে।
ড. ইউনূস: নাগরিক শব্দটা যেকোনো মানুষ ব্যবহার করতে পারে। আমার সাথে কোনো পরামর্শ হয়নি।

প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন এবং আমরাও লক্ষ করছি যে, সরকারের যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কর্মসূচি ও নির্বাচন। এই দুটোকে পরিপূরক না ভেবে একটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এটা কি আপনাকে চিন্তিত করে?
ড. ইউনূস: না, এখনো সাংঘর্ষিক পর্যায়ে যায়নি। একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম। প্রক্রিয়া হলো, কতগুলো কমিশন গঠন করেছি। একেকটা বিষয়ের ওপর কমিশন গঠন করেছি। এই রকম ১৫টি কমিশন করেছি। তার মধ্যে ৬টি কমিশন প্রথম ঘোষণা করেছিলাম। ৯০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা ছিল। তারা ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করতে পারেনি। তারা বলেছে, এক সপ্তাহ দেরি হতে পারে। কারণ আয়োজন করতেও সময় লেগেছে। ঘোষণা করেছি, প্রথমে তাদের বসার জায়গা দিতে পারিনি। কাজেই ঠিক ৯০ দিন সময় তারা পায়নি। ৬টা কমিশন যদি ৭ জানুয়ারির মধ্যে রিপোর্ট দিয়ে দেয়, তাহলে আমরা পাব। ওখানে সংস্কার বিষয়ক সব বিষয় দেয়া থাকবে। তাহলে সংস্কারের রূপরেখাটা আমরা পেলাম। ইতোমধ্যে মতবিনিময় হয়েছে। তার মধ্যে কোনোটা টিকেছে আবার কোনোটা টেকেনি। তারপর কমিশন মনে করেছে এটাই আমাদের সারমর্ম। তখন বৃহত্তর সংলাপের জন্য এগুলো নিয়ে আসবে। সেদিন একটা সংলাপ হয়েও গেল। যদিও এখনো রিপোর্ট আসেনি। সবাইকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলো কোনটা পছন্দ, কোনটা অপছন্দ। সেদিন একটা কমিশন ঘোষণা করলাম। এই কমিশনের চেয়ারম্যানদের দিয়ে একটা কমিশন, যেটার বাইরে থেকে আমি নিজে চেয়ারম্যান হলাম। সেখানে প্রফেসর আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি করলাম।
প্রশ্ন: আমরা লক্ষ করছি পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যারা নতুন রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন, অর্থাৎ তরুণরা যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে তারা নির্বাচনের জন্য সময় নিতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়া এগিয়ে আনা দরকার। তবে পাবলিক ডিবেটের মধ্যে এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয়েছে। আপনার নজরে এসেছে?
ড. ইউনূস: খুব ভালো করে নজরে এসেছে।

প্রশ্ন: সেটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয়?
ড. ইউনূস: মোটেও না। কারণ ওই যে বললাম, বাইরে একরকম, ভেতরে আরেক রকম। সেই কারণে তারা শেষ পর্যন্ত একমত হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: তরুণরা দল করবে। তারা কনস্টিটিউনসি বিল্ডআপ করবে। এই কারণে তাদের সময় দরকার। তারা নিশ্চয়ই সংস্কার চান। ক্ষমতার রাজনীতিতে এই মুহূর্তে তারা প্রায়োরিটি দিচ্ছেন নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে নির্বাচন করার। এই কারণে অন্যরা মনে করে শুধু অন্য একটি গ্রুপকে সময় দিতে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। আপনি সেটার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখছেন না?
ড. ইউনূস: সেজন্যই ঘোষণা দিলাম। কতগুলো তারিখ দিয়ে দিলাম। যাতে সন্দেহ না থাকে। যত কিছুই টানতে চান না কেন, আমি তো ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি। হয় এখানে হবে, না হয় ওখানে হবে। দুটো তারিখ দিয়ে দিয়েছি।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক দলগুলো তারপরও বলছে, আরো সুনির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষণা করতে।
ড. ইউনূস: এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে, তারা বাড়াতে চাচ্ছেন না। কোন তারিখে হবে। ওই প্রসেসটা অগ্রসর হলেই আমরা দেখবো। আমরা তো বাঁধ দিয়ে দিলাম। এর বাইরে আমরা যাচ্ছি না। এটা হলে এই পর্যন্ত, ওটা হলে ওই পর্যন্ত। তবুও কথাটা বারবার বলছেন।
প্রশ্ন: মানে আপনাদের চাপের মধ্যে রাখতে চাচ্ছে।

ড. ইউনূস: আমরাও চাই চাপের মধ্যে থাকি। আমাদের ভেতরেও তো নানা মত থাকতে পারে। সেজন্যই বাঁধ দেয়া হলো যে, এই পর্যন্তই। এর ভেতর থেকেই আমাদের যা কিছু করতে হবে। যাতে কেউ বলতে না যে, সংস্কার করতে ৫ বছর সময় লাগবে। যা কিছু হবে এর মধ্যেই করতে হবে। সংস্কারের জন্য যে সব পদক্ষেপ নেয়া দরকার, দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে, আরো ছয় মাস বাড়াতে, বললাম-না এর ভেতরেই করতে হবে। এই যে একটা বাঁধ দেয়া, এটা আমাদের জন্য খুবই দরকারি। এর মধ্যেই যাতে আমরা সবকিছু সম্পন্ন করতে পারি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে রাজনৈতিক রক্তাক্ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। সেটাকে আমাদের পাশের দেশ ভারত এক ধরনের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং নানান কথা বলছে। এটা ঠিক জাতীয়তাবাদী চৈতন্য থেকে নয়, দেশকে ভালোবাসি বলে নয়, তথ্য বিকৃতি হিসেবে নানা জায়গা থেকে মিডিয়া এগুলো সাধ্যমতো বলছে। কিন্তু সেটা হচ্ছে একটা মিডিয়ার লড়াই। বলতে চাচ্ছি বস্তুত ফাংশনাল ডিপ্লোম্যাসিতে আপনার এ ক’দিনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ভারতের সম্পর্কে একটা সুষ্ঠু ওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কি আমরা এগোতে পেরেছি?

ড. ইউনূস : আমরা বরাবরই সেটা চেষ্টা করছি। ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরা। প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ফোনে আলাপ হলো (উনি ফোন করেছিলেন)। উনি অভিযোগ করলেন এখানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। বললাম, যে এটা অতিরঞ্জিত কতগুলো সংবাদ আপনার কাছে যাচ্ছে। কাজেই এটা আপনি বিশ্বাস করবেন না। যদি আপনি প্রকৃত তথ্য জানতে চান আপনার সাংবাদিকদের পাঠান। এখানে আসুক, তারা দেখুক। দেখে রিপোর্ট করুক। আমাদের তথ্যগুলো যদি আস্থায় আনতে না চান তাহলে এটাই প্রকৃত পরিস্থিতি। পরে অনেক ভারতীয় সাংবাদিক এখানে এসেছিলেন। তারা রিপোর্ট করেছেন। আমরা চেষ্টা করছি যাতে করে অতিরঞ্জন থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু কিছু সংবাদ আছে যেগুলো অতিরঞ্জনের বিষয় না। এগুলো একেবারে গাঁজাখুরি কতগুলো কথা। সে রকম চলছেই। নানারকম আজগোবি সংবাদ দিচ্ছে। পরে যখন তাদের পররাষ্ট্র সচিব আসলেন তখন বললাম এরকম কেন হচ্ছে? উনি বললেন, এটা আমাদের সরকারের বিষয় না। সরকার এটার মধ্যে জড়িত না। এগুলো মিডিয়ার বিষয়। আমাদের আওতার বাইরে। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের তথ্যগুলো তাদের কাছে দেয়ার জন্য। ইন্টারন্যাশনাল করেসপন্ডেন্টরা যখন আসে তারা করে। এখন মনে হয় ইন্টারন্যাশনাল কভারেজের কারণে অতবেশি জুত করতে পারছে না। এখনো উল্টাপাল্টা খবর দিচ্ছে, কিন্তু জুত করতে পারছে না। আগে বলছিল, এটা ইসলামিস্ট অভ্যুত্থান হয়েছে। তালেবানদের হাতে চলে গেছে ইত্যাদি। পত্রপত্রিকা, ইন্টারন্যাশনাল কাগজপত্রে যখন আসছে ওখানে তারা আর সুবিধা করতে পারছে না ওরকম বলে। কিছু কাগজ দেখালো এখানে, দেখা গেল কেবিনেটের মধ্যে কারা কারা আছে। তাদের যে পরিচিতি দিলো কেউ বিশ্বাস করবে না এরা ইসলামিস্ট গোষ্ঠীর। এই ধরনের প্রোপাগান্ডা আগের থেকে অনেকটা কমেছে।

প্রশ্ন : মানবতাবিরোধী বিচারের জন্য আপনার সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আপনারা অফিসিয়ালি চিঠি দিয়েছেন। কত দিনের মধ্যে এটার উত্তর আশা করেন?
ড. ইউনূস : কত দিন সময় লাগতে পারে সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।
প্রশ্ন : আপনার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চয় আপনাকে জানিয়েছে?
ড. ইউনূস : না, আমি জিজ্ঞেস করিনি কত দিন লাগবে। আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি, দেখি তারা কী জবাব দেয় বা দিচ্ছে কিনা সেটা ফলোআপ করব। ডেফিনেটলি এটা একটা গতি নেবে।
প্রশ্ন : উত্তর না এলে অনুমান কত দিন পরে আবার চিঠি দেবেন?
ড. ইউনূস : এটা মাস খানেক হতে পারে। আমরা ফলোআপ করব, দেখি কী হয়।

প্রশ্ন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক ভালো সম্পর্ক। ট্রাম্পের ক্যাবিনেটে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাতজন মন্ত্রী আছেন বলে জানা গেছে। আপনার সাথে পশ্চিমের সম্পর্ক ভালো বলে মানুষ মনে করে। তাদের (ভারত-যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যে এই সম্পর্ক আমাদের দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে আপনি আশঙ্কা করেন?
ড. ইউনূস : এত ঘনিষ্ঠতা থাকলে হতে পারে। কারণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যদি ওখানে ক্ষমতায় থাকে তার একটা প্রভাব পড়তেই পারে। ইতোমধ্যে তার প্রভাবের নমুনাও কিছুটা আমরা দেখেছি। কাজেই আমরা দেখছি এটা কোন দিকে যায়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেই যে সে যুক্ত থাকবে এমন কোনো কথা না। সে হয়তো আমাদের দিকেও বেশি মনোযোগ দিতে পারে। আমরা বের করতে পারি যে, কারা কারা আমাদের দিকে সহনুভূতিশীল হবে। কিভাবে আমরা তাদের সহানুভূতি পেতে পারি। নতুন সরকারের সাথে কিভাবে সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement