০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১, ৬ রজব ১৪৪৬
`

ধ্বংসস্তুপ থেকে অর্থনীতি টেনে তোলার চ্যালেঞ্জে অন্তর্বর্তী সরকার

-


পতিত আওয়ামী লীগ সরকার তার অপশাসনে রাষ্ট্রের দু’টি জায়গা ধ্বংস করে রেখে গেছে। এর একটি হচ্ছে- রাজনীতি এবং অপরটি হচ্ছে অর্থনীতি। ১৫ বছরে মানুষ যেমন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তেমনি বঞ্চিত হয়েছে সুশাসন ও নাগরিক অধিকার থেকে। একইভাবে সুশাসন ও দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগ সরকার পুরো অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। পুরো ব্যাংকিং খাত তো লুটপাট করে শেষ করে দেয়া হয়েছে। এর পুরো ছায়া দেখা গেছে গত ২০২৪ সালব্যাপী। সরকারি শে^তপত্র বলছে, গেল ১৫ বছরে শুধুমাত্র দেশ থেকে অর্থ পাচারই হয়েছে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কয়েক বছর ধরেই দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী সঙ্কট চলছিল। এর মধ্যে ডলার সঙ্কট, রিজার্ভের ক্রমাগত নি¤œগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ খরা, রাজস্ব ঘাটতি, সরকারের ঋণের বোঝা, ব্যাংক খাতের দুর্দশা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের লুটপাট, অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সঙ্কটে অর্থনীতি খাবি খাচ্ছিল। এখন উত্তারাধিকার সূত্রে এ সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে।
গেল বছর অর্থনীতির গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, গেল বছর মূল্যস্ফীতি, ব্যাকিং খাতে অব্যবস্থাপনা সামগ্রিক অর্থনীতিকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। বর্তমান সরকার আগের সরকারের অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। তিনি নয়া দিগন্তকে আরো বলেন, গত বছর অর্থনীতি অনেক ধরনের চাপের মধ্যে ছিল। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, প্রবৃদ্ধির পতন, বিনিয়োগ স্থবিরতা, ব্যাকিং খাতের দুর্দশা এবং রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি। এসব কারণে অর্থনীতি ছিল উল্টোপথে। অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তোলার জন্য এখন পর্যন্ত সময় পেয়েছে চার মাসের একটু বেশি। তারা চেষ্টা করছে অর্থনীতির দুরবস্থা কাটিয়ে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। এর মধ্যে ভালো সফলতা পাওয়া গেছে রেমিট্যান্স, রিজার্ভ ও রফতানি খাতে। তবে কাক্সিক্ষত উন্নতি হয়নি মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান খাতে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়া। বর্তমান সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী সত্যিকার অর্থেই কষ্টে আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দফায় দফায় সুদহার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তার সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে বাগে আনা যাচ্ছে না। বিগত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে রয়েছে। নভেম্বর মাসে তো খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশের ঘর ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির মূল কারণ সরবরাহজনিত। সরবরাহব্যবস্থা ঠিক করার পাশাপাশি চাঁদাবাজি বন্ধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কার্যকর উন্নয়ন করতে সরকার অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। আমন ধানের বাম্পার ফলনের পরও বাজারে চালের দাম একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। এই খাতে সিন্ডিকেট এখনো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আনার কথা বলে বেশ কয়েক মাস ধরে দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ থেকে বাড়িয়ে প্রায় ১৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। নীতি সুদহার (রেপো রেট) ৫ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও এখনো মূল্যস্ফীতি না কমে উল্টো ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। নভেম্বরেও দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার আরো বেশি চড়া। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশে। ফলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ।

রেমিট্যান্সের সুবাতাস
এসব দুঃসংবাদের মাঝে রেমিট্যান্স খাতে ভালো খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রবাসীদের মধ্যে দেশের প্রতি আস্থা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তার প্রমাণ বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার আয় দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই আয় এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশে এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ডলার।
গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। তবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আয় এসেছিল ১৯৯ কোটি ১০ লাখ ডলার। ফলে গত মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ জোরালো হতে শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় নভেম্বরে প্রবাসী আয় আসে ২২০ কোটি ডলার। গত বছরের নভেম্বরে দেশে ১৯৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। সেই হিসাবে নভেম্বরে প্রবাসী আয় বাড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ। গত অক্টোবরে দেশে ২৩৯ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। গত সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ডলার ও আগস্টে ২২২ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় দেশে আসে।
রিজার্ভের উচ্চমুখী : আওয়ামী লীগের যখন পতন হয় তখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম। কিন্তু গত চার মাসে রেমিট্যান্স যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে। তেমনি বেড়েছে রিজার্ভের পরিমাণও। যা এখন ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে অবস্থান করছে।
বাড়ছে রফতানি প্রবৃদ্ধি : টানা চতুর্থ মাস বৃদ্ধি পেয়েছে দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি। গেল ডিসেম্বর মাসে যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ ।

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্যানুসারে, ডিসেম্বরে দেশের রফতানি আয় পৌঁছায় ৪৬৩ কোটি ডলারে, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩৯৩ কোটি ডলার।
ইপিবির তথ্য বলছে, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট পণ্য রফতানি হয়েছে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ডলারের। আগের বছরের একই সময়ে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল বাংলাদেশ।
রাজস্ব আদায়ে শ্লথ গতি : ওপরের তিনখাতের ঊর্ধ্বমুখিতা সত্ত্বেও রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে সরকার। সর্বশেষ নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৪২ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গতি না ফেরা এবং বেশকিছু নিত্যপণ্য আমদানিতে ট্যাক্স ছাড় দেয়ায় সরকারের রাজস্ব কমে গেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কেবল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় নয়, আলোচ্য সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়ও রাজস্ব আদায় কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ, যার পরিমাণ ৩ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে নভেম্বরেই কমেছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসের মধ্যে তিন মাসেই গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায় কমেছে।
প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়েছে। এর আগে গত অক্টোবরে সংস্থাটি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৪ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করেছিল। আইএমএফ জানায়, ‘গণ-অভ্যুত্থান, বন্যা এবং কঠোর নীতির কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।’ আইএমএফ আরো অনুমান করছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মূল্যস্ফীতি বার্ষিক গড় হিসাবে প্রায় ১১ শতাংশ থাকবে। তবে কঠোর নীতি এবং সরবরাহের চাপ কমার ফলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা ৫ শতাংশে নেমে আসবে।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে আইএমএফের এ সর্বশেষ প্রক্ষেপণ বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসের তুলনায় কম। অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস দেয়। তার আগে এপ্রিলে এটি ৫ দশমিক ৭ শতাংশ পূর্বাভাসের কথা জানিয়েছিল।

দুই আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন হবে।
তবে নতুন বছরের অর্থনীতি পরিস্থিতি বেশ টানাপড়েনের মধ্যে থাকবেই বলে মনে করা হচ্ছে। এর কারণ বর্তমান সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি হাতে পেয়েছে। এটিকে সঠিক পথে আনতে চলতি বছরটি সরকারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সরকার কতখানি সফল হবে তার দেখার জন্য আমাদের ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে আগের মতো আমলা নির্ভর অর্থনীতি পরিচালনা করা হলে এই চ্যালেঞ্জ উতরানো যে সম্ভব হবে না তা সহজেই বোঝা যায়। এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবেলা করা হবে তা নির্ভর করছে অর্থ উপদেষ্টা, বাণিজ্য উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঠিক নেতৃত্বের ওপর।

 


আরো সংবাদ



premium cement