বিএফআইইউ প্রধান হতে এস আলম ও আ’লীগের সুবিধাভোগীদের দৌড়ঝাঁপ
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫৭
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন এস আলমসহ ব্যাংক লুটেরাদের সহযোগী ও আওয়ামী লীগের দোসর কিছু কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে এমনই একজন সাবেক কর্মকর্তার নাম সার্চ কমিটি দুই দফা বৈঠক করে অন্তর্ভুক্ত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫ আগস্টের আগেও ওই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম ও জাহাঙ্গীর কবির নানককে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য তদবির করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাদের মতে, চলমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানের ভূমিকা অপরিসীম। কোনো রকম দুর্নীতির সাথে সম্পর্ক বা পতিত সরকারের আমলে এস আলমসহ ব্যাংক লুটেরাদের সুবিধাভোগীরা এ পদে এলে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার কার্যক্রম পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব বরণকারীদের ত্যাগ বৃথা যাবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান পদে নিয়োগের জন্য মৌখিক সাক্ষাৎকারের চিঠি পেয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, জহুরুল হুদা, আকতারুল ইসলাম, নুরুল আমিন, বর্তমান নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম, এ কে এম এহসান, মো: সাইফুল ইসলাম খান, বর্তমান পরিচালক মামুন হোসেন ও এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি আশিকুর রহমান। এর মধ্যে তিন জনের নাম চূড়ান্ত করে মনোনয়নের জন্য এ সংক্রান্ত গঠিত সার্চ কমিটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছে। তিনজনের মধ্যে ৫ আগস্টের পর বিএফআইইউর দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান রয়েছেন। এ তালিকায় আরো আছেন এস আলমসহ ব্যাংক লুটেরাদের সহযোগী ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের সাথে একত্রে কাজ করা, পরে ৫ আগস্টের পর বিএফআইইউ থেকে সরিয়ে দেয়া নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম ও বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মামুন হোসেন। গত ১১ ও ১২ ডিসেম্বর দুই দফায় মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
জানা গেছে, ওই পরীক্ষায় ভালো না করায় এক বছর আগে অবসরে যাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম শাহীনুল ইসলামের নাম চূড়ান্ত তালিকায় ছিল না। কিন্তু সার্চ কমিটি গত দুই সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় ও সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈঠক করে শাহীনুল ইসলামের নাম চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে এসেছে। এর পরেও কী কারণে তার নাম বিএফআইইউর শর্ট লিস্টে অন্তর্ভুক্তি করা হচ্ছে তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, শাহীনুল ইসলামের আগে আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম ও জাহাঙ্গীর কবির নানককে দিয়ে ৫ আগস্টের আগে ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য তদবির করেছিলেন। একই সাথে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিএফআইইউ সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের সাথেও কাজ করেছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অনেকটা একই ধরনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পূর্ববর্তী প্রধান কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে। যার ফলে সকল আইন-কানুন উপেক্ষা করে বিএফআইইউ প্রধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয় এস আলমের একান্ত ঘনিষ্ঠ মাসুদ বিশ্বাসকে। ফলাফল যা হওয়ার তাই, এস আলমসহ সব দোসরকে অর্থ পাচারে সহায়তার পাশাপাশি নিজেকেও জড়ান দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মে। আর পাচার প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা বিএফআইইউকে সম্পূর্ণ অকার্যকর সংস্থায় পরিণত করেন ওই কর্মকর্তা।
এখন আবার একই রকম প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত হীন স্বার্থ চরিতার্থ ও গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিএফআইইউকে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে প্রধান কর্মকর্তা পদে এমন একজন বসানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে যাতে টাকা পাচারকারীদের পাকড়াও না করে ছেড়ে দেয়। একই সাথে বর্তমান বিএফআইইউ গতিশীল হওয়া ঠেকাতে এ কে এম এহসানের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এক অভিযোগ। প্রায় সবাই জানেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অর্ফানেজ ট্রাস্টের মামলায় ফাসানো হয়েছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের প্রধান হাসিনা ও তার দোসরদের অপতৎপরতায় ও দুদকের প্রত্যক্ষ ভূমিকায়। এখানে বিএফআইইউ থেকে কোনো প্রতিবেদনও পাঠানো হয়নি। অথচ এ বিষয়ে দুইটি গণমাধ্যম ভুল তথ্য প্রচারের জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আগস্ট পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় যারা লুটপাটে সহযোগিতার দায়ে চাকরিচ্যুত কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে বদলি ও সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তারাই এখন উঠে পড়ে লেগেছে বিএফআইইউসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিএফআইইউ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে একজন সৎ, যোগ্য ও চৌকস কর্মকর্তাকে; যার ওপর নির্ভর করছে পাচারকৃত ১০ লাখ কোটি টাকা ফেরত আনার কার্যক্রম। যারা পাচার করেছেন তাদের সুবিধাভোগী বা দুর্নীতিবাজদের নিয়োগ দেয়া হলে পুরো অর্থ উদ্ধারের কার্যক্রমই ভেস্তে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে বিএফআইইউ কার্যক্রমে গতি ফিরে এসেছে। অর্থ পাচারকারীদের পাকড়াও করতে নানা ধরনের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এস আলম, বেক্সিমকো, নাসা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, শেখ পরিবারসহ অগ্রাধিকারভিত্তিতে ১১টি বড় গ্রুপের কাছ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও বসুন্ধরা গ্রুপের পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের জন্য আদালত থেকে নির্দেশনা নিয়ে চূড়ান্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এস আলম, শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সবার কাছ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার কার্যক্রমও প্রক্রিয়াধীন আছে। হুন্ডি কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে। এ কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গেছে। ডিসেম্বরে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। কর্মকর্তাদের মতে, যোগ্য ব্যক্তিকে বিএফআইইউ প্রধান করা হলে দুর্নীতির অর্থ ফেরানোর পথ সুগম হবে।