ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় দেড় দশকের নখদন্তহীন দুদক
- জিলানী মিলটন
- ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০৫, আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫
- দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রায় দুই শ’ মন্ত্রী-এমপিকে দায়মুক্তি দেয়ার অভিযোগ
- হাসিনা সরকারের পতনের পর আ’লীগের শতাধিক ভিআইপি ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু
স্বৈরশাসনের দেড় দশকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দুর্নীতির রক্ষক আর বিরোধীদের ভক্ষকে পরিণত করা হয়েছিল। এ সময়ে দুদক দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ এবং অর্থপাচারের যেসব মামলা দায়ের করেছে, তার বেশির ভাগই ছিল বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে কমিশনের এক সাবেক চেয়ারম্যান দুদককে নখ-দন্তহীন বাঘ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে গেল জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুদকে এসেছে পরিবর্তন। ৫ আগস্টের আগে যেসব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে দুদকের কথা বলা ছিল অকল্পনীয়, সেখানে এখন তাদের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান, তদন্ত এবং মামলা হচ্ছে প্রতিদিন।
দুদকের ঘুরে যাওয়ার এ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে রাষ্ট্রের এই সংস্থাটি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী, এমপি ও ব্যবসায়ীদের নামে দুদকের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যে পদ্মা সেতু নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী পলাতক শেখ হাসিনা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিযুক্ত করে পদ্মা নদীতে চুবিয়ে তোলার কথা বলেছিলেন, সেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির মামলাটি অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
প্রথমে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করে দুদক। প্রায় দুই বছর তদন্তের পর ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সরকার বদলের সাথে সাথে অন্যান্য দফতর, অধিদফতর ও কমিশনের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) এসেছে পরিবর্তন। পুরনো কমিশনের পরিবর্তে এসেছে নতুন কমিশন। এরই মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দুদক সংস্কারে আলাদা কমিশনও করেছে। আগামী ৭ জানুয়ারি সরকারের কাছে এই সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে।
২০০৪ সালে গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। এরপর যথাক্রমে সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধুরী, গোলাম রহমান, মো: বদিউজ্জামান, ইকবাল মাহমুদ ও মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ যুগের অবসান হয়েছে। কিন্তু দুদকের ভাবমূর্তির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। সর্বশেষ গত ১১ ডিসেম্বর ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গেল বছরের শেষের দিকে বিগত সরকারের দুর্নীতিবাজদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা হলেও কৌশলে স্বীকৃত অনেক দুর্নীতিবাজ পার পেয়ে গেছে।
তবে দুদকের ঘুরে যাওয়ার এ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে রাষ্ট্রের এই সংস্থাটি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী, এমপি ও ব্যবসায়ীদের নামে দুদকের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
৫ আগস্টের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, অনুসন্ধান ও তদন্তে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটিকে। বিদায়ী বছরে দায়ের করা মামলা কমলেও বেড়েছে দায়মুক্তি বা অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি। যদিও আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে হঠাৎ আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ আড়াই শতাধিক ভিআইপি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান নিয়ে আলোচনায় আসে দুদক।
জালে মন্ত্রী-এমপিসহ আড়াই শতাধিক ব্যক্তি : টিমটিম করে চলা রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুদক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হঠাৎ নড়েচড়ে বসে। আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই আওয়ামী সরকারের অন্তত ১০০ মন্ত্রী-এমপি, সাবেক শীর্ষ আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ব্যবসায়ী, পুলিশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতির খোঁজে মাঠে নামে সংস্থাটি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দুই মাসে দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় ১৮০ জনের নাম থাকলেও তৃতীয় মাসে তা দুই শ’য়ের কোটা ছাড়িয়ে যায়। এ তালিকার বেশির ভাগই আওয়ামী দলীয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপি এবং বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠজন। শুধু তাই নয়, তাদের নামে-বেনামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ চলমান। অনুসন্ধান কাজকে আরো গতিশীল করতে অর্ধশত ব্যক্তিকে দিয়েছে বিদেশে যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা। যদিও এরই মধ্যে অনেকেই দেশত্যাগ করেছে কিংবা গ্রেফতারও কিছু শীর্ষ নেতাকর্মী। অধিকাংশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, ব্যাংকের ঋণ নিয়ে লুটপাট, অর্থপাচার, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, সরকারি ও বেসরকারি জমি-সম্পত্তি দখল, লুটপাটসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন।
অনুসন্ধান গতি এলেও পিছিয়ে নেই দায়মুক্তিতে : বিদায়ী বছরের ১১ মাসে (জানুয়ারি-নভেম্বর পর্যন্ত) বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪৩৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়া হয়। ২২৭টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) হয় এবং মামলা থেকে অব্যাহতি বা পরিসমাপ্তি দেয়া হয় ৪৮টি মামলার। ওই সময়ে ৩২৮টি মামলা ও ৩৪৫টি মামলার চার্জশিট দিয়েছিল দুদক।
দুদক সংস্কার কমিশন : বিদায় নেয়া ২০২৪ সালে আরো একটি আলোচিত ঘটনা হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে কমিশন গঠন। গত ৩ অক্টোবর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে প্রধান করে আট সদস্যের কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক মোস্তাক খান, ব্যারিস্টার মাহদীন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফারজানা শারমিন ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি। আর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ কমিশনকে সাচিবিক সহায়তা দিচ্ছে। এর মধ্যে গত ২২ অক্টোবর সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে সাবেক মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মাসুদ আহমেদের পরিবর্তে আরেক সাবেক মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক আহমেদ আতাউল হাকিমের নাম যুক্ত করা হয়। আগামী ৭ জানুয়ারি সরকারের কাছে ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে।
দুদক কমিশনের আকস্মিক পতন : গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিশনের পদত্যাগ করা গুঞ্জন চলছিল। যদিও পরের দুই মাস তারা দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্বপালনকালে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ আড়াইশত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। এরপর সবাইকে আকস্মিকভাবে গত ২৯ অক্টোবর বিগত আওয়ামী সরকারের আজ্ঞাবহ মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিশনের পতন হয়। দুদক চেয়ারম্যানসহ কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক ও কমিশনার আছিয়া খাতুন (অনুসন্ধান) ওই দিন দুপুরে পদত্যাগপত্র জমা দেন। ৩১ অক্টোবর তাদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে। দুদক আইন ২০০৪ এর ১০ ধারা অনুযায়ী তারা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন।
দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ দায়িত্ব পান ২০২১ সালের ৩ মার্চে। আর ওই বছরের ১০ মার্চ কমিশনার জহুরুল হকসহ তিনি যোগদান করেন। এর দেড় বছর পর আছিয়া খাতুনকে কথমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খানের স্থানে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের পদত্যাগের ঘটনা দুদকের ইতিহাসের তৃতীয় উদাহরণ।
অভিযোগ রয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মঈনুদ্দিন কমিশন প্রায় দুই শতাধিক আওয়ামী মন্ত্রী, এমপিকে দায়মুক্তি দিয়েছেন।
নতুন কমিশনের যাত্রা : আকস্মিকভাবে মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিদায়ের পর আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দীর্ঘ ৪২ দিন কমিশনশূন্য ছিল দুদক। এরপর বছরের শেষ সময়ে এসে ১০ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকে চেয়ারম্যান এবং সাথে অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) হাফিজ আহ্সান ফরিদকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
কর্মস্থলে যোগদান করেই নতুন কমিশন জনপ্রত্যাশা পূরণ করবে বলে আশ্বস্ত করলেন নতুন চেয়ারম্যান মোমেন। একই সাথে রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো মতাদর্শে প্রভাবিত না হয়ে বড় ধরনের দুর্নীতিবাজ শেষ পর্যন্ত যেন ছাড় না পায়, সেই প্রচেষ্টার কথাও জানালেন তিনি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা