ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে অর্থ লুটপাট
- হামিদ সরকার
- ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
- আর্থিক খাত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং অবকাঠামো খাতে সবচে’ বেশি
- গত দেড় দশকে এডিপির আকার বাড়ানো হয়েছে ১০ গুণ
- ৩৬ প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে ১০ বছরেরও বেশি : সিপিডি
- প্রকল্পের ৪০ শতাংশ খরচই লুটপাট করা হয়েছে: শ্বেতপত্র প্রতিবেদন
- বেশির ভাগ প্রকল্পই ছিল সাদা হাতির মতো : ড. জাহিদ হোসেন
- মেগা প্রকল্প থেকে দুর্নীতি করে অর্থ পাচার হয়েছে : ড. মোস্তাফিজ
উন্নয়ন প্রকল্পের নামে গত দেড় দশকে বিশেষ করে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। দশ গুণ বাড়ানো হয়েছে উন্নয়ন ব্যয়। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সর্বোচ্চ এক যুগ। সময় ও ব্যয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাড়িয়ে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন ২০০৮ সালে ক্ষমতা নেয় তখন থেকে ২০২৪ সালে পতন পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বাড়ে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ৩৬টি প্রকল্পের বয়স ১০ বছরের বেশি। শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় বলা হয়েছে, স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রকল্পের ৪০ শতাংশ অর্থ লুণ্ঠিত হয়েছে, বিদেশে পাচারও হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, ভৌত অবকাঠামো এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ লুণ্ঠন করে পাচার করা হয়েছে। বেশির ভাগই লুটপাটের বিবেচনায় প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তাদের স্বজনদের কাজ দেয়ার জন্য। লোক দেখানোর প্রকল্পের বেশির ভাগই সাদা হাতির মতো। প্রকল্পের খরচ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই ঠিকাদার বিল তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
১৫ বছরে এডিপির আকার ১০ গুণ বৃদ্ধি : পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার ১৫ বছরে এডিপির আকার ১০ গুণ বাড়িয়েছে। ১৫ বছরে আকার বেড়েছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। গত ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরের অর্থবছরে (২০০৯-১০) সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকার এডিপি নিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপর প্রতি বছরই এডিপির আকার বেড়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সর্বশেষ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, গত ১৫ বছরে এডিপি মাধ্যমে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের খরচের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত টাকা লুটপাট করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাড়তি খরচ দেখিয়ে এই বিপুল অর্থ লুটপাট করেছেন বিদায়ী ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও সুবিধাভোগীরা। এডিপির মাধ্যমে যত টাকা খরচ করা হয়েছে, এর ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অপচয় ও লুটপাট হয়ে গেছে। আর ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে বলে শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, বর্তমান বাজার দরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
বয়সের ভারে মেগাপ্রকল্প : এডিপি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তালিকাভুক্ত এক হাজার ১৩৮টি প্রকল্পের গড় বয়স হলো ৫.২ বছর। এর মধ্যে ৩৫৭টি প্রকল্পে গড় বয়স ৬ থেকে ১০ বছর। আর ৩৬টি প্রকল্পের বয়স ১০ বছরের বেশি। বিনিয়োগ প্রকল্পের ৪৫.৫ শতাংশ এরই মধ্যে ১ থেকে ৪ বার সংশোধিত হয়েছে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বিশ্লেষণে বলেন, প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার আগাচ্ছে না। পিছিয়েই রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে, মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটির খরচ বাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সালের আগষ্টে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩৫ হাজার ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে শেষ করার কথা। ১০ বছরে শেষ করতে খরচ বাড়ানো হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। ফলে প্রকল্পের ব্যয় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অত্যাধুনিক ও উচ্চগতি সম্পন্ন এক্সটার্নাল টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় ২০২২ সালের মার্চে। প্রকল্পটি ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত বাস্তবায়নের জন্য সময় ধরা হয়। এখন ঘুমন্ত এই প্রকল্পের খরচ ৩৭৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা থেকে ৯১ শতাংশ বাড়িয়ে ৭২৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা করা হয়। বাস্তবায়ন সময় আরো সোয়া দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। আর ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে প্রথম খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। দুই বার সংশোধন করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকায়। প্রকল্পটি ২০১০ সালের জুলাইতে অনুমোদন দেয়া হয়। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০২৪ সালের জুন। আর ১৭ বছরে শেষ হয় গাজীপুর-আজমতপুর সড়ক নির্মাণ কাজ। ২০০৯ সালে গাজীপুর-আজমতপুর-ইটাখোলা সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন পেলেও তা ২১৪ কোটি টাকায় অতিক্রম করে।
ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত ৮ প্রকল্পে ৩.১৩ লাখ কোটি টাকা : ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত ৮টি প্রকল্পের মধ্যে মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়েছে। চলমান ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- মেট্রোরেল-১, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল মৈত্রী বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করা হচ্ছে। শুরু থেকে গত জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পগুলোর আওতায় ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৮৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে গড় আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৮ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৯১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এসব প্রকল্পের ব্যয়ও দফায় দফায় বাড়িয়ে দ্বিগুণের বেশি করা হয়েছে।
আর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প থেকে দুর্নীতি করার মাধ্যমে অর্জিত যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। তার বোঝা পরবর্তী কয়েক প্রজন্মকে তাদের ঘাড়ে বহন করতে হতে পারে। দেশের যত ধরনের ক্ষতি করা যায়, তার সব কিছু করেই তারা (সাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা) অর্থ বাইরে (পাচার) নিয়ে গেছেন।
উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, এক্সপ্রেসওয়ে এবং কর্ণফুলী টানেলের মতো বৃহৎ অবকাঠামোগত প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচার হয়েছে। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের নাম করে লুটপাটের সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে। যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির পথে বড় বাধা। শেখ হাসিনা গত ১৬ বছরে কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখালেও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের আড়ালে দুর্নীতি হয়েছে। যেসব প্রকল্প ২০ হাজার কোটি টাকায় শেষ হতে পারত, তা সিন্ডিকেট, লুটপাট ও স্বজনপ্রীতির কারণে ৩৫ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে। তিনি উল্লেখ করেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের পর রেলওয়ে প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। অথচ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন ছিল।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, নিয়মনীতি না মেনে নানান ধরনের প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) নেয়া হয়েছে। বেশির ভাগই লুটপাটের বিবেচনায় প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তাদের স্বজনদের কাজ দেয়ার জন্য। আবার কিছু লোক দেখানোর জন্যও নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরাই থাকব আমরাই করব, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। লোকদেখানো প্রকল্পের মধ্যে দু-একটা ভালো ছিল। বেশির ভাগই সাদা হাতির মতো প্রকল্প। এ যেমন কর্ণফুলি টানেল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই অনেক রাজনৈতিক প্রকল্প নেয়া হয়েছে। আবার সময়ে সময়ে প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়েছে। পছন্দের ব্যক্তিদের প্রতিযোগিতাহীনভাবে ঠিকাদারি দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই ক্ষমতাসীনরা লোক দেখানো ‘প্রেস্টিজ’ প্রকল্প নিয়েছেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নানাভাবে ‘নয়-ছয়’ হয়েছে। একদিকে অর্থের অপচয় হয়েছে, সরকারি ঋণ বেড়েছে। অর্থনীতি কোনো উপকার পায়নি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্পই বেশি। একটি গোষ্ঠীর হাতে অর্থ চলে গেছে।
কক্সবাজার-ঘুমধুম রেল প্রকল্পটি নিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি বলেছিলেন, কক্সবাজার-ঘুমধুম প্রকল্পটি হাতে নেয়ার আগে গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। তখন বলা হয়েছিল যে, এটি বাস্তবায়ন করা হলে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সাথে যুক্ত হওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ঘুমধুমের ওপারে মিয়ানমারে শুধু পাহাড়ি এলাকা। সেখানে রেল লাইন তৈরির কোনো পরিকল্পনাও নেই। এমতাবস্থায় এত টাকা ব্যয় করে এ প্রকল্প নেয়ার কী প্রয়োজন, তা বোধগম্য নয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা