‘র’-এর হত্যাকাণ্ডে চালিকাশক্তি মোদি!
ওয়াশিংটন পোস্ট প্রতিবেদন- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০, আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৩৬
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ডের সাথে ভারতের গবেষণা ও বিশ্লেষণ সংস্থা ‘র’-এর যোগসূত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে এসব হত্যাকাণ্ড ভারতীয় গোপন অভিযানকেই উন্মোচন করে। কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ‘র’-এর বিরুদ্ধে বিদেশে ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করার অভিযোগ তুলেছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, ‘র’-একটি গোপন হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিল, যা পাকিস্তানে একাধিক ‘টার্গেট কিলিং’কে ইন্ধন দিয়েছিল। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সবচেয়ে দৃঢ়চেতা নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের বাইরেও ‘র’ এর কর্মকাণ্ডের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন।
হত্যাকাণ্ডের ধরন : সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি ছিল ২০২৩ সালের এপ্রিলে লাহোরে আমির সরফরাজ হত্যাকাণ্ড। ২০১১ সালে একজন ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার হত্যার সাথে জড়িত প্রাক্তন বন্দী সরফরাজকে মোটরসাইকেলে বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানের অভিযোগ যে, এই আক্রমণে ভারতের জড়িত থাকার সব লক্ষণ রয়েছে। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বলেন, ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড বাড়তে থাকে ২০২১ সালে।
তদন্তে ‘র’ দ্বারা পরিচালিত একটি অত্যাধুনিক নেটওয়ার্কের কথা জানা গেছে। পাকিস্তানি এবং পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, দুবাইয়ের মধ্যস্থতাকারীরা সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করে, স্থানীয় অপরাধী বা আফগান নাগরিকদের নিয়োগ করে এবং হাওয়ালার মতো অনানুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করে।
ভারতের বিস্তৃত আঞ্চলিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রায়ই অপারেটিভরা বিস্তারিত নির্দেশনা পায় বলে মনে করা হয়। প্রতিবেদন অনুসারে, পশ্চিমা বিশ্বে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ভারতের হত্যাকারী ভাড়ার কৌশলগুলো প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানে বিকশিত এবং উন্নত করা হয়েছিল।
ভারতের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ২০১৪ সালে বলেছিলেন যে, পাকিস্তানে আক্রমণ করা অবাস্তব ছিল; কিন্তু ভারতীয় সেনা এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আক্রমণকারী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করার দায়ে পাকিস্তানকে শাস্তি দেয়ার জন্য ভারতের গোপন উপায় ব্যবহার করা উচিত। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে দোভাল বলেন, যেখান থেকে আক্রমণ আসছে, সেখানে গিয়ে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারি, পাকিস্তানের দুর্বলতা ভারতের চেয়ে অনেক গুণ বেশি।’
ছায়া অভিযান বৃদ্ধি : ভারতের হত্যা অভিযান নতুন নয়। ২০১২ সালে পাকিস্তানে ছোট আকারের বোমা হামলার নেতৃত্বদানকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল ভি কে সিং কাশ্মিরি জঙ্গি নেতা সৈয়দ সালাহউদ্দিনকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।
একজন প্রাক্তন পাকিস্তানি কর্মকর্তার অভিযোগ, ২০১৩ সালে ইসলামাবাদের একটি বেকারির বাইরে গুলি চালানোর ঘটনায় ভারত জড়িত থাকতে পারে, যেখানে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে বোমা হামলার সন্দেহভাজন নাসিরুদ্দিন হাক্কানি নিহত হন।
তবে, মোদির পুনর্নির্বাচনের দুই বছর পরে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের প্রতি কঠোর অবস্থান নেন। তার পরও ২০২১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে ভারতের টার্গেট কিলিংয়ের ধারাবাহিক ঘটনা শুরু হয়নি। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা যুক্তি দেন যে, এই অভিযানগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দুই দেশের মধ্যে আস্থা নষ্ট করে। ইসলামাবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী অংশীদারদের কাছে এই বিষয়টি উত্থাপন করেছে এবং অভিযোগগুলোর নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ভারতের পদক্ষেপগুলো দক্ষিণ এশিয়াকে আরো অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি নিয়েছে, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা শত্রুতা এরইমধ্যে সশস্ত্র সঙ্ঘাত, সীমান্ত সংঘর্ষ এবং প্রক্সি-যুদ্ধকে উসকে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিযোগ এবং আঞ্চলিক প্রভাব : প্রায় একই সময়ে, একটি মার্কিন ফেডারেল অভিযোগপত্রে প্রকাশ করা হয়েছে যে, নয়াদিল্লিতে ভারতের গবেষণা ও বিশ্লেষণ শাখা (‘র’)-এর একজন কর্মকর্তা বিকাশ যাদব নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী পান্নুনকে লক্ষ্য করে একটি হত্যা প্রচেষ্টার পেছনে ছিলেন। যাদব তার সহযোগী, ব্যবসায়ী নিখিল গুপ্তকে স্থানীয় একজন খুনি ভাড়া করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কানাডিয়ান কর্মকর্তারা শিখ প্রবাসীদের বিরুদ্ধে একটি বিস্তৃত ভারতীয় অভিযানের উন্মোচন করেন, যার মধ্যে নজরদারি, ভয় দেখানো এবং এমনকি হত্যার চেষ্টাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কানাডায় ভারতীয় কূটনীতিকরাও শিখ সম্প্রদায়ের উপর নজরদারিতে জড়িত ছিলেন। কানাডিয়ান কর্মকর্তারা কূটনীতিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং টেক্সট বার্তার উল্লেখ করেছেন, যদিও এই বার্তাগুলো কিভাবে পাওয়া গিয়েছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়।
নিউ ইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি উল্লেখ করেছেন যে ‘র’-এর লক্ষ্যবস্তু হত্যার পদ্ধতিগুলো ইসরাইলের মোসাদের মতোই বলে মনে হচ্ছে, যারা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সফলভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। কিন্তু ২০১০ সালে দুবাইয়ে হামাস নেতাকে হত্যার জন্য একটি অভিযানে এজেন্টরা হোটেল নজরদারি ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
২০২৩ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি করে।
যদিও ভারতীয় কর্মকর্তারা অভিযোগের বিষয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন। তারা বলছেন যে, তাদের পদক্ষেপ সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার লক্ষ্যে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন ক্রমবর্ধমানভাবে অনুভূত হুমকি মোকাবেলায় গোপন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছে, এমন একটি কৌশল যা তার অভ্যন্তরীণ দর্শকদের সাথে অনুরণিত হলেও আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগের কারণ।
কূটনৈতিক অচলাবস্থা : শান্তি আলোচনার জন্য বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। পাকিস্তান ভারতের গোপন অভিযানগুলিকে কাশ্মির এবং জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচেষ্টার মতো বিষয়গুলোতে ইসলামাবাদকে চাপ দেয়ার একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনটি এমন এক সময় এলো যখন উভয় দেশই অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি- পাকিস্তান অর্থনৈতিক অস্থিরতার সাথে এবং ভারত তাদের মানবাধিকার রেকর্ডের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমবর্ধমান তদন্তের সাথে। তবে, ভারতের গোপন হত্যাকাণ্ড এরইমধ্যে অস্থির ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে একটি বিপজ্জনক স্তর যুক্ত করেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা