সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মৃত্যু
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু : প্রধান উপদেষ্টা- বিবিসি
- ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২১
শত বছরের জীবন পার করে বিদায় নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট, শান্তিতে নোবেলজয়ী জিমি কার্টার। গত রোববার বিকেলে জর্জিয়ার প্লেইনসে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান বলে জানিয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত কার্টার সেন্টার। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাষায়, জিমি কার্টার ছিলেন ‘অসাধারণ এক নেতা’। এক সময়ের বাদামচাষি কার্টার ইতিহাসের যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি দিন বেঁচেছিলেন; গেল অক্টোবরেই তিনি জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করেন।
এই ডেমোক্র্যাট ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যখন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। জনপ্রিয়তা হারিয়ে হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করলেও তিনি মানবিক কাজের মাধ্যমে সুনাম পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন, যা তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। তার ছেলে চিপ কার্টার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন একজন বীর, কেবল আমার কাছে নয়, শান্তি, মানবাধিকার ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় বিশ্বাসী সবার কাছে। ‘তিনি যেভাবে মানুষকে একত্রিত করেছিলেন, তাতে পুরো বিশ্ব আমাদের পরিবার হয়ে উঠেছে। এই ঐক্য ধরে রেখে তার স্মৃতিকে সম্মান জানানোর জন্য আমরা আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।’ কার্টার প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে জর্জিয়ার গভর্নর, মার্কিন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট এবং কৃষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি চার সন্তান রেখে গেছেন। তার স্ত্রী রোসালিন গত বছরের নভেম্বরে মারা যান। তাদের বৈবাহিক জীবন ছিল ৭৭ বছরের।
২০১৮ সালে ৯৪ বছর বয়সে মারা যান জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশ, তখন পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সবচেয়ে দীর্ঘজীবী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ক্যান্সারে আক্রান্ত কার্টার গত বছর তার চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তার বদলে বাড়িতে হসপিস কেয়ার নিতে শুরু করেছিলেন। কার্টারকে ‘একজন প্রিয় বন্ধু’ এবং ‘নীতি ও আস্থার মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘তিনি দেখিয়েছেন যে আমরা একটি মহান জাতি, কারণ আমরা ভালো মানুষ- ভদ্র ও সম্মানিত, সাহসী এবং সহানুভূতিশীল, নম্র এবং শক্তিশালী।’
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘আমাদের দেশের এক সঙ্কটকালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিমিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এবং সব আমেরিকানের জীবনমান উন্নত করতে তিনি তার ক্ষমতার মধ্যে সবকিছু করেছিলেন। এজন্য আমরা সবাই তার কাছে ঋণী।’
কার্টারের প্রেসিডেন্সি স্মরণীয় হয়ে থাকবে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং দেশের বাইরের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য। এর মধ্যে ইরানে পণবন্দী সঙ্কটও ছিল, যার অবসান ঘটেছিল আট আমেরিকানের প্রাণক্ষয়ের মধ্য দিয়ে।
১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্প ডেভিডে মিসর ও ইসরাইলের মধ্যে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন হয়, যাকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বড় বিজয় হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু দুই বছর বাদেই সেই অবদানের কথা ভুলে যেতে বসেন আমেরিকানরা, বিপুল ভোটে তারা রিপাবলিকান রোনাল্ড রিগ্যানকে বেছে নেন। ১৯৮০ সালের সেই নির্বাচনে কার্টারের ভরাডুবি হয়। ওয়াশিংটন ডিসির পাশাপাশি মাত্র ছয়টি অঙ্গরাজ্যে তিনি জয় পেয়েছিলেন।
এমন বড় পরাজয়ের পর রিপাবলিকনারা প্রায়ই ‘অদক্ষ নেতৃত্বের’ উদাহরণ দিতে গিয়ে কার্টারের কথা বলতেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, কার্টারের দলের অনেকেও তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। তারাও বলতে থাকেন, ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতির যে ব্র্যান্ড, কার্টারের প্রেসিডেন্সিতে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
ডানপন্থীদের অনেকে এখনো কার্টারের প্রেসিডেন্সির বছরগুলো নিয়ে উপহাস করলেও পরের কয়েক দশকের তার মানবিক প্রচেষ্টা এবং সাধারণ জীবনধারা অনেক আমেরিকানের জন্য একটি নতুন উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে।
কার্টারই প্রথম ও একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি হোয়াইট হাউজ ছাড়ার পর র্যাঞ্চ স্টাইলের দুই বেডরুমের বাড়িতে ফেরেন, যেখানে রাজনৈতিক জীবনের আগে থাকতেন তিনি। অধিকাংশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিদায়ের পর যা করেন- বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে বক্তৃতা দেয়া এবং স্মৃতিকথা প্রকাশের জন্য বিপুল অঙ্কের বিনিময়ে প্রকাশকের সাথে চুক্তি করা- সেই পথে যাননি কার্টার।
২০১৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এও বলেছিলেন, সত্যিকার অর্থে তিনি কখনো ধনী হতে চাননি। তার বদলে বাকি জীবন তিনি কাটিয়েছেন বিশ্বকে বৈষম্য ও ব্যাধি থেকে মুক্তি দেয়ার চেষ্টায়। শান্তি ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে তিনি সারথি হিসেবে বেছে নেন নেলসন ম্যান্ডেলাকে, প্রতিষ্ঠা করেন দ্য এলডার্স। সাবেক এ প্রেসিডেন্ট প্রতিষ্ঠিত কার্টার সেন্টার বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করে।
তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় কার্টার বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে গুরুতর ও সর্বজনীন সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্রতম মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান।’ কার্টারের মানবিক, পরিবেশগত ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘একটি উন্নত, ন্যায্য বিশ্বের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।
‘বিশ্বাসের ওপর ভর করে প্রেসিডেন্ট কার্টার অন্যদের সেবা করার জন্য বেঁচেছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত।’ কার্টারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘শিষ্টাচার, মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সেবার জীবনযাপনের অর্থ কী- তা তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। রিপাবলিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছেন, ‘কার্টার অফিসকে মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং আরো ভালো বিশ্ব গড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার প্রচেষ্টা থেমে যায়নি।’ ওয়াশিংটন ডিসিতে কার্টারের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
জিমি কার্টার ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু : প্রধান উপদেষ্টা
বাসস জানায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল বিজয়ী ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জোসেফ আর বাইডেনের কাছে পাঠানো এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘নোবেল বিজয়ী প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মৃত্যুতে আমি গভীর দুঃখ ও আন্তরিক সমবেদনার সাথে লিখছি, তিনি একজন অসাধারণ নেতা, মানবাধিকার এবং বিশ্বজুড়ে শান্তি ও গণতন্ত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অক্লান্ত প্রবক্তা।’
ড. ইউনূস বলেন, কার্টার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে এবং এর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক বহুমুখী প্রেক্ষাপটে সুদৃঢ় ও প্রসারিত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন যে কার্টার সেন্টারের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার ভালোবাসা ও আবেগের দৃষ্টান্ত রয়েছে।
২০০৬ সালের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইউনূস বলেন, ‘আমরা ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে তার সফরের কথা স্মরণ করছি এবং সেটি আমাদের জনগণের জন্য একটি মহান অনুপ্রেরণার উৎস।’ তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট কার্টার শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব রাজনীতির একজন আইকনিক ব্যক্তিত্বই ছিলেন না, তিনি আমার প্রিয় বন্ধুও ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বছরের পর বছর ধরে নোবেল বিজয়ীদের সমাবেশে অসংখ্যবার তার সাথে সাক্ষাৎ করার বিশেষ সম্মান লাভ করেছি। মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তার অবিচল অঙ্গীকার আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তাদের মধ্যকার আলোচনায় তাঁর গভীর বিনয়, প্রজ্ঞা ও জনগণের ক্ষমতায়নে প্রতি তার অবিচল বিশ্বাস ফুটে উঠত। নিঃসন্দেহে তার উত্তরাধিকার আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আমি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট কার্টারের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা