বঙ্গভবনে গেড়ে বসেছেন স্বৈরাচারের দোসররা
নীলনকশা বাস্তবায়নে মাঠে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২০, আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৯
বিসিএস ইকোনমিক ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা দিদারুল আলম। ছিলেন পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজের একান্ত সচিব (পিএস)। মূলত তৎকালীন মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেনের ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরেই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে ঢোকেন দিদারুল। সেখান থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হন তিনি। ২০২৩ সালে রাষ্ট্রপতি হন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন দিদারুল নিয়োগ পান রাষ্ট্রপতির পিএস হিসেবে। সেই থেকে বঙ্গভবনে গেড়ে বসেছেন তিনি। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর রাজনীতসহ নানা ক্ষেত্রে ওলোটপালোট হলেও দিদারুল আছেন স্বমহিমায়।
জানা যায়, তারও আগে দিদারুল ছিলেন হাসিনা সরকারের সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব:) তাজুল ইসলামের পিএস। সেই সময় বহুল আলোচিত বিদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রীয় উপহার ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ক্যাপ্টেন তাজ পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিত্ব হারালেও দিদারুল আলমরা থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর গত ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। পালিয়েছেন দলটির সিনিয়র নেতারাও। জানা যায়, পালানোর তালিকায় রয়েছেন একসময়ের প্রভাবশালী দলবাজ কর্মকর্তারাও। কিন্তু বঙ্গভবনে স্বৈরাচারের দোসর/সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা স্বপদেই বহাল রয়েছেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন দায়িত্ব নেয়ার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনিরুল ইসলামকে ওএসডি করা হয়। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আজিজুল হক মামুনকে। গত বছরের মাঝামাঝিতে রাষ্ট্রপতির এই এপিএস বিতর্কে জড়ান তার স্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদা আফরিন ও হারুন অর রশীদকে নিয়ে। ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে এপিএস মামুন ডিএমপির তৎকালীন রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশীদকে স্ত্রী সানজিদার পাশে দেখে বারডেম হাসপাতালে মারামারিতে জড়ান। পরে ছাত্রলীগ নেতাদের থানায় তুলে নিয়ে মারধরের ঘটনায় ইতোমধ্যে ডিএমপির রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশীদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মারধরে অংশ নেয়ার কারণে শাহবাগ থানার পরিদর্শক অপারেশনস মো: গোলাম মোস্তফাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। গত রোববার মামুনের স্ত্রী ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত উপ কমিশনার সানজিদা আফরিনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সানজিদার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে দু’টি হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) জিয়াউল আহসানের নাম বাদ দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর আগে ২০১৪ সালে প্রথম গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া নিয়ে তখন গণমাধ্যমে শিরোনাম হন। তার বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। বহু বিতর্কিত এই কর্মকর্তা এখনো বহাল রয়েছেন রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর কার্যালয় বঙ্গভবনে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্র জানায়, সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের আমলে একাধিকবার সহকারী প্রেস সচিব পদে ছিলেন বিসিএস তথ্য ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা মুহাম্মদ শিপলু জামান। আব্দুল হামিদের মেয়াদের শেষপর্যায়ে উপ প্রেস সচিব পদে পদোন্নতি পান তিনি। হাসিনা সরকারের পতন হলেও বঙ্গভবনে এখনো স্বপদে বহাল আছেন শিপলু জামান। বঙ্গভবনে বসেই ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্নপর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানের অভিযোগ উঠেছে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
সূত্র বলছে, রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে সরানো যায়নি। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব থেকে যান বিগত সরকারের প্রভাবশালী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। তবে, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ সাবেক ছাত্রলীগ কর্মকর্তারা রয়েছেন রাষ্ট্রপতির দফতরেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রশাসনে যে অস্থিরতা চলছে তার পেছনে রয়েছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পালিয়ে যাওয়া পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে যে তথ্যসন্ত্রাস চলছে, এর মূলেও রয়েছেন তারা। এদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস উইংয়ে দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন কর্মকর্তা কলকাঠি নাড়ছেন বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নানা কৌশলে গণভবনঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং নিয়েছেন। অন্য দিকে বঙ্গভবনে নিজ নিজ চেয়ারেই রয়েছেন হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগীরা। শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে গুটিকয়েক দলবাজ কর্মকর্তাকে সরানো হলেও বেশির ভাগই ঘাপটি মেরে বসে আছেন প্রশাসনে। মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সচিবালয় ও বিভিন্ন দফতরে এখনো কলকাঠি নাড়ছেন তারাই।
একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্টের পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব, সচিবসহ ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ঘাপটি মেরে থাকেন স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী দলবাজ আমলারা। বহু বিতর্কের পর সরানো হয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মহাপরিচালক (পরবর্তী সময়ে প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়) আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকীকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সারা দেশে ডিসি নিয়োগ ও মাঠ প্রশাসনে পদোন্নতি নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয় তার মূলে ছিলেন প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা। সে সময় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রশাসনের সর্বত্র কলকাঠি নাড়েন এই কর্মকর্তা। তাই, ফ্যাসিস্ট আমলে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে চরম বিতর্কের মুখে তাকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে বদলি করা হয়।
জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন উপ প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস। বিসিএস (বেতার ক্যাডার) ২৭ ব্যাচের এই কর্মকর্তাকে হাসিনার পতনের পর উপ সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগে বদলি করা হয় বলে জানা যায়। আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকী ও ইমরুল কায়েস দু’জনেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ে থাকা কর্মকর্তারা সক্রিয় ছিলেন। তাদেরকে সরানো হলেও বিভিন্নভাবে তারা কলকাঠি নাড়ছেন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। গণভবন ও বঙ্গভবনকেন্দ্রিক বিগত সরকারের নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা নানাভাবে ইউনূস সরকারকে বিতর্কিত করতে কাজ করছেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মিডিয়া ও আওয়ামীপন্থী মিডিয়া সেলের কাছে পাচার করছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা