খেলাপি ঋণের ভয়ঙ্কর চিত্র বের হয়ে আসছে
ডিসেম্বর শেষে ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে- আশরাফুল ইসলাম
- ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪১
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি লুটপাট ও অনিয়ম হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। এ সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দেশের সেরা ব্যাংকগুলো দখল করে ঋণের নামে যেমন পানির মতো অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে, পাশাপাশি এসব অর্থ যাতে খেলাপি হিসেবে দেখাতে না হয়, সে জন্য নানা শিথিলতা ও অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। ফলে আড়ালেই থেকে গেছে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র। ওই সব লুকানো খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন বের হয়ে আসছে। জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ৭৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয় দুই লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে তা পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে- এমন আভাস দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা জানিয়েছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার মোট ঋণের ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে মোট ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখানো যেত না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরোক্ষ নির্দেশে খেলাপি ঋণ আড়াল করা হতো। আবার খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র যেন প্রকাশ না পায় সে জন্য রিপোর্টিং ডেটের ১৫ দিন আগে কোনো রকম ডাউন পেমেন্ট না দিয়ে খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হতো। এতে কমে যেত খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণ কমে যাওয়ায় প্রভিশনও কম দেখাতে হতো। এতে এক দিকে প্রকৃত মুনাফা না করেও কৃত্রিম মুনাফা দেখানো হতো। অপর দিকে এ কৃত্রিম মুনাফার ওপর ভর করে ডিভিডেন্ট আকারে ভাগবাটোয়ারা করা হতো। পাশাপাশি কৃত্রিম মুনাফার ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স আকারে সরকার বের করে নিতো।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর কোনোভাবেই দুর্নীতিবাজদের সাথে আপস করছেন না। এ কারণে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। যারা এতদিন ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে বছরের পর বছর নিয়মিত দেখাতো এখন ওই সব ঋণই খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। ডিসেম্বর শেষে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র আরো ভয়াবহ আকারে রূপ নেবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নিয়েই দেশের আর্থিক খাতের ওপর হামলে পড়ে। দেশের অর্থনীতি ও ভৌগোলিক আকার অনুযায়ী নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই এমন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বিএনপিসহ চারদলীয় জোট সরকার নতুন কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়নি।
২০০৯ সালের পর নতুন ব্যাংক দেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তখনো মতামত দেয়া হয় নতুন ব্যাংকের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত নতুন ১২টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেন। এ বিষয়ে নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে ওই সময় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত উপেক্ষা করে কেন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে? জবাবে আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানিয়েছিলেন, দেশের অর্থনীতি ও ভৌগোলিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই, তবে আমরা রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিচ্ছি। এর পর থেকেই দেশের ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা শুরু হতে থাকে। মূলত ওই সময় থেকেই খেলাপি ঋণ আড়াল হওয়ার সংস্কৃতি শুরু হয়। মাত্র এক ও দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক হাজার ও ৫০০ কোটি টাকার ওপরের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের নামে আড়াল করা হয়। এভাবে ২০১৪ সালে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আড়াল করা হয়। এর পরেও খেলাপি ঋণ না কমায় পরবর্তী সময়ে কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট না নিয়েই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আড়াল করা হয়। এ জন্য প্রয়োজনে শুক্রবারেও পর্ষদ মিটিং ডাকা হতো। আর এ কাজে সরাসরি মৌখিক নির্দেশদাতা ছিলেন তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী।
২০১৭ সালের মে মাসে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক দখল করে দেশের আর্থিক খাতের অভিশাপ বলে খ্যাত সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম। একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ একের পর এক আটটি ব্যাংকের মালিকানায় নিয়ে যায় ওই বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম। এসব ব্যাংক থেকে ঋণের নামে পানির মতো অর্থ বের করে নিতে থাকে। অনেকটা গনিমতের মাল হিসেবে এস আলম ও তার সহযোগী আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন, জে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মোকাম্মেল ও সহযোগীরা অর্থ পাচার করতে থাকেন।
এভাবে একমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই এস আলম ঋণের নামে বের করে নিয়েছে প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তেমনিভাবে তার মালিকানায় থাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স তথা আভিভা ফাইন্যান্স থেকে বেহিসাবে অর্থ বের করা হয়। একইভাবে পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমে এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়। কিন্তু ওইসব অর্থ যোগসাজশের মাধ্যমে আর ফেরত দেননি।
তেমনিভাবে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার তার ব্যাংক থেকেও অর্থ বের করে নেয়। তার মালিকানাধীন নাসা গ্রুপ ঋণ নেয় ইসলামী ব্যাংক থেকেও। এভাবে বিভিন্ন গ্রুপ ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নিয়ে পরিশোধ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকরা এস আলম, নজরুল ইসলাম মজুমদার, সালমান এফ রহমানের ব্যাংকগুলো পরিদর্শনে গিয়ে ব্যাংকারদের সরবরাহকৃত তথ্যের বাইরে আর তেমন কোনো মন্তব্য করতে পারেনি। একপর্যায়ে এস আলমের ঋণ বের করে দেয়ার অন্যতম সহযোগী আকিজ উদ্দিনের ভয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেকেই তটস্থ থাকতেন। কথিত আছে, মাফিয়া আকিজ উদ্দিনকে অনেক ডেপুটি গভর্নরও লিফট পর্যন্ত এসে বিদায় জানাতেন। এসব ঋণ খেলাপি হলেও নিয়মিতই দেখানো হতো। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ঠিক কী পরিমাণ তা কেউ বলতে পারত না। তবে, অনেকেই এ নিয়ে নানা আশঙ্কা করতেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ওই সময় দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই এখন খেলাপি হয়ে গেছে। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের আনুপাতিক হিসাবে এটি সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, আমরা প্রকৃত খেলাপি ঋণ বের করার চেষ্টা করছি। এস আলম, নজরুল ইসলাম মজুমদার, ওরিয়ন গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপসহ প্রভাবশালী যারাই ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি তাদের ঋণ খেলাপি করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ উঠে যাবে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা মোট ঋণ রয়েছে প্রায় ১৭ লাখ কোটি টাকা। এ হিসাবে ৩০ শতাংশ হলে খেলাপি ঋণ হবে ৫ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা আর ৩৫ শতাংশ হলে খেলাপি ঋণ বেড়ে হবে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অনেক ব্যাংকের মুনাফাও ঋণাত্মক হয়ে যাবে। কারণ এতদিন ঋণ আদায় না হলেও আদায় দেখানো হতো। এতে বেড়ে যেত মুনাফা। কাগুজে মুনাফার ওপর ভিত্তি করে সরকার ৪০ থেকে সাড়ে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট ট্যাক্স নিত। পরিচালকদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হতো এসব মুনাফা। কিন্তু এখন খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হলে এর বিপরীত প্রভিশন রাখতে হবে। আর প্রভিশন রাখা হয় মুনাফা থেকে। অনেকেরই মুনাফা দিয়ে প্রকৃত প্রভিশন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না। ফলে ওইসব ব্যাংক রাতারাতি লাভজনক অবস্থান থেকে লোকসানি ব্যাংকের খাতায় নাম লেখাবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা