হাইকোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করেই জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত
প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতির পদত্যাগ- হাবিবুর রহমান
- ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪০
বিদায়ী বছর ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে। সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে হাইকোর্টের একটি বিতর্কিত রায়কে কেন্দ্র করে আন্দোলনে নামে দেশের সব বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে নামে সাধারণ মানুষও। শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে সহস্রাধিক প্রাণহানি ঘটে। কয়েক হাজার মানুষ গুরুতর আহত হন। রক্তাক্ত আন্দোলনের একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এই গণবিপ্লবের পর দেশের আদালত অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে গত ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেন। দেশে বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সাথে আপিল বিভাগের আরো ৫ জন বিচারপতি পদত্যাগ করেন। তারা হলেন- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো: আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি কাশেফা হোসেন ও বিচারপতি মো: শাহিনুর ইসলাম।
হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ : বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতির পদত্যাগ করার পর হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশের তৃতীয় অ্যাটর্নি জেনারেল এবং দু’টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের ছেলে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ছিলেন হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি। তাকে ডিঙ্গিয়ে অনেক বিচারপতিকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেয়া হলেও তাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
হাইকোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করেই জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত : গত ৫ জুন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এক রিটে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন। এর ফলে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল হয়। হাইকোর্টের এই পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১১ জুলাই প্রকাশ করা হয়।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করতে বিবাদিদের নির্দেশ দেয়া হলো। এ ছাড়া জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, জাতিগত সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও কোটাপদ্ধতি বজায় রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়। রায়ের এই আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে কোটা পুনর্বহাল করতে বলেন হাইকোর্ট। এরপরই দেশে সব বিশ^বিদ্যালয় এবং কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামে।
এরপর গত ২১ জুলাই সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল ও রহিত ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সাথে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য মেধাভিত্তিক শতকরা ৯৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জন্য ১ শতাংশ ও প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তবে আপিল বিভাগের এই আদেশ প্রদান সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজন ও সার্বিক বিবেচনায় এই আদালত কর্তৃক নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন ও সংস্কার করতে পারবে বলে আদেশে বলা হয়।
১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হয় : গত ১৬ অক্টোবর দুর্নীতি ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করার অভিযোগ ওঠায় ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এরপর থেকে তাদের আর হাইকোর্টের বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়নি। বর্তমানে এই বিচারপতিদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তদন্ত চলছে বলে সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে। ওই ১২ বিচারপতি হলেন- বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি আতাউর রহমান খান (অবসরে গেছেন), বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিন, বিচারপতি মো: আক্তারুজ্জামান, বিচারপতি মো: আমিনুল ইসলাম, বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন, বিচারপতি খিজির হায়াত ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস : রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন ও অন্যান্য দণ্ড পাওয়া সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ১ ডিসেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। এটা ছিল আদালত অঙ্গনে ২০২৪ সালের একটি আলোচিত ঘটনা। রায়ে আদালত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এ রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ মামলায় রায়ে বিচারিক আদালত মোট ৪৯ জনকে সাজা দিয়েছিলেন। হাইকোর্ট তাদের প্রত্যেককে খালাস দিয়েছেন।
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পান বাবর, পরেশ বড়ুয়ার যাবজ্জীবন : বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ছয়জনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর ছয় আসামির সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অপর দিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে এ রায় দেন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালাস পেয়েছন খালেদা জিয়া : জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ২৭ নভেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ রায় ঘোষণা করেন। একই সাথে খালাস দেয়া হয়েছে এ মামলার সব আসামিকে। রায় ঘোষণার পর আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, এই মামলার কোনো সাক্ষী বলেনি যে খালেদা জিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। আদালত আমাদের আপিল মঞ্জুর করে খালেদা জিয়াকে খালাস দিয়েছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত : গত ১১ নভেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে করা আবেদন) মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। একই সাথে খালেদা জিয়াকে দেয়া ১০ বছরের সাজাও স্থগিত করেন আদালত। আপিল শুনানি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে সাজা। পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে আপিলের সারসংক্ষেপ দুই সপ্তাহের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির বিধান বাতিল, গণভোট পুনর্বহাল : বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেছেন- এই সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র। একই সাথে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক,৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। রায়ে আদালত বলেন, গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করা হয়, যেটি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অংশ ছিল। এটি ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে যুক্ত হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো।
গত ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পঞ্চদশ সংবিধানের সংশোধনী আইন ও আইনের কয়েকটি ধারার বৈধতা নিয়ে পৃথক দুটি রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ রায় ঘোষণা করে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। রায়ে আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার আগামী জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা