০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ পৌষ ১৪৩০, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`
বিবিসির বিশ্লেষণ

তিব্বতে চীনের বাঁধ ভাটির দেশের জন্য হুমকি

-


তিব্বতে চীন যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তা ভাটির দেশের অর্থনীতিকে ধংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে আশংকা প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞরা। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ভাটির দেশ হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের মত নদীমাতৃক দেশের কৃষি ও অর্থনীতিই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; বরং এ অঞ্চলে অভিন্ন নদীর ওপর চীনের একতরফা নিয়ন্ত্রণ এনে দেবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদী বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, বাঁধটি চীনকে আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ বা সরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা দেবে, যা দক্ষিণে ব্রক্ষ্মপুত্র নামে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ এবং আসাম রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যমুনা নদীতে গিয়ে পড়েছে।
অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক লোভি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ‘এ নদীগুলির ওপর [তিব্বত মালভূমিতে] নিয়ন্ত্রণ কার্যকরভাবে চীনকে ভারতের অর্থনীতিকে গলা টিপে ধরার মতো করবে’।
২০২০-এ চীন ইয়ারলুং সাংপো বাঁধ প্রকল্পের জন্য তার পরিকল্পনা ঘোষণা করার পরপরই, ভারতের একজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছিলেন যে, ভারত সরকার ‘চীনা বাঁধ প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব কমাতে’ একটি বৃহৎ জলবিদ্যুৎ বাঁধ এবং জলাধার উন্নয়নের অন্বেষণ করছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পূর্বে প্রস্তাবিত বাঁধের বিষয়ে ভারতের উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ওই বছরেই বলেছিল যে, নদীটিতে বাঁধ দেয়ার জন্য চীনের একটি ‘বৈধ অধিকার’ রয়েছে এবং নিম্নধারা অর্থাৎ ভাটির দেশ হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব কী পড়তে পারে তা বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু এরপর এসব দেশের সাথে চীনের ওই মহাপ্রকল্প নিয়ে কার্যকর কোনো আলোচনা হয়নি।
চীন বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দেয়ার পর তিব্বত সম্প্রদায়ের বাস্তুচ্যুতি এবং ভারত ও বাংলাদেশে পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। বাঁধটি, যা ইয়ারলুং সাংপো নদীর নিম্ন প্রান্তে অবস্থিত হবে, বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থ্রি গর্জেস বাঁধের চেয়ে তিনগুণ বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে পারে।

চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া উন্নয়নকে ‘একটি নিরাপদ প্রকল্প যা পরিবেশগত সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়’ বলে বর্ণনা করে বলেছে, এটি স্থানীয় সমৃদ্ধি বাড়াবে এবং বেইজিংয়ের জলবায়ু নিরপেক্ষতা লক্ষ্যে অবদান রাখবে। মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং বিশেষজ্ঞরা অবশ্য উন্নয়নের নক-অন প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা, বাঁধটি নির্মাণ করা হলে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে স্থানচ্যুত করতে পারে, সেইসাথে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তন করতে পারে এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে, যা তিব্বত মালভূমিতে সবচেয়ে ধনী এবং সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় হিসেবে গড়ে উঠেছে।
চীন তিব্বত অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণ করেছে - ১৯৫০ এর দশকে বেইজিং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ওই অঞ্চলে এসব বাঁধ নির্মাণ একটি বিতর্কিত বিষয়। অ্যাক্টিভিস্টরা এর আগে বিবিসিকে বলেছে যে, বাঁধগুলি তিব্বতিদের এবং তাদের জমির ওপর বেইজিংয়ের শোষণের সর্বশেষ উদাহরণ। প্রধানত-বৌদ্ধ অধ্যুষিত তিব্বত বছরের পর বছর ধরে নির্মম নির্যাতনের তরঙ্গ দেখেছে, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। এই বছরের শুরুর দিকে, চীন সরকার আরও একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী শত শত তিব্বতিকে গ্রেফতার করেছে। এটি গ্রেফতার এবং মারধরের মধ্যে শেষ হয়েছে, কিছু লোক গুরুতর আহত হয়েছে, বিবিসি সূত্র এবং যাচাইকৃত ফুটেজের মাধ্যমে জানতে পেরেছে।
তিব্বতিরা গাংতুও বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আসছিল, যা বেশ কয়েকটি গ্রামকে স্থানচ্যুত করবে এবং প্রাচীন মঠগুলোকে ‘পবিত্র’ ধ্বংসাবশেষে নিমজ্জিত করবে। বেইজিং অবশ্য বলেছে যে, তারা স্থানীয়দের স্থানান্তরিত করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং প্রাচীন ম্যুরালগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে।

ইয়ারলুং সাংপো বাঁধের ক্ষেত্রে, চীনা কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলছে যে, প্রকল্পটি বড় ধরনের পরিবেশগত প্রভাব ফেলবে না- তবে তারা কতজন লোককে বাস্তুচ্যুত করবে তা নির্ধারিত হয়নি। থ্রি গর্জেস জলবিদ্যুৎ বাঁধের জন্য ১.৪ মিলিয়ন লোকের পুনর্বাসনের প্রয়োজন পড়েছিল। প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, বিশাল উন্নয়নের জন্য নামচা বারওয়া পর্বত দিয়ে কমপক্ষে চারটি ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল ড্রিল করতে হবে, যা তিব্বতের দীর্ঘতম নদী ইয়ারলুং সাংপোর প্রবাহকে সরিয়ে দেবে।
নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে নদীর শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য চীন গত এক দশকে ইয়ারলুং সাংপোর ধারে একাধিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। পৃথিবীর গভীরতম গিরিখাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, নদীর একটি অংশ মাত্র ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ২,০০০ মিটারে পড়ে, যা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিশাল সম্ভাবনার হাতছানি দেয়।

নদীর নাটকীয় ভূ-সংস্থান অবশ্য বড় ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জও তৈরি করে - এবং এ সর্বশেষ বাঁধটি এখন পর্যন্ত চীনের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী এক প্রকল্প। উন্নয়নের স্থানটি ভূমিকম্প-প্রবণ টেকটোনিক প্লেটের সীমানা বরাবর অবস্থিত। চীনা গবেষকরা পূর্বে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে খাড়া এবং সরু গিরিখাতে এ ধরনের ব্যাপক খনন ও নির্মাণ ভূমিধসের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেবে।
২০২২ সালে সিচুয়ান প্রাদেশিক ভূতাত্ত্বিক ব্যুরোর একজন সিনিয়র প্রকৌশলী বলেন, ‘ভূমিকম্প-প্ররোচিত ভূমিধস এবং কাদা-পাথরের প্রবাহ প্রায়শই অনিয়ন্ত্রিত হয় এবং এটি প্রকল্পের জন্য একটি বিশাল হুমকিও সৃষ্টি করবে।’মনে করা হচ্ছে, এ বাঁধ নির্মাণের সামগ্রিক খরচ ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছাড়িয়ে যাবে। সেটা হলে এ প্রকল্পই হবে এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সব থেকে দামি পরিকাঠামোগত প্রকল্প। এ প্রকল্প তৈরি করতে অন্তত এক দশক সময় লাগবে।
এদিকে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং গত শুক্রবার বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হলে সংশ্লিষ্ট নদীর গতিপথের নিম্নœ অববাহিকায় অবস্থিত অঞ্চলগুলোর কোনো ক্ষতি হবে না। কয়েক দশকের সমীক্ষার পরই তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন বলেও দাবি করেছেন মাও নিং। কিন্তু তথ্য বলছে, তিব্বতের যে অংশে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন, তা হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের সেই অংশের অন্তর্গত, যেখানকার ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক এবং বাস্তুতন্ত্রগত অবস্থান অত্যন্ত সংবেদনশীল।
মাও নিংয়ের বক্তব্য হলো সমস্ত বিষয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তবেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। এ প্রকল্পের কারণে যাতে পরিবেশের ভারসাম্য কোনোভাবেই বিঘিœত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হবে। মাও নিংয়ের আরো দাবি, এ প্রকল্পের কারণে যাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বাসিন্দাদের কোনো সমস্যা বা বিপর্যয়ের মুখে না পড়তে হয়, তা নিশ্চিত করতে সেইসব দেশের সরকার ও প্রশাসনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে বেইজিং। অবশ্যই প্রতিবেশীদের সাথে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement