২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

উচ্চ প্রযুক্তির কিছু চিকিৎসা ছাড়া সবই দেশে হচ্ছে

প্রয়োজন হচ্ছে না বিদেশ যাওয়ার
-

কিছু দরকারি মেশিন না থাকা, রোগীদের সাথে ভালো আচরণ না করা, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি মেডিক্যাল ট্যুরিজমের কারণে বাংলাদেশ থেকে রোগীরা বিদেশে চলে যায়; বিশেষ করে পাশের দেশ ভারতে। সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি এবং মেডিক্যাল ট্যুরিজমের বিষয়টি বাদ দিলে রোগীর প্রতি চিকিৎসকদের ইতিবাচক আচরণ এবং প্রয়োজনীয় মেশিন এনে বসাতে পারলে বাংলাদেশী রোগীদের বিদেশমুখিতা অনেকটাই বন্ধ করা সম্ভব হবে। অল্প কয়েকটি সাব স্পেশালিটি ছাড়া সব ধরনের রোগের প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাংলাদেশে গড়ে ওঠেছে। প্রায় সবধরনের রোগের চিকিৎসাই বাংলাদেশে সম্ভব। এক সরকারি হিসাব থেকে জানা যায়, চিকিৎসা খাতে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৫০০ কোটি ডলার বা ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (এক ডলার ১২৫ টাকা হিসেবে) বিদেশ চলে যাচ্ছে। এ বিশাল অঙ্কের অর্থ বাংলাদেশে বিনিয়োগ হলে চিকিৎসা খাতের খুব দ্রুত উন্নতি ঘটবে এবং কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাটা অন্য অনেক অত্যাবশ্যক খাতে ব্যবহার করা যাবে।
এ ব্যাপারে নয়া দিগন্ত বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করেছেন এমন ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছে। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট জেনারেল অ্যান্ড অনলোকলজি সার্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সার্জারি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, কিছু চিকিৎসা আছে যেগুলোর জন্য শুধু অভিজ্ঞ চিকিৎসক হলেই চলে না, প্রয়োজন হয় বড় ধরনের প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউশন, যেখানে জটিল রোগীদের সাপোর্ট দেয়ার জন্য সব সুযোগ-সুবিধাই থাকবে। সে-রকম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গড়ে উঠেনি। এটা সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগেই হতে পারে। ভারতে বিশাল জনসংখ্যার করণে সেখানে প্রচুর রোগী হয় বলে রোগী অনুপাতে চিকিৎসাসেবা খাতে বড় বিনিয়োগও আছে। সে কারণে সেখানে বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হয়ে উঠছে না। সরকারি উদ্যোগে বেসরকারিভাবে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা গেলে বাংলাদেশেও জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে হবে না।
অধ্যাপক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, এর বাইরে কিছু উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসা আছে যেগুলো বাংলাদেশে হয় না। সে ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষকে যেতেই হয়। এর মধ্যে লিভার প্রতিস্থাপন, কিডনি প্রতিস্থাপন, হাঁটু প্রতিস্থাপন অন্যতম। এ রোগগুলো ছাড়া বাকি সব রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশে খুব ভালো হয়। তারপরও প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, অনেক রোগী কেবল মানসিক স্বস্তি পেতে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের ক্যান্সারসহ নন কমিউনিকেবল রোগ রয়েছে। সুস্থ রাখার জন্য চিকিৎসকরা ওষুধ দিয়ে থাকেন যাতে রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগীর মানসিক স্বস্তিটা সবচেয়ে বড়। ‘এখানে নয় ওখানে গেলে আরো ভালো থাকা যাবে’ এ মানসিকতা থেকেই তারা বিদেশ যান। কিন্তু এ চিকিৎসাগুলো সব জায়গায় একই রকম। এ ধরনের রোগীরা শেষ পর্যন্ত দেশে এসে আমাদের চিকিৎসাধীনই থাকেন। আরেক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যারা কেবল সামাজিক মর্যাদার জন্যই বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এ শ্রেণীর লোকদের কখনোই এদেশে আটকে রাখা যাবে না। এরা মনে করেন বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা করলে তাদের সামাজিক স্ট্যাটাস বাড়ে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজির বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক মো: সাইফুল ইসলাম সেলিম এ ব্যাপারে বলেন, রোগের শুরুতেই বড় চিকিৎসক দেখানোর মানসিকতা এবং সন্তুষ্ট হতে না পারায় অনেক রোগী বিদেশ চলে যাচ্ছে। আর এ ধরনের রোগীরা সহজে সন্তুষ্ট হয় না। ফলে দেখা যায়, বিদেশ থেকে এসেও তারা অসন্তুষ্টিতে ভোগেন, সুস্থ না হয়ে আবারো দেশে এসে তারা আরো বড় ডাক্তারের কাছে গিয়ে থাকেন। অন্য দিকে বাংলাদেশে ডায়গনোসিসের রেট বেশি। সঠিক ডায়গনোসিস না হওয়ার কারণে রোগীরা বিদেশ যাচ্ছেন। ডায়গনোসিসের ব্যাপারে স্ট্রিক্ট রোল (কঠোর নিয়ম) মানার ব্যবস্থা করে দিলে এ সমস্যা কেটে যাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: এবিএম ছফিউল্লাহ বলেন, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিবিষয়ক কিছু চিকিৎসা আছে যেগুলোর জন্য বিশেষজ্ঞ এ দেশে আছেন, কিন্তু কিছু মেশিন প্রয়োজন হয় এ জন্য। এসব মেশিন বাংলাদেশে নেই, সে কারণে এ সংক্রান্ত চিকিৎসার জন্য রোগীদের বিদেশ যেতে হয়। পেনক্রিয়াসের (অগ্নাশয়) সূক্ষ্ম নালিতে অনেক সময় পাথর হয়। এটা খুবই জটিল একটি অপারেশন, মেশিন ছাড়া এ অপারেশন করা সম্ভব না। এ ছাড়া আমরা এ দেশে কোয়ালিটি সার্ভিস দিতে পারছি না। গত ১৭ বছরে এমডি/এমএস-এর মতো চিকিৎসাবিষয়ক ডিগ্রিকে রাজনীতিকরণ করে ফেলেছি। এখানে রাজনৈতিক ইচ্ছা/অনিচ্ছা প্রাধান্য পাওয়ায় মানসম্পন্ন চিকিৎসক গড়ে ওঠেনি। তা ছাড়া আচরণগত কিছু শিক্ষা চিকিৎসকদের নিতে হয়, সেটাতেও আমরা পিছিয়ে। আমাদের চিকিৎসকরা রোগীদের সাথে ভালো আচরণ করতে পারছেন না, তারা রোগীদের কথা শুনেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এখানে নীতিনির্ধারকদের নজর দিতে হবে। এর বাইরে ডা: এবিএম ছফিউল্লাহ বলেন, জাতীয় পর্যায়ের চিকিৎসকদের ওপর চাপ বেশি থাকে। যে রোগীগুলো থানা লেভেলের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যেতে পারে, তারা শহরে বিশেষ করে ঢাকায় চলে আসছে। ফলে কোয়ালিটি চিকিৎসা হয় না বলে অনেক রোগী বিদেশে চলে যায়। একটি রেফারেল সিস্টেম চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: রেজাউল আলম জানান, কিছু মেশিন আছে যেগুলো বাংলাদেশে নেই। এ কারণে রোগীরা বিদেশ গিয়ে বিশেষত ভারতে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করে আসেন। আবার সাথে সাথে ভারতের কিছু আকর্ষণীয়, কিন্তু ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে সেগুলো ঘুরে আসতে পারেন। মেডিক্যাল ট্যুরিজম অন্যতম বড় একটি ফ্যাক্টর বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের। ডা: রেজাউল আলম বলেন, বাংলাদেশে একটা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ নেই। এ যন্ত্রটির অভাবে অনেক সূক্ষ্ম ডায়গনোসিস এখানে হয় না।
রোগীরা কী বলেন যারা বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা করেছেন, বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করেছেন এমন কয়েকজন রোগীর সাথে কথা হয়েছে নয়া দিগন্তের এ প্রতিনিধির। সাবেক টিঅ্যান্ডটি কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম ভারতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্পাইন সার্জন অধ্যাপক ডা: মো: ইদ্রিস আলীকে না পেয়ে। আতিকুল ইসলাম অধ্যাপক ইদ্রিস আলীর নিয়মিত রোগী ছিলেন। অধ্যাপক ইদ্রিস আলী অসুস্থ থাকায় আতিকুল ইসলাম ভারতে গিয়ে স্পাইন অপারেশন করিয়ে এনেছেন। তিনি গেছেন তার পছন্দের চিকিৎসককে দেখাতে না পেরে। স্পাইনের ব্যাপারে অন্য চিকিৎসকের প্রতি তার আস্থাহীনতার কারণেই তিনি ভারতে গিয়েছিলেন বলেন জানান।
আরেক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মো: জাহাঙ্গীর আলম জানান, ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল অনেক আগে থেকেই। সেখানকার কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। সুযোগটা হলো তার হার্টে সমস্যা তৈরি হওয়ায়। দুই বছর আগে ভারতের একটি বিখ্যাত হাসপাতালে গিয়ে হার্ট পরীক্ষা করে ওষুধ নিয়ে এসেছেন এবং কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনাও দেখে এসেছেন। নরসিংদী জেলার মাধবদীর রহমাতুল্লাহ (নামটি কিছুটা পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে) বাহরাইনে থাকতেন। সেখানে তার কিডনি অকেজো হয়ে যায়। তার একটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। নিজ আত্মীয়ের মধ্যে কারো কাছ থেকে একটি কিডনি তিনি পাননি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে একজন ডোনারকে সাড়ে সাত লাখ টাকা দিয়ে ভারতে নিয়ে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করে এনেছেন। বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে নিজের কাছের আত্মীয় ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে কিডনি নেয়া যায় না, আইনি জটিলতায় পড়তে হয়। জটিলতা এড়াতে রহমাতুল্লাহ ভারতে গিয়েছিলেন। তিনি এখনো সুস্থ আছেন। বড় হাসপাতাল এবং যেখানে অনেক বেশি অপারেশন হয় সেখানকার সার্জনরা অনেক বেশি দক্ষ হয়ে থাকেন। এই মানসিকতা থেকে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা শফিউল ইসলাম ভারতে গিয়ে ব্রেইনে জমা রক্ত পরিষ্কার করে এনেছেন। অথচ বাংলাদেশে অনেক তরুণ নিউরো সার্জন আছেন যারা খুব দক্ষতার সাথে এই অপারেশনগুলো করেন অপেক্ষাকৃত কম অর্থে, এসব তথ্য জানানোর পরও তিনি ভারতে চলে যান। বাংলাদেশের সার্জনদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেননি বলে তিনি সেখানে গিয়েছেন বলে জানালেন নয়া দিগন্তকে।


আরো সংবাদ



premium cement